মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় বলে আমার মনে হয়৷ ‘যা ইচ্ছা' কী আসলে স্বাধীনতা, নাকি কিছু ক্ষেত্রে অন্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপও?
বিজ্ঞাপন
লেখকদের কী এসব চিন্তা করে লেখা উচিত, নাকি পাঠকদের বেছে বেছে পড়া উচিত? বিষয়টা খুব জটিল৷
সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে ‘কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়' নামে একটি গান ছিল, যেখানে অভিনেতা উৎপল দত্ত হীরক রাজার ভূমিকায় দারুণ অভিনয় করেছেন৷ গানের অংশটিতে দেখা যায় গায়ক গান গাইছেন, রাজা সুন্দর সেই কণ্ঠে মোহিত হয়ে ছন্দে ছন্দে মাথা দোলাচ্ছেন৷ এক পর্যায়ে ‘বাহ, খাসা' বলে গায়কের প্রশংসা করতেও শোনা যায় হীরক রাজাকে৷
কিন্তু যখনই গানের কথায় ‘মন্দ যে সে সিংহাসনে চড়ে' অংশটুকু আসে, রাজার মুখের অভিব্যক্তি পালটে যায়৷ আমাত্যরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন৷ এক পর্যায়ে ধমক দিয়ে গান থামিয়ে দেন রাজা৷ টেবিল চাপড়ে বলে ওঠেন, ‘‘এ গান বন্ধ৷ এর মুখ বেঁধে ফেলো, হাত-পা বেঁধে ফেলো, বেঁধে বনের মধ্যে নিয়ে গিয়ে গর্তের মধ্যে ফেলো৷''
রাজা-রাজড়াদের তুষ্ট করা, না করতে পারলে গর্দান যাওয়ার ইতিহাস অনেক পুরনো৷
উইলিয়াম শেকসপিয়ারকে বিবেচনা করা হয় ইংরেজি সাহিত্যের সেরা সাহিত্যিক হিসেবে, বিশ্বের অন্যতম সেরা নাট্যকার হিসেবে৷ তার হেমলেট, ম্যাকবেথ, মার্চেন্ট অব ভেনিস, রোমিও জুলিয়েটের মতো নাটক বিশ্বের সব দেশেই পাঠ্য৷ এমন কোনো ভাষা হয়তো নেই, যে ভাষায় শেকসপিয়ারের সাহিত্য অনুবাদ হয়নি৷
শেকসপিয়ারের এসব সাহিত্যকর্মে ছিল সরাসরি রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা৷ রানি প্রথম এলিজাবেথ এবং রাজা প্রথম জেমসের আনুগত্য নিয়েই সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি৷ ম্যাকবেথ নাটকটিও রচনা হয়েছে রাজা প্রথম জেমসকে খুশি করার লক্ষ্যেই৷ জেমসকে বিজয়ী পক্ষে রেখেই সাজানো হয়েছে নাটকের গল্প৷ কোনো কোনো গবেষক মনে করেন জেমস নিজেই এই নাটকটি লিখতে শেকসপিয়ারকে আদেশ দিয়েছিলেন৷
বর্তমান যুগে ম্যাকবেথ অসাধারণ সৃষ্টি বলে বিবেচিত হয়, কিন্তু তখন যারা রাজার বিরোধীতাকারী ছিলেন, তারা শেকসপিয়ারকে কেমন দৃষ্টিতে দেখতেন?
যুগ যুগ ধরে সাহিত্যকর্ম এমন পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েই এগিয়েছে৷ আরাকান রাজসভায় স্থান না পেলে মহাকবি আলাওল পদ্মাবতী কাব্য লিখতেন কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে৷ উল্লেখ্য, এ কাব্য আরাকান রাজার আমাত্য মাগন ঠাকুরের নির্দেশেই রচনা করেছিলেন আলাওল৷
আধুনিক যুগেও এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি৷ এমনকি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রতিভূ বলে ধরে নেয়া হয় যাদের, তাদের ক্ষেত্রেও এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে৷
বর্তমান সাহিত্যিকরাও কী এর ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছেন? প্রকাশনা শিল্প এখন আরো অনেক জটিল হয়েছে৷ সাহিত্য প্রকাশনা এখন অনেকটাই বইমেলা কেন্দ্রীক হয়ে পড়েছে৷ ফলে সাহিত্য মুল্য কতোটুকু, তার চেয়ে অনেকাংশে বড় হয়ে উঠছে বিক্রয় মূল্য৷
বইমেলায় কেমন বই প্রকাশ করা যাবে, কেমন যাবে না, সেটিও নাকি নিয়ন্ত্রণ করা হয়৷ বাংলা একাডেমি তো বটেই, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও এখন বইয়ের ‘কনটেন্ট' নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে চায়৷ আগের যুগে ছিলেন রাজা-সম্রাট, এখন তৈরি হয়েছে নানা সিন্ডিকেট৷ সাহিত্য পুরষ্কার ও বুক রিভিউয়ের নামে নিজেদের সিন্ডিকেটের সাহিত্যিককে প্রচার করা, অন্যদের দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করা রয়েছে একদিকে৷ অন্যদিকে বিপুল অর্থ শক্তি নিয়ে অনলাইন-অফলাইনে প্রকাশনা শিল্প নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করারও চেষ্টা চলছে৷
বর্তমান প্রজন্ম থেকে কালোত্তীর্ণ কোনো সাহিত্য জন্ম নেবে কিনা, তা সময়ই বলতে পারবে৷ সমাজ পরিস্থিতির প্রভাব সাহিত্য কখনই এড়াতে পারে না৷ ফলে বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তন এখন যে অস্থির সময় পার করছে, তার প্রভাবও সাহিত্যে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক৷
ফলে একদিকে কেউ কেউ ক্ষমতাসীন বা বিশেষ কোনো গোষ্ঠীকে খুশি করে জনপ্রিয়তা ও আনুকূল্য পাওয়াটাকে মূল লক্ষ্য কের নিয়েছেন৷ অন্যদিকে অনেকে যা ইচ্ছা লিখে কোনঠাসা হওয়া বা হীরক রাজার দেশের গায়কের মতো ‘গর্তে পড়তে' চাওয়াটাও মানতে পারছেন না৷
কিন্তু এর ফল যা হচ্ছে, তাতে কী বাংলা সাহিত্যের কোনো বিশেষ উপকার হচ্ছে? পাঠকেরা নিজেদের রুচি অনুযায়ী বই বেছে নেবেন, কিন্তু সেই উন্মুক্ত বাজার সৃষ্টির পরিস্থিতি কী রয়েছে? আমার মনে হয় না৷
বিশ্বের কয়েকটি বিতর্কিত বই
ধর্ম, রাজনীতি, অশ্লীলতা ইত্যাদি নানা কারণে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বই বিতর্কের জন্ম দিয়েছে৷ ছবিঘরে এমনই কয়েকটি বইয়ের কথা থাকছে৷
ছবি: Random House
১৯৮৪
সেই ১৯৪৯ সালেই ব্রিটিশ লেখক জর্জ অরওয়েল লিখে গিয়েছিলেন ভবিষ্যতে এমন ‘বিগ ব্রাদার’রা পৃথিবী শাসন করবেন, যারা ‘থট পুলিশ’ বা চিন্তার পুলিশ দিয়ে মানুষের ইচ্ছা আর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কেড়ে নেবেন৷ একই লেখকের রাশিয়ার স্টালিন যুগের ভয়াবহতাকে তুলে ধরা বই ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ হয়েছিল৷
ছবি: Getty Images/J. Sullivan
ইউলিসিস
১৯০৪ সালের ১৬ জুন আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে লেওপোল্ড ব্লুমের কাটানো একটি দিন নিয়ে ইউলিসিস লিখেছেন জেমস জয়েস (ছবি)৷ বইটি প্রথম সিরিজ আকারে প্রকাশিত হয়েছিল৷ এরপর ১৯২২ সালে বই আকারে প্রকাশিত হয়৷ বইটির বিরুদ্ধে ব্লাসফেমি ও যৌনতার অভিযোগ উঠেছিল৷ এমনকি সিরিজ আকারে প্রকাশের সময় অশ্লীলতার মামলাও হয়েছিল৷
ছবি: Getty Images/AFP/F. Caffrey
দ্য স্যাটানিক ভার্সেস
ব্রিটিশ-ভারতীয় লেখক সালমান রুশদির এই বইটি ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয়৷ বইটি লেখার সময় মহানবি (সাঃ) এর জীবন থেকেও অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন তিনি৷ কিন্তু বইটির বিভিন্ন অংশ অনেক মুসলমানের কাছে অবমাননাকর ঠেকেছে৷ ফলে বিভিন্ন দিক থেকে হুমকি পেয়েছিলেন রুশদি৷ ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লাহ খামেনি তাঁকে হত্যার ফতোয়াও দিয়েছিলেন৷ এছাড়া এই বই বিক্রি করায় বিভিন্ন দোকানে বোমা হামলাও হয়েছে৷
ছবি: Random House
দ্য হিন্দুজ: অ্যান অল্টারনেটিভ হিস্ট্রি
মার্কিন ভারততত্ত্ববিদ উইন্ডি ডোনিগারের লেখা ‘দ্য হিন্দুজ: অ্যান অল্টারনেটিভ হিস্ট্রি’ বইটি (হাতে ধরা) ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয়৷ এরপর ২০১৪ সালে ভারতে এটি নিয়ে বিতর্ক হয়৷ বইটিতে হিন্দুদের ধর্মীয় ভাবাবেগকে আঘাত করা হয়েছে এবং ভুলভাবে হিন্দু ধর্মের ব্যাখ্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ আনা হয়েছিল৷ ফলে ভারতের বাজার থেকে বইটি তুলে নেয়া হয়েছিল৷ অবশ্য ২০ মাস পর আবারও ভারতের বাজারে ফিরে এসেছিল বইটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Mukherjee
দ্যা দা ভিঞ্চি কোড
মার্কিন লেখক ড্যান ব্রাউনের এই বই সারা বিশ্বের রোমান ক্যাথলিকদের সমালোচনা কুড়িয়েছিল৷ কারণ বইতে তিনি যিশু খ্রিস্ট আর ইহুদি নারী ম্যারি মাগডালেনের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন করেছেন৷ ২০০৩ সালে এটি প্রকাশিত হয়েছিল৷
ছবি: picture alliance / Photoshot
অ্যাঞ্জেলস অ্যান্ড ডেমনস
ড্যান ব্রাউনের এই বইটি প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে৷ এটি একটি ধর্মীয় থ্রিলার৷ এতে প্রাচীন যুগের ‘ইলুমিনাটি’ নামের সিক্রেট সোসাইটির কথা যেমন আছে, তেমন ভ্যাটিকান ধ্বংস করে দেয়ার হুমকিও রয়েছে৷ ফলে এই বইয়ের উপর ভিত্তি করে নির্মিত মুভিটি (ছবি) ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ধর্মের নেতা ও অনুসারীদের তোপের মুখে পড়েছিল৷
ছবি: Imago/Unimedia Images
লোলিতা
রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে জন্ম নেয়া ভ্লাদিমির নাবোকফের লেখা বইটি ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল৷ মাঝবয়সি এক সাহিত্যের অধ্যাপকের ১২ বছরের লোলিতাকে ভালো লাগা এবং তার প্রতি আবেশ তৈরি হওয়া নিয়ে বইটি লেখা হয়েছে৷
ছবি: Penguin
সোফি-স চয়েস
মার্কিন লেখক উইলিয়াম স্টাইরন ১৯৭৯ সালে বইটি লিখেছিলেন৷ হলোকস্ট থেকে বেঁচে যাওয়া এক নারীর কথা এতে তুলে ধরা হয়েছে৷ সোফি নামের সেই নারী নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে গিয়ে নাথানের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান৷ এরপর স্টিঙ্গো নামের আরেকজন তাদের দুজনের বন্ধু হন৷ এক পর্যায়ে সোফি আর স্টিঙ্গোর সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে থাকে৷ তবে লেখক স্টাইরন হলোকস্টের বিষয়টি যেভাবে তুলে ধরেছেন তা বিতর্কিত হয়েছিল৷
দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ হাকলবেরি ফিন
শ্বেতাঙ্গ কিশোর হাকলবেরি ফিন ও তার কৃষ্ণাঙ্গ বন্ধু জিমের (যে একসময় দাস ছিল) দুঃসাহসিক অভিযান নিয়ে বইটি লিখেছেন মার্কিন লেখক মার্ক টোয়েন৷ ১৮৮৪ সালে যুক্তরাজ্যে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল৷ সেই সময় বইয়ে বর্ণবাদী ভাষা ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছিল৷ বিশেষ করে ‘নিগার’ শব্দটি বেশ কয়েকবার ব্যবহার করেছেন লেখক৷ যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের এই নামে ডাকা হতো৷
ছবি: Gemeinfrei
দ্য ক্যাচার ইন দ্যা রাই
মূল চরিত্র ১৭ বছরের হোল্ডেন কোলফিল্ডের অবাধ্যতা আর উদ্বেগ নিয়ে কাহিনি গড়ে উঠেছে৷ উপন্যাস হিসেবে ১৯৫১ সালে প্রকাশিত বইটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লেখা হলেও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এটি৷ বিটলস তারকা জন লেননের হত্যাকারী মার্ক চ্যাপম্যান যেদিন লেননকে হত্যা করেন সেদিনই তিনি বইটি কিনেছিলেন৷ মার্কিন লেখক জে ডি সালিঞ্জার বইটি লিখেছেন৷
ট্রপিক অফ ক্যানসার
হেনরি মিলারের বইটি ১৯৩৪ সালে ফ্রান্সে প্রকাশিত হয়েছিল৷ তবে সেই সময় বইটির বিরুদ্ধে মিসোজিনি অর্থাৎ নারীর প্রতি বিদ্বেষ, এবং যৌনতা বিষয়ক উপাদান বেশি থাকার অভিযোগ উঠেছিল৷ এরপর ১৯৫১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বইটি প্রকাশের সময়ও অশ্লীলতার অভিযোগে কয়েকটি মামলা হয়৷ পরে অবশ্য সেই অভিযোগ থেকে মুক্তি দেন একটি আদালত৷
দ্য চকলেট ওয়ার
ক্যাথলিক স্কুলে জেরি নামে এক কিশোরের উপর চালানো মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন নিয়ে বইটি লিখেছেন রবার্ট কর্মিয়ার৷ ফলে ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হওয়ার পরপরই বিতর্ক শুরু হয়েছিল৷