সম্প্রতি এয়ার ইন্ডিয়ার পাইলটদের দিয়ে একটি তদন্ত করানো হয়। সেই রিপোর্টে ইঞ্জিন গোলযোগের কথাই বলা হয়েছে।
আহমেদাবাদে বিমান দুর্ঘটনাছবি: Ajit Solanki/AP/dpa/picture alliance
বিজ্ঞাপন
সপ্তাহখানেক আগে আহমেদাবাদ থেকে লন্ডন যাওয়ার জন্য টেক অফ করেই ভেঙে পড়ে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ড্রিম লাইনার বিমান। ২৪২ জন যাত্রী এবং কর্মীর মধ্যে মাত্র একজন ওই বিমান থেকে বেঁচে ফিরেছেন। টেক অফের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রানওয়ের অদূরে একটি প্রতিষ্ঠানে ভেঙে পড়ে বিমানটি। কীভাবে এই দুর্ঘটনা ঘটলো, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়েছে। এয়ারক্রাফট অ্যাকসিডেন্ট ব্যুরো (এএআইবি) ইতিমধ্যেই সরকারিভাবে একটি তদন্ত শুরু করেছে। যার রিপোর্ট এখনো সামনে আসেনি। তবে এয়ার ইন্ডিয়ার পাইলটদের দিয়ে আরেকটি সমান্তরাল তদন্ত সংগঠিত করা হয়েছিল। যেখানে একটি ফ্লাইট সিমিউলেটরে ওই ঘটনার পুনর্গঠন করা হয়েছিল। সেই রিপোর্টটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত না হলেও তার বেশ কিছু তথ্য সামনে এসেছে।
জানা গেছে, এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৮৭ এর যে বিমানটি ভেঙে পড়ে, হুবুহু সেই বিমানটির অনুকরণেই সাজানো হয়েছিল একটি ফ্লাইট সিমিউলেটর। ভেঙে পড়া বিমানটির প্রতিটি বিষয় ধরা হয়েছিল ওই সিমিউলেটরে। যে পাইলটেরা এই তদন্তটি করেছেন, তারা জানিয়েছেন, টেক অফের মুহূর্তে বিমানটির দু'টি ইঞ্জিনই বিকল হয়ে গেছিল। যে পাইলটেরা ওই বিমানটি চালাচ্ছিলেন, তারা তা বুঝতে পেরেই সময় নষ্ট না করে 'মে ডে' কল দেন। শুধু তা-ই নয়, বিমানের ইঞ্জিন বিকল হলে যে বিশেষ আপৎকালীন টার্বাইন ব্যবহারের কথা, তা-ও তারা ব্যবহারের চেষ্টা করেন। কিন্তু ওই টার্বাইন বিমানটিকে ওড়াতে পারেনি। সামান্য উড়ান নিয়েই তা ভেঙে পড়ে রানওয়ের ঠিক বাইরে।
আহমেদাবাদে বিমান দুর্ঘটনার কারণ কী?
ভারতের আহমেদাবাদে বিমান দুর্ঘটনার সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো জানা যায়নি। তা জানতে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটি ওড়ার সময় রক্ষণাবেক্ষণে ত্রুটি ছিল কিনা তদন্ত করে দেখা হবে।
ছবি: PUNIT PARANJPE/AFP
মৃত্যু বেড়ে ২৬৫
বিধ্বস্ত বিমানে ছিলেন ২৪২ জন যাত্রী ও বিমানকর্মী। একজন বাদে সকলেই মারা গেছেন। অবিশ্বাস্যভাবে বেঁচে যাওয়া যাত্রী বিশ্বাস কুমার রমেশ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি ভালো আছেন। তাকে শুক্রবার জেনারেল ওয়ার্ডে নিয়ে আসা হয়েছে। এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটি মেডিক্যাল কলেজের হস্টেলের মেসের উপর ভেঙে পড়ে। তার জেরে মারা গেছেন আরো ২৪ জন।
ছবি: VIJAY PATANI/AFP
তাপমাত্রা ছিল এক হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সাংবাদিকদের বলেছেন, বিমানে এক লাখ ২৫ হাজার লিটার জ্বালানি ছিল। দমকলের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিমান ভেঙে পড়ার পর জ্বালানির ট্যাংকে বিস্ফোরণ হয়। তাপমাত্রা সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ফলে একজন বাদে কেউই বাঁচতে পারেননি। রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেছেন, তিনি বা অন্যরা এই ধরনের বিপর্যয় আগে দেখেননি।
ছবি: Ajit Solanki/AP/picture alliance
নিহতদের ক্ষতিপূরণ
দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া যাত্রীদের প্রত্যেকের পরিবারকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বলে এয়ার ইন্ডিয়ার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা টাটা’র পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। আহতদের চিকিৎসার খরচও তারা বহন করবেন। মেডিক্যাল কলেজের যে হস্টেলের উপর বিমানটি বিধ্বস্ত হয়, সেই হস্টেল ও অন্য ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি টাটা সারিয়ে দেবে।
ছবি: Ajit Solanki/AP/picture alliance
বেঁচে যাওয়া যাত্রীর কথা
একমাত্র বেঁচে যাওয়া ব্রিটিশ যাত্রী বিশ্বাস কুমার রমেশ বলেছেন, বিমানটি ওড়ার এক মিনিটের মধ্যে ভেঙে পড়ে। তিনি এমার্জেন্সি দরজার পাশে ১১-এ সিটে বসেছিলেন। বিশ্বাস বলেছেন, ''প্লেন ভেঙে পড়ার পর আমার সিট ছিটকে বেরিয়ে আসে। আমি সিটবেল্ট খুলি। আমি নিচে গিয়ে পড়েছিলাম। তারপর বেরোবার চেষ্টা করি। আমি বেঁচে যাবো, ভাবতে পারিনি। চোখের সামনে মানুষকে মরে যেতে দেখেছি।''
ছবি: Ministry of Home Affairs India/AP/picture alliance
ডিজিটাল ভিডিও রেকর্ডার উদ্ধার
দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানের ডিজিটাল ভিডিও রেকর্ডার উদ্ধার করা হয়েছে। বার্তাসংস্থা এএনআই জানিয়েছে, গুজরাটের এটিএস (অ্যান্টি টেররিস্ট স্কোয়াড) ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে তা খুঁজে বের করেছে। তবে এয়ার ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিমানের ব্ল্যাক বক্স এখনো পাওয়া যায়নি।
ছবি: Adnan Abidi/REUTERS
দুর্ঘটনার কারণ
দুর্ঘটনার কারণ এখনো জানা যায়নি। অসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় বলেছে, তদন্ত শেষ না হলে কারণ বলা সম্ভব নয়। তদন্ত করছে এয়ারক্রাফট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো। ড্রিমলাইনার বিমানে দুটো ইঞ্জিন একসঙ্গে খারাপ হওয়ার ঘটনা বিরল। সেটা হলে আর কিছু করার থাকে না। কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, বিমানে পাখি ধাক্কা মারায় এই দুর্ঘটনা। অন্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আহমেদাবাদের তাপমাত্রা ও বেশি ওজন বহন করায় এই দুর্ঘটনা।
ছবি: CISF/ANI Photo
ইঞ্জিন নির্মাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা আসছেন
এই বিমানের ইঞ্জিন তৈরি করেছে জিই এয়ারোস্পেস। তাদের প্রতিনিধিরা ভারতে আসছেন। বিমানের নির্মাতা বোয়িংয়ের প্রতিনিধিরাও ভারতে আসছেন।
ছবি: Amit Dave/REUTERS
ড্রিমলাইনারের ভবিষ্যৎ
ভারতে বোয়িং-এর ড্রিমলাইনার ৭৮৭-৮ বিমান বসিয়ে দেয়ার কথা সরকার চিন্তাভাবনা করছে বলে এনডিটিভি-কে সূত্র জানিয়েছে। নিরাপত্তার কথা ভেবে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে বলে তারা জানিয়েছে। এই বিষয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ও বোয়িংয়ের মধ্যে আলোচনা চলছে। তবে পুরোটাই নির্ভর করছে এই বিমান দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্তের উপর।
ছবি: imago images/Ralph Peters
অ্যামেরিকার আপত্তি
মার্কিন পরিবহনমন্ত্রী সিন ডাফি এবং ফেডারেল এভিযেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ক্রিস রোচেলিউ বলেছেন, ড্রিমলাইনার বিমান বসিয়ে দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ডাফির দাবি, তিনি ন্য়াশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ডের চেয়ারম্যান জেনিফার হোমেনডির সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের প্রতিনিধিদল ভারতে আসছে। বোয়িং ও জিই এয়ারোস্পেসের প্রতিনিধিরাও আসছে। তারা সবকিছু খতিয়ে দেখবে। তদন্তের কাজে্ও সাহায্য করবে।
ছবি: Ajit Solanki/AP Photo/picture alliance
রক্ষণাবেক্ষণ খতিয়ে দেখা হবে
এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানগুলির রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি খতিয়ে দেখবে সরকার। সেখানে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিভ প্রসিডিওর অনুসরণ করা হচ্ছে কি না তা দেখা হবে। গত তিন দশকের মধ্য়ে এত বড় বিমান দুর্ঘটনা হয়নি। পুরো দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে এই বিমান দুর্ঘটনা। আলোড়ন ফেলেছে গোটা বিশ্বে। এরকম ঘটনা যাতে আর না ঘটে, তার দিকে নজর দিয়েছে সরকার।
ছবি: Nicolas Economou/NurPhoto/picture alliance
ঘটনাস্থলে প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এদিন আহমেদাবাদ গিয়ে দুর্ঘটনাস্থলে যান। তিনি প্রায় ২০ মিনিট সেখানে ছিলেন। হাসপাতালে গিয়ে একমাত্র বেঁচে যাওয়া যাত্রী বিশ্বাস কুমারের সঙ্গে কথা বলেন। তারপর প্রধানমন্ত্রী সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে তিনি দুর্ঘটনা পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেন। দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া গুজরাটের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপানির বাড়িতেও যান নরেন্দ্র মোদী।
ছবি: Narendra Modi/X
11 ছবি1 | 11
যে পাইলটেরা এই তদন্ত করেছেন, তারা জানিয়েছেন, ওই দুর্ঘটনায় পাইলটদের দোষ ছিল, এমন কোনো তথ্য তাদের হাতে আসেনি। ভেঙে পড়ার মুহূর্তে ল্যান্ডিং গিয়ার যে অবস্থায় ছিল, ডানার ফ্ল্যাপ যে জায়গায় ছিল, তা থেকে স্পষ্ট, বিমানের ইঞ্জিন কাজ করছিল না। ফলে টেক অফের সময় পাইলটেরা যে কম্যান্ডগুলি দিচ্ছিলেন, তা কাজ করছিল না।
জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানির ইঞ্জিন
১২ জুন বোয়িংয়ের যে বিমানটি আহমেদাবাদে ভেঙে পড়ে, তার ইঞ্জিন তৈরি করেছে জেনারেল ইলেকট্রিক কোম্পানি। কেন টেক অফের সময় বিমানের দু'টি ইঞ্জিনই বিকল হয়ে গেল, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেছে। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, সাধারণত এমনটা ঘটে না। একই সঙ্গে বিমানের দু'টি ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেল, তা-ও টেক অফের মুহূর্তে, এমন ঘটনা বিরল। এবিষয়ে বোয়িংকে জিজ্ঞাসা করা হলেও, তারা কোনো কথা বলতে রাজি হয়নি। সরকারিভাবে এএআইবি যে তদন্ত করছে, সেখানেও বোয়িং যথেষ্ট সহায়তা করছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
উল্লেখ্য, ওই বিমান দুর্ঘটনার পরেই বোয়িংয়ের একটি অভ্যন্তরীণ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। বোয়িংয়ের এক কর্মী বছর দশেক আগে বেশ কয়েকটি ড্রিমলাইনার বিমানের বিক্রি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ওই প্রতিটি বিমানই ত্রুটিপূর্ণ। বছর দশেকের মধ্যে ওই বিমানগুলি দুর্ঘটনার কবলে পড়তে পারে। যদিও সে সময় ওই রিপোর্ট ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ। বস্তুত, ওই রিপোর্টের দশ বছরের মাথাতেই আমদাবাদের দুর্ঘটনা ঘটে। তবে কী সেই রিপোর্টে ইঞ্জিন বিকল হওয়ার কথাই বলা ছিল? বিশেষজ্ঞ মহলে এই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
আমদাবাদের দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন মহলে নানা আলোচনা শুরু হয়েছিল। বেশ কিছু বিশেষজ্ঞ সে সময় পাইলটদের ভুলের কথা উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু সিমিউলেটরে যে পাইলটেরা ওই ঘটনার তদন্ত করেছেন, তাদের রিপোর্টে স্পষ্ট, পাইলটদের পক্ষে যায়া ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ছিল, তারা তার সবটাই নিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সিমিউলেটরে করা এই তদন্ত সামগ্রিক তদন্তে গুরুত্ব পাবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।