ইতিহাস যুগে যুগে মানুষকে একটি সত্যই শেখায়, তা হলো পরিবর্তনশীল সমাজ যেন অতীতের ভুল-ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে রাষ্ট্র ও জাতিগঠনে নতুন শক্তি সঞ্চয় করতে পারে৷ সেই লক্ষ্যে ইউরোপে নিজ অভিজ্ঞতার মধ্যে বাংলাদেশকে খুঁজেছেন লেখক৷
বিজ্ঞাপন
আমার ছোট্ট মেয়ে নীলিমা এখন সতের৷ কলেজ শেষ করে প্যারিস ইউনিভার্সিটিতে ভাষা সাহিত্য ও ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করবে তারই প্রস্তুতি নিচ্ছে সে এখন৷ সম্প্রতি ওর সাথে বিশ্বের চলমান ঘটনা ও মানবধিকার নিয়ে তুখোর আলোচনা চলছিল আমার৷ এক পর্যায়ে নীলিমা জিজ্ঞেস করে, ‘‘আচ্ছা পাপা, কোনো ঘটনা ঘটে যাওয়ার কত দিন পরে ইতিহাসে স্থান পায়, একবছর, দশবছর, একশ’বছর পরে?'' তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর দিতে পারিনি৷ তাই বলে উঠি, ‘‘আমার সাথে নাৎসিদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ‘সাক্সেনহাউজেন' দেখতে যাবি? সেখানেই পাবি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইতিহাসের বিভৎস নরহত্যার সন্ধান৷'' নীলিমা রাজি হয়ে গেল৷ পরদিনই আমরা বেরিয়ে পড়লাম বার্লিন থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরের সেই বিভৎস নাৎসি জার্মান কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে৷
সাক্সেনহাউজেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ১৯৩৬ সনের জুলাই মাসে তৈরি হয় বার্লিনের উত্তরে ওরানিয়েনবুর্গে, নাৎসি পুলিশ প্রধান হাইনরিশ হিমলারের নিজস্ব উদ্যোগে৷ বার্লিন থেকে দূরত্ব বেশি না হওয়ায় নাৎসি বাহিনীর সর্বোচ্চ নজরদারিতে ছিল এই ক্যাম্পটি৷ ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত ৯ বছরে শুধু এই সাক্সেনহাউজেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পেই দুই লক্ষ মানুষকে হত্যা করে নাৎসি বাহিনী৷ যাদেরকে হত্যা করে তাদের মাঝে ইহুদি ছাড়াও রোমা, সিন্টি, জিপসি, সমকামী এমনকি কমিউনিস্ট জার্মানরাও ছিল৷ এছাড়া প্রায় ১৩ হাজার যুদ্ধবন্দি সোভিয়েত সৈন্যও ছিল৷ তাদেরকেও গ্যাস চেম্বারে হত্যা করে পুড়িয়ে ফেলা হয়৷
হলোকস্টের স্মরণে জার্মানি যা করেছে, করছে
১৯৪৫ সালের ৮ মে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় ইউরোপে৷ এরপর থেকে হলোকস্টের শিকার হয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের স্মরণে রাখতে এই গণহত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন স্থাপনা সংরক্ষণ করে আসছে জার্মানি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Sven Hoppe
ডাখাউ
মিউনিখের কাছে ডাখাউ-এ প্রথম কনসেনট্রেশন ক্যাম্পটি স্থাপন করেছিল নাৎসিরা৷ আডল্ফ হিটলারের ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তাঁর গড়ে তোলা কুখ্যাত আধা-সামরিক বাহিনী বা এসএস-এর সদস্যরা রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের সেই ইহুদি নিধন শিবিরে ধরে নিয়ে গিয়ে প্রথমে বন্দি করতো৷ তারপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করতো তাঁদের৷ পরবর্তীতে নাৎসিদের স্থাপন করা অন্যান্য ক্যাম্পগুলো ঐ ডাখাউ-এর আদলেই তৈরি করা হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নাৎসিদের ব়্যালি গ্রাউন্ড
ন্যুরেমব্যার্গে নাৎসি আমলের সবচেয়ে বড় প্রচারণা ব়্যালিটি অনুষ্ঠিত হতো৷ প্রায় ১১ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকা একটি ‘গ্রাউন্ডে’ নাৎসিদের বার্ষিক কংগ্রেস এবং এই ব়্যালি অনুষ্ঠিত হতো, যাতে প্রায় দুই লক্ষ মানুষ অংশগ্রহণ করতেন৷ ছবিতে অসমাপ্ত কংগ্রেস হলটি দেখতে পাচ্ছেন৷ এটি বর্তমানে একটি জাদুঘর এবং ডকুমেন্টেশন সেন্টার৷
ছবি: picture-alliance/Daniel Karmann
হলোকস্টের মূল পরিকল্পনা
বার্লিনের ভানজে লেক এলাকার এই ‘ভানজে হাউস’-টিতে ইহুদি নিধনযজ্ঞের মূল পরিকল্পনা হয়েছিল৷ নাৎসি সরকার ও এসএস বাহিনীর মোট ১৫ জন সদস্য ১৯৪২ সালের ২০ জানুয়ারি এই ভবনে মিলিত হয়ে ‘ফাইনাল সলিউশন’ নামের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন৷ অর্থাৎ জার্মান নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে সব ইহুদিদের তাড়ানো ও তাঁদের শেষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয় এখানেই৷ ১৯৯২ সাল থেকে ভবনটি একটি জাদুঘরে পরিণত হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আনে ফ্রাঙ্কের স্মৃতি বিজড়িত
আনে ফ্রাঙ্ককে এখন অনেকেই চেনেন৷ তাঁর ডাইরিও পড়েছেন অনেকে৷ আনে ফ্রাঙ্ক সহ প্রায় ৫০ হাজার ইহুদিকে ব্যার্গেন-বেলজেনের এই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে হত্যা করা হয়েছিল৷
ছবি: picture alliance/Klaus Nowottnick
হিটলারকে মারার ব্যর্থ পরিকল্পনা
জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি অপশাসন প্রতিরোধে ১৯৪৪ সালের ২০ জুলাই সামরিক কর্মকর্তা কর্নেল ক্লাউস ফন স্টাউফেনব্যার্গ-এর নেতৃত্বে একটি দল হিটলারের ওপর বোমা হামলা চালায়৷ কিন্তু হত্যা পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হলে, সেই রাতেই বার্লিনের এই ‘বেন্ডলারব্লক’ ভবনে স্টাউফেনব্যার্গ ও তাঁর সঙ্গীদের গুলি করে হত্যা করা হয়৷ এই ভবনটি এখন ‘জার্মান রেসিস্টেন্স মেমোরিয়াল সেন্টার’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী হত্যা স্মরণ
হেসে রাজ্যের হাডামারে একটি হাসপাতালের প্রায় ১৫ হাজার শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীকে হত্যা করা হয়৷ এরকম ‘অক্ষমদের’ নাৎসি সরকার ‘অবাঞ্চিত’ ঘোষণা করেছিল৷ তাই তাঁদের দেহে ইনজেকশনের মাধ্যমে বিষাক্ত ওষুধ প্রবেশ করানোসহ বিভিন্ন উপায়ে হত্যা করা হয়৷ পুরো জার্মানিতে এভাবে প্রায় ৭০ হাজার প্রতিবন্ধীকে মেরে ফেলে নাৎসি বাহিনী৷ পরবর্তীতে নিহতদের স্মরণে হাডামারে একটি স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বার্লিনে স্মৃতিস্তম্ভ
হলোকস্টের স্মরণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের ৬০ বছর পর, বার্লিনের ঐতিহাসিক ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণের কাছে ‘মেমোরিয়াল টু দ্য মার্ডার্ড জিউস অফ ইউরোপ’ নামের এই স্মৃতিস্তম্ভটি স্থাপন করা হয়৷ নিহতদের স্মরণে সেখানে কংক্রিটের ২,৭১১টি স্ল্যাব বসানো হয়েছে৷ ইহুদি নিধনযজ্ঞের শিকার, এমন বহু মানুষের নামও লেখা আছে একটি জায়গায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সমকামী হত্যা স্মরণ
বার্লিনের ঐ স্মৃতিস্তম্ভ থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত ‘টিয়ারগার্টেন’ নামক একটি উদ্যানে স্থাপন করা হয়েছে চার মিটার উঁচু এই স্মৃতিফলক৷ ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে নাৎসিদের হাতে নিহত সমকামীদের স্মরণে এটি স্থাপন করা হয়৷ এই স্তম্ভের মধ্যে থাকা একটি পর্দায় চোখ রাখলে দুটি ছবি দেখা যায়৷ একটিতে চুমু খাচ্ছেন দু’জন পুরুষ, অন্যটিতে দুই নারী৷
ছবি: picture alliance/Markus C. Hurek
সিন্টি ও রোমা হত্যা স্মরণ
বার্লিনের সংসদ ভবনের ঠিক উল্টো দিকে ২০১২ সালে একটি পার্ক উদ্বোধন করা হয়৷ নাৎসি আমলে নিহত প্রায় পাঁচ লক্ষ সিন্টি ও রোমার স্মরণে এটি স্থাপন করা হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
স্মতিস্মারক হিসেবে ‘শ্টলপারশ্টাইন’
নব্বইয়ের দশকে শিল্পী গুন্টার ডেমনিগ নাৎসি নির্যাতনের শিকাররা যে সব বাড়িতে বাস করতেন, সেগুলোর সামনে রাস্তার ওপর সোনালি পাতের ছবির মতো এই স্মৃতিস্মারক বসানো শুরু করেন৷ এতে যিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন, তাঁর নাম, তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া ও মেরে ফেলার তারিখ লেখা আছে৷ ইউরোপের ১৮টি দেশে এরকম ৪৫ হাজারেরও বেশি ‘শ্টলপারশ্টাইন’ রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মিউনিখের ব্রাউন হাউস
নাৎসি আমল শেষের এত বছর পরও সে সময়ের স্মৃতি ধরে রাখতে তৎপর জার্মানি৷ তাই তো ৩০ এপ্রিল, ২০১৫-তে আরও একটি ডকুমেন্টেশন সেন্টার উদ্বোধন করতে যাচ্ছে জার্মানি৷ মিউনিখ শহরে হিটলারের অফিসের অদূরে যেখানে নাৎসিদের প্রধান কার্যালয় ছিল, সেই ব্রাউন হাউসে ‘ডকুমেন্টেশন সেন্টার ফর দ্য হিস্টরি অফ ন্যাশনাল সোশ্যালিজম’ নামের এই সেন্টারটির উদ্বোধন করা হবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Sven Hoppe
11 ছবি1 | 11
৪০০ হেক্টর এলাকা জুড়ে এই সাক্সেনহাউজেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পটি পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য এখন উন্মুক্ত এক বিশাল জাদুঘর৷ প্রায় ৬ ঘণ্টা ধরে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পটি পরিদর্শন করেও পুরো শেষ করতে পারিনি৷ একসময় নীলিমা বলছিল, ‘‘কাঠের তৈরি শতাধিক ছোট ছোট ব্যারাকে বন্দিরা থাকত, যার উচ্চতা ২.৫ মিটার, চওড়া ৪ মিটার আর ৫৪ মিটার দীর্ঘ৷ একেকটি ব্যারাকে ৪০ জন বন্দি শুধু রাতে ঘুমাত৷ সারাদিন তাদের ব্যারাকের বাইরে বন্দি শিবিরে কাজ করতে হতো৷ তাই তো ক্যাম্পটির মূল ফটকে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল, ‘‘কাজই তোমাদের মুক্ত করে৷''
আর অপেক্ষাকৃত কর্মঠ বন্দিদের প্রধান কাজ ছিল গ্যাস চেম্বারে মেরে ফেলা হাজার হাজার মানুষের লাশ মরা পোড়াবার চুল্লিতে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলা৷ বন্দিদের মাঝে অনেক ডাক্তারও ছিল৷ তাঁরা বন্দিদের নিয়ে বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাত৷ তাই এক ফলকে লেখা ‘‘এখানে এক বাভেরিয়ান ডাক্তার বন্দি ১০৫ জন শিশুর উপর পরীক্ষা চালায়৷''
বর্তমান গণতান্ত্রিক জার্মান সরকার নাৎসিদের নিগ্রহের কাহিনি ও তার দলিল তথ্য উপস্থাপন করেছে৷ তাই হাজার হাজার মানুষ এই গণহত্যার কাহিনি অনুধাবন করার জন্য এই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আসেন৷ স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীই বেশি চোখে পড়ল৷ দেখলাম, একদল স্কুল ছাত্র-ছাত্রী নরওয়ে থেকে একদিনের সফরে এসেছে৷ এই যুব সমাজ ইউরোপের ইতিহাস জানতে আর উপলব্ধি করতে অত্যন্ত আগ্রহী৷ মনে মনে শুধু ভাবলাম, আমরা কবে পারব আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যুবসমাজের জন্য তথ্যসমৃদ্ধভাবে জাদুঘরে সাজাতে!
হলোকস্টের চিত্রকলা
নাৎসি বন্দিশিবিরে মৃত্যুর দিন গোণার অবসরেও ছবি এঁকে গেছেন শিল্পীরা৷ ইসরায়েলের ইয়াদ ভাশেম সংগ্রহশালা থেকে আনা কিছু ছবি এখন প্রদর্শিত হচ্ছে বার্লিনে৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
রঙিন ‘ঘেটো’
‘ঘেটো’ বলতে বোঝায় শহরের সেই সংকীর্ণ অংশ, ইহুদিদের যেখানে থাকতে বাধ্য করা হতো৷ পোল্যান্ডের লুড্জ শহরের ঘেটোর এই ছবিটি এঁকেছিলেন ইয়োসেফ কোভনার, যিনি হলোকস্ট থেকে প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন৷ ‘হলোকস্টের চিত্রকলা: ইয়াদ ভাশেম সংগ্রহশালা থেকে ১০০টি চিত্র’, এই নাম দিয়ে বার্লিনে জার্মান ঐতিহাসিক সংগ্রহশালায় কোভনার ও অন্যান্য হলোকস্ট শিল্পীদের শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
উদ্বাস্তু
প্রদর্শনীতে যে ৫০ জন শিল্পীর ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে, তাদের মধ্যে ২৪ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন নাৎসিদের হাতে৷ নিহতদের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী ফেলিক্স নুসবাউম, যিনি ১৯৪৪ সালে আউশভিৎসে প্রাণ হারান৷ তাঁর ‘উদ্বাস্তু’ ছবিটি আঁকা হয় ব্রাসেলসে, ১৯৩৯ সালে৷ নুসবাউম ছবিটিতে নির্বাসনের অবর্ণনীয় যন্ত্রণা তুলে ধরতে চেয়েছিলেন৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
আত্মপ্রতিকৃতি
শার্লট সালোমন-এর ছবি এর আগেও জার্মানিতে প্রদর্শিত হয়েছে৷ তাঁর সাতশ’র বেশি ছবির একটি সংগ্রহে দেখা যায়, ইহুদি হিসেবে শার্লট বার্লিনে কী ধরনের জীবন কাটিয়েছিলেন৷ পরে তিনি দক্ষিণ ফ্রান্সে আশ্রয় নেন, কিন্তু ১৯৪৩ সালে তাঁকে সেখান থেকে ধরে আউশভিৎসে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং বন্দিশিবিরে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে হত্যা করা হয়৷ শার্লট তখন সন্তানসম্ভবা৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
লুকনো মেয়েটির আঁকা ছবি
নেলি টল ও তাঁর মা ইহুদি হওয়া সত্ত্বেও পোল্যান্ডের লুভভ শহরে প্রাণে বাঁচেন কেননা তাঁদের খ্রিষ্টান বন্ধুরা তাঁদের লুকিয়ে রেখেছিলেন৷ একা ঘরে আটক নেলি জলরং দিয়ে ছবি এঁকে সময় কাটাতেন, যেমন ‘মাঠের মধ্যে মেয়েরা’ নাম দেওয়া এই ছবিটি৷ ৮১ বছর বয়সি নেলি টল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বার্লিনে এসেছেন প্রদর্শনীর উদ্বোধন উপলক্ষ্যে৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
‘ব্যারাকের মাঝখানে রাস্তা’
লিও ব্রয়ার বন শহরের অধিবাসী ছিলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান কাইজারের হয়ে যুদ্ধও করেছেন৷ হিটলার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৩৪ সালে তিনি প্রথমে দ্য হেগ ও পরে ব্রাসেলসে বসবাস করেন, শিল্পী হিসেবেই, তাঁর ছবিও তখন প্রদর্শিত হয়েছে৷ ১৯৪০ সালের পর ফ্রান্সের একাধিক শিবিরে অন্তরীণ হয়ে থাকেন লিও৷ সেখানকার অভিজ্ঞতা তুলিবদ্ধ করে রেখেছেন বিভিন্ন ছবিতে৷ লিও ব্রয়ার পরলোকগমন করেন ১৯৭৫ সালে, ঐ বন শহরেই৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
দুই শিল্পী
ফরাসি বন্দিশিবিরে লিও ব্রয়ার যে আলোকচিত্রশিল্পীর সঙ্গে নানাভাবে সহযোগিতা করেছিলেন – যেমন মঞ্চসজ্জায় – তাঁর নাম ছিল কার্ল রবার্ট বোডেক৷ দু’জনে গ্রিটিংস কার্ড ইত্যাদিও সৃষ্টি করেছেন৷ বোডেক-কে ১৯৪১ সালে অপরাপর শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং শেষমেষ আউশভিৎসে পাঠানো হয়৷ সেখানেই তিনি নিহত হন ১৯৪২ সালে৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
শিল্পীর গুপ্তজীবন
বেড্রিশ ফ্রিটা থেরেজিয়েনস্টাট বন্দিশিবিরে সরকারি প্রচারপত্র ইত্যাদি তৈরির কার্যালয়ের প্রধান ছিলেন৷ অপরদিকে তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা গোপনে নাৎসি ঘেটোগুলির বিভীষিকাকে ছবিতে ধরে রেখেছেন৷ ১৯৪৪ সালে তা ফাঁস হয়ে যাবার পর ফ্রিটাকে আউশভিৎসে জীবন দিতে হয়৷ থেরেজিয়েনস্টাট বন্দিশিবির মুক্ত হবার পর সেখানকার দেয়াল ও মাটির তলা থেকে ফ্রিটার আঁকা ২০০টি ছবি পাওয়া যায়৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
মৃত্যুর পরেও বন্ধুত্ব
লিও হাস তাঁর বন্ধু ফ্রিটাকে বন্দিশিবিরের জীবন নিয়ে ছবি আঁকতে নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন৷ সাক্সেনহাউজেন বন্দিশিবিরে লিও হাস-এর ওপর নির্দেশ হয়, মিত্রশক্তিদের পাউন্ড ও ডলার নকল করার৷ যুদ্ধের পর হাস ফ্রিটার পুত্র টোমাসকে দত্তক নেন৷ এছাড়া হাস থেরেজিয়েনস্টাট বন্দিশিবিরে বেড্রিশ ফ্রিটার আরো চারশ’টি লুকনো ছবি আবিষ্কার করেছেন৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
ডাক্তারের ছদ্মবেশে শিল্পী
পাভেল ফান্টল থেরেজিয়েনস্টাটের শিল্পীমহলের সদস্য ছিলেন৷ ডাক্তার হিসেবে তিনি শিবিরের মধ্যে টাইফুস রোগীদের জন্য একটি ক্লিনিক চালাতেন৷ ফ্রিটার মতো তিনিও ধরা পড়েন, তাঁর উপর শারীরিক নিপীড়ন চালানো হয়; পরে তাঁকে আউশভিৎস বন্দিশিবিরে পাঠানো হয়৷ ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ তাঁর প্রায় ৮০টি ছবি থেরেজিয়েনস্টাট থেকে বার করে আনা সম্ভব হয়েছিল৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
কলা শিক্ষক
ইয়াকব লিপশিৎস যুদ্ধের আগে ভিলনিয়ুস-এর একটি কলা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করতেন৷ ১৯৪১ সালে তিনি কাউনুস শহরের ঘেটোয় গিয়ে বাস করতে বাধ্য হন; সেখানে তিনি অপরাপর শিল্পীদের সঙ্গে গোপনে ঘেটো জীবনের ছবি আঁকতেন৷ ১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে কাউফেরিং বন্দিশিবিরে তাঁর মৃত্যু ঘটে৷ যুদ্ধের পরে তাঁর স্ত্রী ও কন্যা কাউনুস ঘেটোয় ফিরে গিয়ে একটি কবরখানায় লুকনো ছবিগুলো উদ্ধার করেন৷ লিপশিৎস নিজেই সেগুলোকে লুকিয়ে রেখেছিলেন৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
চরম দুর্দশার মধ্যেও আত্মমর্যাদা
বার্লিনের জার্মান হিস্টোরিক্যাল মিউজিয়ামের এই প্রদর্শনী চলবে ৩রা এপ্রিল অবধি৷ ছবিগুলিতে একদিকে যেমন দেখতে পাওয়া যাবে নাৎসি বন্দিশিবিরের বিভীষিকা, অপরদিকে এই অমর শিল্পীরা যেন সেই বিভীষিকার মধ্যেই জীবনের জয়গান গেয়ে গেছেন৷ মরিৎস ম্যুলার-এর ‘শীতকালে বাড়ির ছাদে’ সেরকম একটি ছবি৷
ছবি: Collection of the Yad Vashem Art Museum, Jerusalem
11 ছবি1 | 11
ফেরার পথে নীলিমাকে আরো একবার স্মরণ করিয়ে বললাম, জানো ৯ বছরে (১৯৩৩ - ১৯৪৫) ৬০ লক্ষের ও বেশি মানুষকে ইউরোপে হত্যা করেছে এই নাৎসি বাহিনী৷ আর শুধু এই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পেই ২ লক্ষ মানুষকে গ্যাস চেম্বারে হত্যা করেছে ওরা৷ কিন্তু মা তুমি তো জানো, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৯ মাসে ৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণ দিয়েছে৷’’ দেখলাম, নীলিমা একেবারে নিশ্চুপ৷ বাসায় ফেরার পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি শুনতে চায় সে৷'’
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হয়েছে৷ কিন্তু মুক্তির সংগ্রাম একটি চলমান যুদ্ধ৷ তাই যখন স্বাধীনতা বিরোধীরা ও যুদ্ধাপরাধীরা সুযোগ পেলেই মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করার ধৃষ্টতা দেখায় ও মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা ৩০ লক্ষ থেকে কমিয়ে দেখাবার চেষ্টা করে তখন মুক্তি সংগ্রামের প্রকৃত ইতিহাস আমাদের দরকার৷ এখনো মুক্তি পায়নি আমাদের গণতন্ত্র, এখনো সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় গোড়ামিমুক্ত হয়নি বাংলাদেশ৷ এখনো মুক্তির লক্ষ্যেই যুদ্ধ চলছে মুক্তমনা মানুষদের৷ সেজন্যই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরো ‘নিরপেক্ষ চর্চা' প্রয়োজন৷
নীলিমা প্রশ্ন করলো, ‘‘আচ্ছা পাপা গণহত্যাই কি হলোকস্ট?'' বললাম, ‘‘হ্যাঁ, হলোকস্ট হলো ব্যাপক হত্যাকাণ্ড৷'' জাতিসংঘের গণহত্যাবিষয়ক কনভেনশনে গণহত্যার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, কোনো জাতি, নৃগোষ্ঠী বা ধর্মীয় সম্প্রদায়কে পুরোপুরি বা আংশিক নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে যে হত্যাকাণ্ড সম্পাদিত হয়, তা-ই গণহত্যা৷ যেমনটি ঘটেছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে৷ ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত নাৎসি বাহিনী সারা ইউরোপে ৬০ লক্ষ ইহুদি, রোমা, সিন্টি, জিপসি ও সমকামী হত্যা করেছিল৷ ১৯১৫ থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে তুরস্কের অটোমান সম্রাট ১৫ লক্ষ আর্মেনীয় হত্যা করেছিল, তেমনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মাত্র ৯ মাসে ৩০ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করেছি পাকিস্তানি স্বৈর সরকার৷ '৭১-এর হলোকস্টের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতিকে সমূলে উৎপাটন করা৷