ইচ্ছেপত্রের ব্যাখ্যায় অখুশি শিল্পী সুমন
২৯ অক্টোবর ২০২০সম্প্রতি ফেসবুকে একটি ইচ্ছাপত্র প্রকাশ করেছেন সঙ্গীতশিল্পী সুমন৷ তাঁর নিজের হাতে লেখা সেই ইচ্ছাপত্রে শিল্পী জানিয়েছেন, মৃত্যুর পর কী চান তিনি৷ গত শুক্রবার ফেসবুকে একটি পোস্টে প্রাক্তন সাংসদ লিখেছেন, ‘আমার সমস্ত পাণ্ডুলিপি, গান, রচনা, স্বরলিপি, রেকর্ডিং, হার্ডডিস্ক, পেনড্রাইভ, লেখার খাতা, প্রিন্ট আউট যেন কলকাতা পুরসভার গাড়ি ডেকে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয় সেগুলি ধ্বংস করার জন্য৷ আমার কোনো কিছু যেন আমার মৃত্যুর পর পড়ে না থাকে৷ আমার ব্যবহার করা সব যন্ত্র, বাজনা, সরঞ্জাম যেন ধ্বংস করা হয়৷ এর অন্যথা হবে আমার অপমান৷’
মৃত্যুর পর শিল্পী সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়ে দায়িত্ব ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার তিনি দিয়েছেন মৃন্ময়ী তোকদারকে৷ অন্য কারো অধিকার থাকবে না বলে ঘোষণা করেছেন৷ তিনি লিখেছেন, ‘এটা এক প্রবীণ মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞপ্তি৷ অনেক অভিজ্ঞতার পর, অনেক ভেবেচিন্তে লিখছি৷ অনুগ্রহ করে আবেগের বশবর্তী হবেন না৷ উপদেশ, পরামর্শ দেবেন না৷’ এই ইচ্ছাপত্র প্রকাশের পরই বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠতে থাকে, কেন একথা হঠাৎ বলতে গেলেন নাগরিক কবিয়াল, তিনি কি অবসাদে ভুগছেন? যদিও আগেভাগেই সুমন ফেসবুক পোস্টে ঘোষণা করেছেন, ‘আমার জীবনে কোনো হতাশা, দুঃখ, ব্যর্থতাবোধ, অবসাদ নেই৷ আমি সানন্দে বেঁচে আছি৷ আমার কাজ করে যাচ্ছি৷’
ইচ্ছাপত্রে নিজেকে ‘জন্মস্বাধীন’ তকমা দেওয়া এই শিল্পীর পোস্ট শেয়ার হয়েছে অনেকবার৷ এটি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোচনাও ক্রমশ বেড়েছে৷ একাধিক সংবাদপত্রে এই সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হয়েছে৷ এই আলোচনার মূল বিষয়বস্তু, বাংলা গানের মোড়-ঘোরানো সুমন তাঁর সৃষ্টি ধ্বংস করে দিতে বলেছেন মৃত্যুর পর৷ এতে ঘোর আপত্তি শিল্পীর৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমি আদৌ সৃষ্টিকর্ম ধ্বংসের কথা বলিনি৷ আসলে আমার লেখা ভালো করে কেউ পড়তে চাইছেন না৷ অনেকেই অন্য রকম ব্যাখ্যা করছেন৷ এমনকী স্থানীয় সংবাদপত্রেও এই ব্যাখ্যা বেরিয়েছে৷’ এরপর ক্ষুব্ধ সুমন আক্রমণ করে বসেন বাঙালিকে৷ তাঁর বক্তব্য, ‘পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির বারোটা বেজে গিয়েছে৷ আসলে হয়তো বাঙালি এরকমই৷’
মৃত্যুর পর সম্পত্তি-সহ অন্যান্য বিষয় নিষ্পত্তির জন্য অনেকেই উইল করেন৷ তার আইনি ভিত্তি থাকে৷ কিন্তু আইনজীবীদের বক্তব্য, কবীর সুমনের এই ইচ্ছাপত্রের সেই ভিত্তি নেই৷ আইনজীবী অঙ্কন বিশ্বাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘উইলের ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, যিনি তা কার্যকর করবেন৷ এটা উইলের সময় ঠিক করে দিতে হয়৷ মৃত্যুর পর প্রয়াত মানুষটির ইচ্ছে কার্যকর করা হয় সেই ব্যক্তির মাধ্যমেই৷ এই ইচ্ছাপত্রে একজনের নাম থাকলেও তাঁর সম্পর্কে পর্যাপ্ত বিবরণ নেই৷ সেই কারণে এটি আইনের চোখে গ্রাহ্য নয়৷’ কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘মুসলিম ব্যক্তিগত আইন অনুযায়ী সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ উইল করে দেওয়া যায় নিজের ইচ্ছেয়৷ কিন্তু বাকি সম্পত্তির ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির ইচ্ছাই যথেষ্ট নয়৷ এক্ষেত্রে উত্তরসূরিদের সম্মতি থাকা বাধ্যতামূলক৷’ এ বিষয়ে উঠে আসে সাহিত্যিক কাফকার প্রসঙ্গ৷ তিনিও নিজের সৃষ্টি ধ্বংস করার কথা বললেও তা হয়নি৷ মৃন্ময়ী তোকদারের উত্তরাধিকার সম্পর্কে সব্যসাচীর মন্তব্য, ‘আইনি উত্তরসূরি কে, সেটা দেখা হয়৷ অর্থাৎ পরিবারের সদস্য কে, সেটা প্রমাণ করা জরুরি৷’
যদিও অনেকেই আইনের কচকচির মধ্যে যেতে চান না৷ এটাকে তাঁরা দেখছেন এক প্রতিভাধর শিল্পীর অন্তরের চাহিদা হিসেবেই৷ সুমন-অনুরাগী শ্রাবণী সেনগুপ্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এর মধ্যে আইন টেনে আনাই নিরর্থক৷ মনের ইচ্ছেটুকু তিনি প্রকাশ করেছেন৷ ভবিষ্যতে এটার বিধিবদ্ধ রূপ তৈরি হতেই পারে৷ এখানে ইচ্ছেটাই আসল, আইনের দিকটি নয়৷’