করোনা মহামারির বছর ২০২০ চলে যাচ্ছে। বছরটা যারা বেঁচে পার করছেন, তারা যতদিন বেঁচে থাকবেন একেবারে আলাদা করেই এর কথা মনে রাখবেন। কারণ, এমন দুর্ভোগ আর দুঃসময়ে ভরা বছর এই প্রজন্ম বোধহয় আর দেখবে না।
বিজ্ঞাপন
কিন্তু কথায় বলে, কোনো কিছুর যেমন খারাপ দিক আছে, খুঁজলে তার মধ্যে হয়ত ভালো কিছুও পাওয়া যেতে পারে। এভাবে হয়ত করোনারও কিছু ভালো দিক পাওয়া যাবে। সেই ভালো বিষয়ের কথা মনে করে নতুন বছরে ঢোকাই সুখি মানুষের কাজ হবে। কারণ, সুখ হেঁটে কারও কাছে আসে না, তাকে খুঁজে নিজের কাছে নিয়ে আসতে হয়।
চলুন, এখন সেই কাজটাই করি।
করোনার কারণে মানুষ এখন আগের চেয়ে বেশি স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে উঠেছে। কারণ, দেখা গেছে, আগে থেকে বিভিন্ন রোগে ভোগা মানুষকেই করোনা ভাইরাস বেশি কাবু করতে পেরেছে। তাই সুস্থ জীবনযাপনের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। মানুষ এখন আগের চেয়ে বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন জীবনযাপন করে। হাঁচি, কাশি দেয়ার সময় হাত দিয়ে মুখ ঢাকে। দোকানপাট, রেস্তোরাঁ, শহরের অলিগলি আগের চেয়ে বেশি পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করা হয়। আমার ধারণা, মানুষ এই পরিবর্তিত অভ্যাসগুলো অন্তত কয়েক বছর মেনে চলবে।
করোনা এসেছে বলেই মানুষ অনেকটা সময় ঘরে থাকতে বাধ্য হয়েছে। যদিও এ কারণে পারিবারিক সহিংসতা বেড়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। তবে আমার মনে হয়, এই সময়ে দম্পতিদের একটা বড় অংশ একে অপরকে ঘরের কাজে সহায়তা করেছে। কিন্তু হয়ত কাটতির কথা ভেবে গণমাধ্যম সেই খবর প্রকাশ করেনি। শুধু স্বামী-স্ত্রী কেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক মহামারির সময়ে আরো গভীর হয়েছে। আর যারা এই সময়টাকে সম্পর্ক উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারেননি, তাদের চেয়ে দুর্ভাগা আর ক'জন আছে?
করোনার কারণে পৃথিবীটা আরো বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২০ সালে কার্বন নিঃসরণ সাত ভাগ কমেছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে নতুন রেকর্ড৷ মানুষের যাতায়াত, বিমানযাত্রা, পর্যটন ইত্যাদি বন্ধ থাকাসহ নানা কারণে কার্বন নিঃসরণ কম হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে বেশ কয়েকবছর ধরেই কথা হচ্ছে। কিন্তু অনেক উদ্যোগ নিয়েও যথেষ্ট ফল পাওয়া যাচ্ছিলো না। করোনার কারণে কিছুটা হলেও সেটা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া মানুষের সমাগম কম থাকায় শহরের রাস্তায় বন্যপ্রাণীর ঘোরাফেরা, কক্সবাজার সৈকতে কচ্ছপের দেখা পাওয়ার মতো মন ভালো করা খবর করোনার কারণেই পেয়েছি আমরা।
প্রিয় পাঠক, আপনিও যদি একটু সময় নিয়ে ভাবেন তাহলে উপরের তালিকায় যোগ করার মতো আরো কিছু নিশ্চয় পাবেন।
আসুন, ২০২০ থেকে ভালো কিছু নিয়ে সবাই মিলে নতুন বছরে পা দেই।
২০২০ সালকে যেভাবে মনে রাখবে ভবিষ্যৎ
ক্যালেন্ডার বদলানো আর আট-দশটা বছরের মতো নয় ২০২০৷ শুধু নিকট ভবিষ্যৎ নয়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বারবার গল্প হয়ে ফিরবে সালটি৷ সেই গল্পের বিষয়বস্তুগুলো কী হতে পারে দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: Reuters/J. Malone
‘অজানা’ এক ভাইরাস এসেছিল
২০১৯ সালের শেষে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানের মানুষেরা অজানা অসুখে ভুগতে শুরু করে৷ গণমাধ্যমে একটু-আধটু সেই খবর আসতে শুরু করলেও কে ভেবেছিল পরবর্তী এক বছর গোটা বিশ্বকে তা নাড়িয়ে দেবে! ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ সালে উহানের স্বাস্থ্য কমিশন নিউমোনিয়া ছড়িয়ে পড়ার কথা জানায়৷ পাঁচ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই সংক্রান্ত প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷
ছবি: Getty Images/AFP/STR
নাম সার্স-কোভ-টু
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন এই করোনা ভাইরাসের নাম দেয় সার্স-কোভ-টু৷ আর এর থেকে সৃষ্ট রোগের নাম কোভিড-১৯৷ ১২ জানুয়ারি ভাইরাসটির জিন রহস্য প্রকাশ করে চীন৷ তখন পর্যন্ত সেটি কিন্তু চীনবন্দিই ছিল৷ একদিন পরই প্রথমবারের মতো ধরা পড়ে থাইল্যান্ডে৷ এরপর আর আটকে রাখা যায়নি ক্ষুদে সেই দানবকে৷
ছবি: Reuters/NEXU Science Communication
নীরব ঘাতক
প্রথম ধরা পড়ার ৪৭ দিনের মাথায় চীনে ৬৬ হাজার মানুষকে ভাইরাস আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়৷ মারা যান ১৫০০ জন৷ শহর থেকে শহরে, দেশ থেকে দেশে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ে নভেল করোনা৷ সংক্রমণ বাড়তে থাকে লাফিয়ে লাফিয়ে৷ মৃত্যুর খাতায়ও দৈনিক যোগ হতে থাকে কয়েক হাজার সংখ্যা৷ স্মরণকালে এমন মহামারির মুখোমুখি হয়নি মানুষ৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Maohua
কাছে আসতে মানা
ঔষধ নেই, প্রতিষেধক নেই৷ কিভাবে রোখা যাবে এই ভাইরাসকে, সেটি বড় প্রশ্ন হয়ে উঠে৷ দেয়া হয় মানুষে-মানুষে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ৷ ব্যবধান রাখতে হবে দেড় থেকে দুই মিটার, যার নাম দেয়া হয় ‘সামাজিক দূরত্ব’৷ গোটা পৃথিবীর চেহারা আর যোগাযোগের ধরনটাই রাতারাতি বদলে যায় তাতে৷
ছবি: Reuters/A. Kelly
হ্যান্ডশেকে বাধা
সৌজন্য হিসেবে হ্যান্ডশেক বা হাত মেলানোর রীতিকে বিদায় জানায় মানুষ৷ তার বদলে সৌজন্য আর উষ্ণতা প্রকাশের অভিনব সব উপায়ও তারা বের করে৷ কেউ মুষ্টিবদ্ধ হাত মেলায়, কেউবা কনুই, আবার হাতের বদলে পায়ে-পায়ে স্পর্শেরও চল দেখা যায়৷ তবে দূরে দাঁড়িয়ে মৌখিকভাবে সৌজন্য প্রকাশই নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হয়৷
ছবি: Reuters/FIDE/M. Emelianova
মাস্ক যখন পরিধেয়
মাস্ক পরলে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কমানো যায় কিনা শুরুতে এ নিয়ে বিতর্ক উঠেছিল৷ কিন্তু একে একে সব দেশ জনপরিসরে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করে৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও সবার মাস্ক পরার পক্ষে মত দেয়৷ সংস্কৃতি ভেদে পোশাকে ভিন্নতা থাকলেও সারা বিশ্বেই মাস্ক হয়ে উঠে অপরিহার্য পরিধেয়৷
ছবি: Getty Images/NYFW - The Shows
যারা সুপারহিরো
করোনার বিরুদ্ধে এক অসম লড়াইয়ে নামতে হয় চিকিৎসকদের৷ দেশে দেশে নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাবের মধ্যেই অচেনা শত্রুর বিরুদ্ধে কঠিন এক যুদ্ধের মুখোমুখি হন স্বাস্থ্যকর্মীরা৷ অন্যকে বাঁচানোর সেই চ্যালেঞ্জে অনেকেই জীবন দেন৷ লকডাউনে তাদের প্রতি নানা উপায়ে ধন্যবাদ আর ভালোবাসা জানাতে ভোলে না বিভিন্ন দেশের কৃতজ্ঞ মানুষেরা৷
ছবি: Reuters/S. Vera
বিচ্ছিন্ন পৃথিবী
এত কিছুর পরও ঠেকানো যায়নি সংক্রমণ, থামছিল না মৃত্যুর মিছিলও৷ লাগাম ধরতে দেশে দেশে চলে লকডাউন৷ সীমান্তে আরোপ করা হয় কড়াকড়ি৷ বন্ধ হয়ে যায় ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অর্থনৈতিক আর বিনোদনমূলক সব কর্মকাণ্ড৷ ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর পুঁজিবাজারগুলোর লেনদেনে লাগে সবচেয়ে বড় ধাক্কা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/T. Camus
ব্যালকনি বা অনলাইন কনসার্ট
আশাহীন সময়েও মানুষ আনন্দে বাঁচার উপায় ঠিক খুঁজে নেয়৷ স্পেন, ইটালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ঘরবন্দি মানুষেরা ব্যালকনিতে কনসার্ট জমিয়ে ফেলে৷ অনলাইনে ডুব দেয়া মানুষকে নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে নানাভাবে বিনোদিত করার চেষ্টা করেন তারকারাও৷
ছবি: AFP/P. Singh
প্রকৃতির ফুরসত
আধুনিক জীবনযাত্রার চাপে কোণঠাসা প্রকৃতি যেন এই দফা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে৷ বিশ্বের অর্ধেকের বেশি মানুষ যখন ঘরবন্দি, তখন নিজেকে নতুন করে ফিরে পাওয়ারই তো তার সময়৷ কোনো কোনো নির্জন মহানগরীর বুকে এমনকি বুনো প্রাণীরাও নেমে আসে৷ আর গবেষণায় দেখা যায়, ২০২০ সালে বিশ্বের কার্বন নিঃসরণ সাত ভাগ কমেছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে নতুন রেকর্ড৷
ছবি: picture-alliance/empics/P. Byrne
পড়তি ঢেউ
আক্রান্ত আর মৃত্যুর রেখাচিত্র জুন নাগাদ নামতে শুরু করে৷ ধীরে ধীরে লকডাউন তুলে নেয় দেশগুলো৷ শুরু হয় ব্যবসা-বাণিজ্য, যাতায়াত৷ খুলে দেয়া হয় এয়ারপোর্ট৷ কিন্তু এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার পৌঁছে যায় মহামন্দার সময়ের পর সর্বোচ্চ ১৪ দশমিক সাত ভাগে৷ বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর দারিদ্র্য বিমোচনে বিগত দেড় দশকের অর্জন ম্লান হয়ে যেতে থাকে৷
ছবি: picture-alliance/Zumapress/J. Merida
দর্শকবিহীন খেলা
আন্তর্জাতিক সিরিজ বা বিভিন্ন লিগের খেলা হবে, অথচ মাঠে দর্শক থাকবে না- অন্য সময় হলে এমন কথা বললে সেটি নির্ঘাত উদ্ভট শোনাতো৷ অথচ ২০২০ সালে ইউরোপীয় ফুটবল লিগ কিংবা আইপিএলসহ বিভিন্ন ক্রীড়া আসর অনুষ্ঠিত হয় স্টেডিয়ামে শূন্য বা সীমিত দর্শক উপস্থিতি নিয়ে৷
ছবি: Angel MartinezGES/picture alliance
দ্বিতীয় ঢেউ
শীতের মৌসুমে বিভিন্ন দেশে নভেম্বর থেকে নতুন করে বাড়তে শুরু করে করোনার প্রকোপ৷ এই ধাক্কায় আবার বিপর্যস্ত ইউরোপ৷ একে একে আবারো লকডাউনে ফিরে দেশগুলো৷ শুধু তাই নয় যুক্তরাজ্যে নতুন ধরনের করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়, যেটি আগের চেয়েও দ্রুত গতিতে সংক্রমণ ঘটায়৷এ কারণে নতুন করে ব্রিটেনের সঙ্গে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেয় বিভিন্ন দেশ৷
ছবি: Sebastian Kahnert/dpa/picture alliance
অসম্ভবকে সম্ভব
একটি ভ্যাকসিন উদ্ভাবন থেকে শুরু করে পরীক্ষা- সবগুলো ধাপ পেরিয়ে সরবরাহ পর্যন্ত কমপক্ষে ১০ বছর সময় লাগে৷ কিন্ত এক বছরের কম সময়ে একাধিক ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের মাধ্যমে অসম্ভবকে সম্ভব করেন বিজ্ঞানীরা৷ ডিসেম্বর থেকেই কয়েকটির প্রয়োগ শুরু হয় দেশে দেশে৷ করোনার অন্ধকার এক টানেলের যাত্রা দিয়ে ২০২০ সালের সূচনা হলেও, বিদায়টা হয় শেষ প্রান্তে টিকার আলোতে৷
এফএস/এসিবি