পশ্চিমবঙ্গের নিয়োগ দুর্নীতি মামলা নিয়ে তদন্তরত কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা ইডি-কে তীব্র ভর্ৎসনা বিচারপতি অমৃতা সিনহার।
বিজ্ঞাপন
ইডি-র তদন্তের ধারা, তাদের কার্যকলাপ, তাদের প্রাথমিকতা, তাদের তথ্য না দেয়া নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন তোলেন বিচারপতি। বস্তুত বিচারপতির প্রশ্নবানে খেই হারিয়ে ফেলেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিক ও আইনজীবীরা। বিচারপতি সিনহা সোজাসুজি বলেন, ''আপনারা ঠিকভাবে কাজ করছেন না। আমি জানি না, এর কারণটা কী?''
বিচারপতি বলেন, ''আপনারা যে নথি দয়েছেন, তাতে বলা হয়েছে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাত্র তিনটি বিমা আছে। তার কি কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই? তিনি তো সাংসদ। তার বেতন তো ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে? সেসব বিবরণ নেই কেন?
তখন ইডির পক্ষ থেকে বলা হয়, এই বিবরণ অভিযুক্তর তরফে দেয়া হয়েছে। বিচারপতি বলেন, ''আপনারা কি পোস্ট অফিস? কেউ কিছু দিল, আপনারা সেটা কোর্টে দিয়ে দেবেন? আপনারা কেন তথ্য দেননি? আমি তো শকড। শুধু তিনটি বিমার কথা। আপনারা কি আদালতের কাছ থেকে তথ্য গোপন করতে চাইছেন?''
অভিষেকের সংস্থা লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস নিয়েও ইডি সেভাবে কোনো তথ্যই দেয়নি বলে জানিয়েছেন বিচারপতি সিনহা। তিনি জানতে চান, ''কেন এই সংস্থার সব ডিরেক্টরকে জেরা করা হয়নি। ওদের কারখানায় কী হত?''
কলকাতায় ইডি হানা দিলেই মিলছে টাকার পাহাড়
পার্থ-ঘনিষ্ঠ অর্পিতার ফ্ল্যাট থেকে পাওয়া গিয়েছিল ৫২ কোটি। এবার কলকাতায় ব্যবয়াসীর বাড়ি থেকে ১৭ কোটি পেল ইডি। এর আগে হালিশহরের পুরপ্রধান রাজু সাহনির বাড়ি থেকে পাওয়া গেছিল ৮০ লাখ।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
ব্যবসায়ী আমির খানের বাড়ি
কলকাতার গার্ডেনরিচে ব্যবসায়ী নিসার আহমেদ খানের ছেলে আমির খানের বাড়ি থেকে উদ্ধার হলো ১৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা। আগে থেকে খবর পেয়ে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট(ইডি)-এর কর্মীরা আমির খানের বাড়ি, অফিস মিলিয়ে ছয় জায়গায় হানা দেয়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
রাশি রাশি নোট
আমির খানের খাটের তলায় প্লাস্টিকের প্যাকেটে টাকা রাখা ছিল। সেই রাশি রাশি নোট উদ্ধার করে ইডি। বেশিরভাগ ৫০০ টাকার নোট। দুই হাজার ও দুইশ টাকার নোটও ছিল।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
টাকা গুনতে মেশিন
টাকা গোনার জন্য স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার কর্মকর্তাদের সাহায্য নেয় ইডি। সেখান থেকে আসে টাকা গোনার মেশিন। আসেন ব্যাংক কর্মীরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে টাকা গোনা হয়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কে এই আমির খান?
আমির খান ও তার সহযোগীরা মিলে একটি গেম অ্যাপ চালাত। 'ই নাগেটস' নামে এই মোবাইল গেমিং অ্যাপের সাহায্যে গ্রাহকদের টাকা হাতিয়ে নিত তারা। গ্রাহকরা গেম খেললে কমিশন পেতেন। অ্যাপের ওয়ালেট থেকে কমিশনের টাকা তুলতে পারতেন। তার জন্য ওয়ালেটে টাকা রাখতে হত। বেশি কমিশন পাওয়া যাবে ভেবে গ্রাহকরা প্রচুর টাকা সেখানে রাখতেন। তারপর সেই টাকা হাতিয়ে নেয়া হত বলে ইডি সূত্র জানাচ্ছে। অনেক ভুয়া অ্যাকাউন্টের খোঁজ মিলেছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
এর পিছনে কারা?
আমির খানের সঙ্গে এখনো কোনো রাজনৈতিক দলের যোগাযোগের কথা সামনে আসেনি। কিন্তু রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছে, রাজনীতিক থেকে ব্যবসায়ীর বাড়ি থেকে কী করে এভাবে কোটি কোটি টাকা পাওয়া যাচ্ছে? এভাবে উদ্ধার করা টাকার পাহাড় কলকাতা আগে দেখেনি। তৃণমূল বলছে, বিজেপি কেন্দ্রীয় সংস্থা দিয়ে রাজ্যের ব্যবয়াসীদের টার্গেট করছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মন্ত্রীর বক্তব্য
গার্ডেনরিচ হলো রাজ্যের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের এলাকা। প্রথমে ফিরহাদ বলেন, ''বন্দর এলাকা বলেই ব্যবসায়ীদের চেনা র দায় কি আমার নাকি? ইডি রাজ্যের ব্যবসায়ীদের টার্গেট করছে।'' একদিন পরেই তিনি সুর বদল করে বলেন, ''ইডি তার কাজ করবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।''
ছবি: picture-alliance/ZumaPress
বাড়ির মানুষ
তল্লাশি চালানোর সময় বাড়ির মানুষ তা দেখার চেষ্টা করেন। এক নারী তো অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। তবে বাড়ির মানুষ এই টাকা নিয়ে মুখ খোলেননি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
সশস্ত্র কেন্দ্রীয় বাহিনী
ইডি যখন তল্লাশি চালাচ্ছিল, তখন বাইরে মোতায়েন করা হয়েছিল সশস্ত্র কেন্দ্রীয় বাহিনী। স্থানীয় মানুষ সেখানে আসেন। কিন্তু কেউই কিছু বুঝতে পারছিলেন না। পরে এত টাকা উদ্ধার হয়েছে জেনে তারা অবাক।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
সংবাদমাধ্যমের ভিড়
বাড়ির সামনে ছিল সংবাদমাধ্যম বিশেষ করে টিভির সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিকদের ভিড়। কেউ মুখ খুললেই তার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ছিলেন তারা। তাদের প্রশ্ন ছিল, কী করে এত টাকা পাওয়া গেল? ইডি কীভাবে জানল এই টাকার কথা? এর সঙ্গে কি কোনো রাজনৈতিক যোগ আছে? এই সব প্রশ্নের জবাব এখনো পাওয়া যায়নি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
9 ছবি1 | 9
বিচারপতি বলেছেন, ''আপনারা যে গতিতে চলছেন, তাতে তদন্ত কোনোদিন শেষ হবে না। আপনারা দেশের সেরা তদন্তকারী। কিন্তু আপনারা যেভাবে চলছেন, যে গতিতে চলছেন, যে নথিপত্র দিচ্ছেন, তাতে আমার মনে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে।''
বিটারপতি সিনহার প্রশ্ন, ''আপনারা কী চান? তদন্ত সময়ে হোক, নাকি এরকমভাবে দেরি করতে করতে সব সূত্র হারিয়ে যাবে, সেটা চান? আপনারা কি প্রশিক্ষিত? তদন্ত করার প্রশিক্ষণ পেয়েছেন?''
বিচারপতি জানিয়েছেন, ''আপনারা নিজে থেকে কিছু করছেন না। আদালতের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছেন। আদালতের কাজ তদন্ত করা নয়। আদালত দেখছে, সবকিছু আইন মেনে হচ্ছে কি না। বিচারপতি বলেন, ইডি রিপোর্ট দিয়েছে, তাতে কোনো তথ্য নেই। বলা হচ্ছে, ফ্ল্যাট আছে, জমি আছে। তার কোনো বিস্তারিত বিবরণ নেই।''
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংস্থা লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস নিয়ে তার প্রশ্ন, একজন ডিরেক্টরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। বাকিদের কেন করা হলো না? তাদের একটা কারখানা আছে, সেটা নিয়েও বিস্তারিত কোনো তথ্য নেই।
এভাবেই বিচারপতি ইডি-র তদন্ত নিয়ে চূড়ান্ত অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
বিচারপতির এই পর্যবেক্ষণের পর রাজ্যের বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেছেন, ''ইডির উপরে যে কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপি-র কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই তা প্রমাণ হলো। এটাও সত্যি বন্দ্যোপাধ্য়ায় পরিবারের দুর্নীতি নিয়ে আদালত শেষ দেখতে চায়। ইডি আধিকারিকদের উচিত, সময়ে তদন্তের কাজ শেষ করা।'' তবে বিচারপতির পর্যবেক্ষণ থেকে কী করে বোঝা গেল, ইডি কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে তার কোনো ব্যাখ্যা শুভেন্দু দেননি।
শান্তনু এবং অয়নের বিরাট সম্পত্তি
নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ইডি-র হাতে গ্রেপ্তার তৃণমূল নেতা শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় ও অয়ন শীল। ডিডাব্লিউয়ের ক্যামেরায় তাদের সম্পত্তির ছবি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শান্তনুর বাড়ি
১০ মার্চ তৃণমূল নেতা শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় গ্রেপ্তার করে ইডি। ৩৭ ঘণ্টা জেরা করার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। শান্তনুর কাছে বিরাট সম্পত্তির হদিশ পায় ইডি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শান্তনুর ফোনের দোকান
জিরাটে শান্তনুর ফোনের দোকান। এই দোকানে শান্তনু বসতেন। শান্তনুর প্রতিবেশী দোকানদারের অভিযোগ, রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পর দোকানে আর খুব বেশি আসতেন না শান্তনু।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শান্তনুর ধাবা
বলাগড়ে এই ধাবাটি চালাতেন শান্তনু। ইডি-র কর্মকর্তারা এই ধাবাতেও তল্লাশি চালিয়েছে। এই ধাবা কীভাবে শান্তনু কিনেছিলেন, কোথা থেকে টাকা এসেছে, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শান্তনুর কাকার বাড়ি
বলাগড়ে শান্তনুর কাকার বাড়ি। এই বাড়িতেও আসতেন শান্তনু। স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, এই বাড়িতেও শান্তনুর বিনিয়োগ ছিল।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শান্তনুর রিসর্ট
বলাগড়ে এই রিসর্ট তৈরি করেছিলেন শান্তনু। এই রিসর্টে তল্লাশি চালিয়েছে ইডি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বলাগড় থানা
শান্তনুকে এই থানাতে এনেই প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল ইডি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শান্তনুর স্ত্রীয়ের বাড়ি
শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী এখন এই বাড়িতে আছেন। এই বাড়িতেও শান্তনুর নিয়মিত যাতায়াত ছিল।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
অয়নের অফিস
শান্তনুর সূত্র ধরেই ব্যবসায়ী অয়ন শীলকে গ্রেপ্তার করে ইডি। তিনিও নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ। অয়নের সঙ্গে বীরভূমের নেতা ধৃত অনুব্রত মণ্ডলের যোগাযোগ ছিল বলে পুলিশের ধারণা। সল্টলেকে এই অফিসে বসতেন অয়ন। থাকতেনও এখানে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
অয়নের গাড়ি
অয়ন গ্রেপ্তার হয়েছেন। বাড়ির সামনে এখনও পড়ে তার বিলাসবহুল গাড়ি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
9 ছবি1 | 9
তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছেন, ''ইডি তার তালিকায় কী রাখবে বা রাখবে না, তাদের বিষয়। অভিষেকের হলফনামায় সব সম্পত্তির বিবরণ আছে। ইডি কোনটা দিয়েছে, কোনটা দেয়নি সেটা তাদের ব্যাপার।। বিচারপতি অভিষেকের নাম করে জিজ্ঞাসা করছেন, ইডি জবাব দিচ্ছে, এই চিত্রনাট্যটা করে অভিষেককে বদনাম করার চেষ্টা হচ্ছে।''
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেছেন, ''একজন সাংসদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকে না, সেটা যদি ইডি বলে, তাহলে তাদের আমি ইডিয়ট বলতে বেশি পছন্দ করব।''
সিপিএমের সুজন চক্রবর্তী এরপর আবার তৃণমূল-বিজেপি আঁতাতের প্রসঙ্গ আবার তুলেছেন। তিনি বলেছেন, ''আমরা যখন দিদি-মোদী সেটিংয়ের কথা বলতাম, তখন অনেকে বিশ্বাস করতেন না। এখন বুঝুন।''
সিপিএম সাংসদ ও আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য এবিপি আনন্দকে বলেছেন, ''বিচারব্যবস্থার স্বাধীন পদক্ষেপে ওরা আতঙ্কিত। মোদী-মমতার গভীর আঁতাত আছে। ইডির মতো সংস্থাকে দখল করে নিয়েছে ওরা। ওরা ভাবতে পারেনি স্বাধীন বিবেকবান বিচারপতিরা এরকম পদক্ষেপ নেবেন।''
'রাজনৈতিক তদন্ত'
ইডি নিয়ে বিচারপতির পর্যবেক্ষণের পর তদন্ত নিয়েও নানান প্রশ্ন উঠেছে। সাংবাদিক আশিস গুপ্ত ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''এই সব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক তদন্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রয়োজনে যখন নড়াচড়া করা দরকার তখন তদন্ত গতি পায়, আবার যখন ঢিলে দেয়ার দরকার হয়, তখন তা থেমে থাকে।''
প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র বলেছেন, ''সারদার তদন্ত তো নয় বছর ধরে চলছে।''
আশিসের বক্তব্য, ''সারদাতে এত কিছু বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বলে জানানো হলো, তার থেকে ক্ষতিপূরণ কতটা দেয়া হয়েছে? এই সব তদন্ত চলতেই থাকলে মানুষ একসময় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।''
প্রশ্ন হলো, বিচারপতির এই ক়ড়া মনোভাবের পর তদন্তে কি গতি আসবে? তদন্ত কি দ্রুত শেষ হবে?