লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, ইতিহাস চর্চার বিষয়টি সরকারের হাতে চলে গেলে আর ইতিহাস চর্চা হয় না৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জিয়াউর রহমানকে নিয়ে সম্প্রতি যে মন্তব্য করেছেন সেটি আগে শোনেননি বলেও উল্লেখ করেন তিনি৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলের ইউটিউব টক শো ‘খালেদ মুহিউদ্দীন জানতে চায়’-এ এবারের বিষয় ছিল, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনীতি৷ আলোচনায় অংশ নেন সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত এবং মহিউদ্দিন আহমদ৷ অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক একটি বক্তব্য সম্পর্কে তাদের মতামত জানতে চাওয়া হয়৷ শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ জিয়াউর রহমান অনেককে গুলি করে হত্যা করেন৷ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত ঐতিহাসিক ৭ মার্চের আলোচনায় সভায় তিনি বলেন, ‘‘চট্টগ্রামে যারা ব্যারিকেড দিচ্ছিল ২৫ মার্চ, তাদের ওপর যারা গুলি চালিয়েছিল, তার মধ্যে জিয়াউর রহমান একজন৷ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে যে বাঙালিরা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেছিল, জাতির পিতার নির্দেশে যারা সেদিন রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছিলো, তাদের অনেককে জিয়াউর রহমান গুলি করে হত্যা করে৷’’
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ এই বিষয়ে বলেন, ‘‘এই স্টোরিটা আমার নতুন মনে হলো৷ আমি এতদিন যেই স্টোরিটা জানতাম, সেটা হচ্ছে, অসহযোগ আন্দোলনের কারণে সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে চট্টগ্রাম বন্দরের পোর্টাররা রাজি হচ্ছিল না৷ অস্ত্র খালাস তো আর মেজররা করে না৷ সেখানে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে অফিসারদের ডিউটিতে পাঠানো হতো৷ ২৫ মার্চ সারাদিন ডিউটিতে ছিলেন মীর শওকত আলী৷ ...রাতের বেলা জিয়াকে সেখানে পাঠানো হয়৷ তিনি বন্দর পর্যন্ত যেতে পারেননি৷ যখন ঢাকা থেকে ক্র্যাকডাউনের খবর আসলো কর্নেল অলির কাছে (তিনি বিষয়টি অন্যদের জানানোর পর) ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান গেলেন, উনি পথের মাঝখানে জিয়াকে থামালেন, কারণ, জিয়া ব্যারিকেড সরাতে যাচ্ছিলেন৷’’ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘সেখান থেকে জিয়াকে খালেকুজ্জামান ফিরিয়ে আনেন৷ এরপর তিনি পুরো ইউনিট নিয়ে বিদ্রোহ করেন৷’’ তিনি জানান, এমনটাই তিনি সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকারে জেনেছেন৷ প্রধানমন্ত্রী ৭ই মার্চে যা বলেছেন তা এর আগে শোনেননি বলেও জানান তিনি৷
অনুষ্ঠানে জিয়াউর রহমানের ২৭ মার্চ রেডিওতে দেয়া ভাষণের প্রসঙ্গও উঠে আসে৷ সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত বলেন, ১৯৭৪ সালে জিয়া লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ থেকেই তিনি মুক্তিযুদ্ধের দিক নির্দেশনা পেয়েছিলেন৷ ১৯৯১ সাল পর্যন্তও বিএনপি জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে দাবি করেনি৷ পরে বিএনপি এটি বদলোনোর উদ্যোগ নেয়৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি তখন সংবাদ-এ কাজ করতাম৷ প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার একটি লেখা নিয়ে আসলেন যে, জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন ২৬ মার্চ, ২৭ মার্চ নয়৷ সেখান থেকে পরিবর্তন হওয়া শুরু হলো৷’’ তার মতে, ‘‘জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা করেছে এর চেয়ে ইতিহাসের নির্লজ্জ মিথ্যাচার আর কিছু হতে পারে না৷’’
মহিউদ্দিন আহমদও বলেন, জিয়াউর রহমান নিজে কখনো দাবি করেননি তিনি ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন৷ ‘‘তিনি ২৭ মার্চের বিকাল বেলার কথাই বলেছেন৷ তার সহকর্মীরাও তাই বলেন৷ তবে কিছু কিছু অতিভক্ত আছে, তারা এগুলো করে৷ কিন্তু জিয়াউর রহমান জীবিত থাকাকালেও বিতর্কটা এমন ছিল না৷ আর ৭১ সালে তো এই বিতর্ক ছিলই না৷’’
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা কেন চালু করতে চেয়েছিলেন এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন মহিউদ্দিন আহমদ৷ বলেন, ‘‘একটা দলের সংসদে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩ জন একটি দলের থাকার পরও একদল করতে হবে কেন? একদলীয় শাসন করতে হবে কেন? এর ব্যাখ্যা আমি আজ পর্যন্ত তাদের কাছে পাইনি৷’’
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা নিয়ে অজয় দাশগুপ্ত বলেন, এটি শুধু অসম্পূর্ণই নয় এমনকি প্রাথমিক কাজগুলোও করা হয়নি৷ সেটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ৷ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাত কোটি মানুষের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশগ্রহণ করেছিল৷ এক্ষেত্রে প্রকৃত গবেষণা হওয়া উচিত৷ সেটা ইতিহাস গবেষণা যেমন হয় তেমনভাবেই হওয়া উচিত৷ তিনি বলেন ‘‘ মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস প্রয়োজন৷ প্রত্যেকটা পরিবারের কোনো না কোনো একটা দেখার, বলার রয়েছে৷ সেটা একটা বড় অংশ৷ নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস, রাজনৈতিক বিতর্ক পাল্টা বিতর্ক, ক্ষমতা দখলের জন্য মুক্তিযুদ্ধ যখন একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই সময়টা যখন অতিক্রম করে যাবে, প্রকৃত ইতিহাস আমাদের দেশে গড়ে উঠবে৷ প্রত্যাশা থাকবে তরুণ প্রজন্ম, তরুণ গবেষকরা এক্ষেত্রে এগিয়ে আসবেন৷’’
অন্যদিকে মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, প্রতিটি রাজনৈতিক দলই চায় গবেষকরা তাদের হয়ে ক্রোড়পত্র লিখুক৷ ‘‘ইতিহাস চর্চার বিষয়টা সরকারের হাতে চলে গেলে আর ইতিহাস চর্চা হয় না৷ এখানে সরকারের মাথা না গলানোই ভালো,’’ বলেন এই গবেষক৷
এফএস/এসিবি
শরীরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা কেবল মনে নয়, শরীরেও বহন করে চলেছেন যুদ্ধের স্মৃতি৷ কারো মনে হতাশা কাজ করলেও দেশ স্বাধীন হয়েছে, বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, এটাই তাদের সান্ত্বনা৷ চলুন শুনি একাত্তরের কয়েকজন যুদ্ধাহতের গল্প৷
ছবি: AFP
মানচিত্র ও পতাকাতেই তৃপ্তি
কুমিল্লার সৈয়দ জানে আলম সাচন মুক্তিযুদ্ধ করেছেন চার নম্বর ও দুই নম্বর সেক্টরে। রাঙাউটি সীমান্তে যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের গুলি তার বাম হাতে আঘাত হানে, বিচ্যূত হয়ে যায় মেরুদণ্ডের হাড়। সেসময় ভারতে চিকিৎসা নিলেও সুস্থ হননি পুরোপুরি৷ দুটো লাঠি বা হুইলচেয়ার ছাড়া তিনি চলতে পারেন না। তবে এ নিয়ে তার আফসোস নেই। লাল-সবুজের পতাকা ও মানচিত্রই তাকে তৃপ্তি দেয়৷
ছবি: Salek Khokon
‘কিছু পাওয়ার জন্য তো যুদ্ধে যাইনি’
রাজশাহীর মো. বাকি মোল্লা যুদ্ধ করেন সাত নম্বর সেক্টরে। জুন মাসে বাসুদেবপুরে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। ডান পা হাঁটুর ওপর থেকে কেটে ফেলা হয়। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে জানতে পারেন অন্তঃসত্তা স্ত্রী মারা গেছেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুবিধা পাওয়া নিয়ে কথা শুনতে হয় বলে দুঃখ করে বলেন, ‘‘কিছু পাওয়ার জন্য তো যুদ্ধে যাইনি। কিন্তু আজ যদি এক কোটি টাকা দিয়ে আপনার একটা পা কেটে ফেলতে চাই, আপনি কী দেবেন?’’
ছবি: Salek Khokon
‘‘দেশের জন্য রক্ত দিতে পেরে গর্বিত’’
বরিশালের সার্জেন্ট মোহাম্মদ কাঞ্চন সিকদার একাত্তরে সেনাবাহিনীর সিপাহী ছিলেন। যুদ্ধ করেছেন নয় নম্বর সেক্টরে৷ ১৯৭১-এর ২২ অক্টোবর গৌরনদীর বাটাজোরে পাকিস্তানি ক্যাম্প দখলের সময় ব্রাশফায়ারে তার বাম পা মারাত্মক জখম হওয়ায় হাঁটুর ওপর থেকে কেটে ফেলতে হয়। এখন হুইল চেয়ার ও কৃত্রিম পায়ের সহায়তায় চলাফেরা করেন। দেশের জন্য রক্ত দেওয়ার সুযোগ পাওয়ায় গর্বিতএই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
ছবি: Salek Khokon
‘দেশ পাইসি, আর দুঃখ নাই’
গোপালগঞ্জের আলিউজ্জামান যুদ্ধ করেছেন আট নম্বর সেক্টরে, হেমায়েত বাহিনীর অধীনে৷ ঘাগোরে এক অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের গুলি তার মাথায় লাগায় ডান চোখ হারাতে হয়। তার ভাষায়, ‘‘গাড়ি পামু, টাকা পামু, বাড়ি পামু- এমন চিন্তা তো একাত্তরে ছিল না। চিন্তা ছিল একটাই, পাকিস্তানিগো এই দেশ থেকে তাড়াইতে হবে। দেশরে স্বাধীন করতে হবে। সেই দেশ পাইসি। আমার আর কোনো দুঃখ বা কষ্ট নাই ভাই।’’
ছবি: Salek Khokon
মনের চোখে দেশকে দেখা
ঢাকার মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার যুদ্ধ করেন দুই নম্বর সেক্টরের অধীনে ডেমরা, রামপুরা টিভি স্টেশন এলাকাসহ বিভিন্ন জায়গায়। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সাতারকুল অপারেশনে যাওয়ার প্রস্তুতির সময় কায়েদপাড়া ক্যাম্পে মাইন বিস্ফোরণে ডান হাত কনুইয়ের নীচ থেকে উড়ে যায়। মাইনের গ্যাস ঢুকে চোখ দুটিও নষ্ট হয়ে যায়। নিজ চোখে দেখতে পারেননি স্বাধীনতার লাল সূর্যটা। তবুও আফসোস নেই, তিনি দেশকে দেখেন মনের চোখ দিয়ে।
ছবি: Salek Khokon
‘একাত্তরডা মনে পইড়া যায়’
সুনামগঞ্জের মান্নান আলী ট্রেনিং নেন ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে। যুদ্ধ করেছেন পাঁচ নম্বর সেক্টরে৷ ৭ ডিসেম্বর ছাতক থানা অপারেশনে সুরমা নদীর তীরে পাকিস্তানি সেনাদের পুঁতে রাখা মাইনের আঘাতে উড়ে যায় ডান পায়ের কিছু অংশ। তবে স্বাধীন দেশই তার আনন্দ৷ ‘‘আমি প্রতিষ্ঠিত হই বা না হই, দেশ তো প্রতিষ্ঠিত হইছে, এটাই বড় পাওয়া। সবচেয়ে ভালcf লাগে ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর আসলে। তখন একাত্তরডা মনে পইড়া যায়।’’
ছবি: Salek Khokon
‘দেশ ভাল থাকলেই আমরা ভালো থাকি’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জসিম উদ্দিন শুরুতে চার নম্বর সেক্টরে গেরিলা যুদ্ধ, পরে তিন নম্বর সেক্টরে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। ২৯ নভেম্বর রামরাইল ব্রিজ অপারেশনের সময় পাকিস্তানি সেনাদের ছোঁড়া গুলি লাগে ডান হাতের কবজিতে৷ এখনও শরীরে ব্যথা অনুভব করেন। তবে স্বাধীনতা তাকে ভুলিয়ে দেয় সব দুঃখ। তার ভাষায়, ‘‘মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা দিসে দেশের জন্য, কিছু পাওয়ার জন্য না। দেশ ভাল থাকলেই আমরা ভালো থাকি।’’
ছবি: Salek Khokon
‘‘সময়ের প্রয়োজনে যুদ্ধ করেছি’’
নেত্রকোণার মো. ওসমান গণি তালুকদার যুদ্ধ করেন এগারো নম্বর সেক্টরে। ৬ ডিসেম্বর বিজয়পুর ক্যাম্প অপারেশনের সময় মাইনের আঘাতে তার ডান পা হাঁটুর ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। স্প্লিন্টারে বিদ্ধ হয় বাম পা ও ডান হাতের আঙুল। তার ভাষায়, ‘‘সময়ের প্রয়োজনে যুদ্ধ করেছি, সুবিধা পাওয়ার আশায় নয়। আমাদের জন্য এ সরকার অনেক করছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের তো রাষ্ট্রীয় কোনো প্রটোকল নাই। এটাই খারাপ লাগে।’’
ছবি: Salek Khokon
‘দায়িত্ব ছিল, করে দিছি’
ময়মনসিংহের মোহাম্মদ তারা মিয়া দুই নম্বর সেক্টর এবং ‘বিচ্ছু বাহিনী’তে গোয়েন্দার কাজও করতেন। ১২ ডিসেম্বর ঢাকার অদূরে তারাবোতে আর্টিলারির আঘাতে জখম হয় মেরুদণ্ড। ধীরে ধীরে ক্ষত বাড়তে থাকায় হুইল চেয়ারই একমাত্র ভরসা। তিনি বলেন, ‘‘স্বাধীন হইয়া দেশটা তো একা চলছে, আমি চলছি অন্যের সাহায্যে। রক্ত তো দিতেই হইবো। রক্ত ছাড়া কোনো দেশ স্বাধীন হয় নাই। রক্ত দেওয়ার সুযোগটা আমরা পাইছিলাম। দায়িত্ব ছিল, করে দিছি।’’
ছবি: Salek Khokon
‘এই মাটিতে আমাদের রক্তের গন্ধ আছে’
খুলনার লিবিও কীর্ত্তনিয়া যুদ্ধ করেন নয় নম্বর সেক্টরে৷ বিজয়ের মাত্র দুদিন আগে ১৪ ডিসেম্বর খুলনা নিউ মার্কেট এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের রকেট শেলের আঘাতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার ডান পা। বর্তমানে এ মুক্তিযোদ্ধার জীবন কাটছে শারীরিক নানা সমস্যায়। তবুও দেশ নিয়ে তৃপ্ত তিনি। বললেন, ‘‘এই মাটিতে আমাদের রক্তের গন্ধ আছে, এটা ভাবলেই মন ভরে যায়। দেশ পেয়েছি এটাই বড় কথা।’’