২০০৪ সালের ২৬শে ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের উপকূলে সমুদ্রগর্ভে সংঘটিত ভূমিকম্প যে সুনামির অবতারণা ঘটায়, তা-তে দু’লাখ ত্রিশ হাজার মানুষ প্রাণ হারান – ইন্দোনেশিয়া থেকে সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত৷
বিজ্ঞাপন
সমুদ্রগর্ভের ৩০ কিলোমিটার নীচে ছিল ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দু৷ নয় দশমিক এক থেকে নয় দশমিক তিন শক্তির জোরালো ভূকম্পন৷ শুধু তাই নয়, ভূকম্পন চলে প্রায় আট-দশ মিনিট ধরে, যা কিনা একটা রেকর্ড৷ সারা ভূগোলক নাকি এক সেন্টিমিটার কেঁপে যায়৷ বিজ্ঞানীরা এই ভূমিকম্পের নাম দিয়েছেন সুমাত্রা-আন্দামান ভূমিকম্প৷
ভূমিকম্প থেকে সৃষ্ট সুনামি বিশ্বের ১৪টি দেশে প্রায় দু'লাখ ত্রিশ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটায়৷ সুনামির জলোচ্ছ্বাস কোথাও কোথাও ৩০ মিটার অবধি উঁচু হয়ে বেলাভূমিতে আছড়ে পড়ে, বাড়িঘর ধ্বংস করে মানুষজনকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়৷ ভূমিকম্পের পর সুনামি আসতে বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় লাগলেও, সমুদ্রতটের অধিকাংশ মানুষই সমূহ এবং আসন্ন বিপদটি উপলব্ধি করতে পারেননি, কেননা তখন ভারত মহাসাগরে কোনো ধরনের সুনামি সতর্কতা প্রণালী ছিল না৷ ২০০৪ সালের সুনামির পর সেই সতর্কতা প্রণালী স্থাপন করা হয়; ২০০৬ সাল থেকে এই প্রণালী সক্রিয় এবং ভারত মহাসাগরে ২০১২ সালের ভূমিকম্পগুলির পর এই সতর্কতা প্রণালী তার কার্যকরিতাও প্রমাণ করেছে৷
সুনামিতে প্রাণ হারান দু'লাখ ত্রিশ হাজার মানুষ, তাদের মধ্যে এক লাখ সত্তর হাজারের বেশি ইন্দোনেশিয়ায়৷ প্রাণহানির হিসেবে এর পরে আসছে শ্রীলঙ্কা, ভারত – প্রধানত তামিল নাড়ু – থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ এবং সোমালিয়া৷ এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকাতেও আটজন মানুষ সমুদ্রে বাড় এসে প্রাণ হারিয়েছেন৷ সব মিলিয়ে নিহতদের এক-তৃতীয়াংশ ছিল শিশু, এছাড়া বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে পুরুষদের চেয়ে তিনগুণ বেশি মহিলার প্রাণ হারানোর খবর দিয়েছে অক্সফ্যাম৷
প্রাকৃতিক বিপর্যয় সম্পর্কে আগাম তথ্য জানার উদ্যোগ
04:04
সাহায্যের ঠিকমতো সদ্ব্যবহার হয়নি
২০০৪ সালের সুনামির পর সারা বিশ্ব থেকে সাহায্য আসে প্রায় চোদ্দ'শ কোটি ডলার, বিশেষ করে পুনর্নির্মাণের জন্য৷ কিন্তু যে হাজার হাজার প্রকল্প শুরু করা হয়, তার সব ক'টি যে সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে, এমন বলা চলে না৷ শ্রীলঙ্কার সিরিকান্ডুরাওয়াটে-তে একটি আবাসন প্রকল্পের ১৪৬টি বাড়ি এই দশ বছরের মধ্যেই বাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছে৷ দক্ষিণ থাইল্যান্ডের একটি জেলেদের গ্রামের ১০০ নৌকা খোয়া গেলেও তাদের দেওয়া হয়েছে ৪০০ নতুন নৌকা৷ ভারতের নাগাপত্তিনাম-এও প্রয়োজনাতিরিক্ত নৌকা দেওয়ার ফলে জেলেরা এখন মাল্লা পাচ্ছেন না এবং পরস্পরের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হয়েছেন৷
অক্সফ্যাম ইউকে-র এক প্রোজেক্ট ম্যানেজার ইন্দোনেশিয়ার আচে প্রদেশে পুনর্নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘ওরা সাগরে ডক নির্মাণ করেছে, কিন্তু সেগুলো কাজে লাগানো হচ্ছে না৷ ওরা বাজার তৈরি করেছে কিন্তু সেগুলো খালি৷ ওরা জলের ট্যাংক তৈরি করেছে কিন্তু সেগুলো কাজ করছে না৷''
সুনামি: ঘুরে দাঁড়িয়েছে আচে
২০০৪ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে ইন্দোনেশিয়ায় প্রাণ হারান প্রায় এক লাখ সত্তর হাজার মানুষ৷ তাঁদের অধিকাংশই মারা যান আচে প্রদেশে৷ দেখুন দশ বছরে আচের ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে ছবিঘর৷
ছবি: Getty Images/Ulet Ifansasti
ভয়ংকর ভূমিকম্প
২০০০ সালের ২৬ ডিসেম্বর৷ সমুদ্রের তলায় এক ভয়ংকর ভূমিকম্প ভারত মহাসাগরে সুনামির সৃষ্টি করে৷ অস্ট্রেলিয়া থেকে তানজেনিয়া পর্যন্ত ১১টি দেশে পৌঁছায় সেই সুনামির ঢেউ, প্রাণ হারান ২৩০,০০০ মানুষ৷ ছবিটি ইন্দোনেশিয়ার বান্দা আচে শহরে সুনামির আঘাত হানার পরে তোলা৷
ছবি: Getty Images/Ulet Ifansasti
সবচেয়ে শক্ত আঘাত
সুমাত্রার উত্তরের অবস্থিত আচে প্রদেশের সুনামি সবচেয়ে জোরে আঘাত হানে৷ শুধুমাত্র সেখানেই প্রাণ হারিয়েছেন ১৩০,০০০ মানুষ৷ ২০০৫ সালের ৮ জানুয়ারি বান্দা আচে-তে তোলা এই ছবিটি থেকে ভয়াবহতার মাত্রা কিছুটা বোঝা যায়৷
ছবি: Getty Images/Ulet Ifansasti
ক্ষতচিহ্ন
বান্দা আচের ওপর আছড়ে পরে ২৫ মিটার লম্বা ঢেউ৷ আর সেই ভাসিয়ে নিয়েছে অসংখ্য মানুষ, ঘরবাড়ি, স্থাপনা৷ ২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসে তোলা ছবিতে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত একটি মসজিদ দেখা যাচ্ছে৷ তার আশেপাশে সবকিছু কার্যত ধুয়ে নিয়ে গেছে সমুদ্রের ঢেউ৷
ছবি: AFP/Getty Images/Joel Sagget
বাস্তুহারারা
সুনামিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা আচে৷ ৯ দশমিক এক মাত্রার ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের খুব কাছে ছিল এই শহরের আবস্থান৷ সুনামিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় ১৫ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েন৷ সুনামিতে ঘরহারা মানুষদের ফিরে আসার ছবি এটি৷
ছবি: Getty Images/Ulet Ifansasti
‘দুর্গন্ধ ভয়াবহ ছিল’
সুনামির পর সংশ্লিষ্ট এলাকার অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে মার্কিন সাংবাদিক কিরা কে জানান, ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আটকে থাকা মরদেহ উদ্ধার করে গণকবরে ফেলা হয়েছিল৷ সেসময় চারদিকে ভয়াবহ দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পরে৷
ছবি: Getty Images/Ulet Ifansasti
সৃষ্টিকর্তার সাজা?
সুনামির পর আচে-র বাসিন্দাদের মধ্যে ধর্মচর্চার হার বেড়ে গেছে৷ কেননা তাদের বিশ্বাস, সুনামি ছিল সৃষ্টিকর্তার শাস্তি৷ কেননা, সুনামিতে সব কিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও অনেক মসজিদ দাঁড়িয়ে ছিল৷ দশ বছর পর তোলা এই ছবিতে সংস্কার করা একটি মসজিদ এবং তার চারপাশে আবারো গড়ে ওঠা কমিউনিটি দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: AFP/Getty Images/Chaideer Mahyuddin
শরিয়া আইন
আচে বরাবরই ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি রক্ষণশীল ছিল৷ সুনামির পরের বছরগুলোতে সেখানে বিশেষ শরিয়া আইন প্রবর্তন করা হয়েছে, যার মাধ্যমে নারীর পোশাক এবং নৈতিক ব্যবহারের মতো বিষয়গুলি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/Ulet Ifansasti
অপ্রত্যাশিত ফলাফল
সুনামির পর ব্যাপক আন্তর্জাতিক সহায়তা পেয়েছে আচে৷ ফলে সুনামির আগের চেয়েও শক্তিশালী কমিউনিটি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে তারা৷ দুর্যোগের কারণে সেখানে চলমান গৃহযুদ্ধেরও কার্যত ইতি ঘটেছে৷ ২০০৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিচ্ছিন্নতবাদীরা শান্তি চুক্তি করে৷
ছবি: Getty Images/Ulet Ifansasti
নতুন করে তৈরি অথবা সংস্কার
সুনামির পর আচের অধিকাংশ ঘরবাড়ি হয় নতুনভাবে তৈরি করা হয়েছে বা সংস্কার করা হয়েছে৷ ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে তোলা এই ছবিতে এক মোটর সাইকেল আরোহী সুনামির সময় ঘরবাড়ির উপরে এসে পরা একটি নৌকার পাশ দিয়ে যাচ্ছেন৷ সুনামির স্মৃতি হিসেবে নৌকাটি সেভাবেই রাখা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/Ulet Ifansasti
পুর্নগঠন
দশ বছর পরের চিত্র এটি৷ সুনামি মোকাবিলা করে বেঁচে থাকার আবারো ফিরে পেয়েছেন স্বাভাবিক জীবন৷ বিদেশি সহায়তায় আচে-র ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, সেতু এবং বন্দর নতুন করে তৈরি হয়েছে৷