পাঁচ মাস ধরে কাশ্মীর উপত্যকায় ইন্টারনেট সেবা বন্ধ। শুক্রবার সে বিষয়ে ঐতিহাসিক নির্দেশ দিল ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। জানানো হল, ইন্টারনেট পরিষেবা মানুষের মৌলিক অধিকার।
বিজ্ঞাপন
কাশ্মীর নিয়ে ঐতিহাসিক নির্দেশ দিল ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। আদালতের বক্তব্য, ৫ মাস ধরে যে ভাবে কাশ্মীরেইন্টারনেট বন্ধ করে রাখা হয়েছে, তা সংবিধানসম্মত নয়। সংবিধানের ১৯ নম্বর ধারায় যেখানে মৌলিক অধিকার এবং বাক স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, সেখানে ইন্টারনেট ব্যবহারের অধিকারের কথাও বলা হয়েছে। যে ভাবে এত দিন ধরে সরকার কাশ্মীরে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রেখেছে, তা মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ। সর্বোচ্চ আদালত এর পাশাপাশি বলেছে, স্বাধীন ভারতে ১৪৪ ধারার অপব্যবহার করা উচিত নয়৷ সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার লোকের আছে৷
গত বছর ৫ অগস্ট সংসদে দাঁড়িয়ে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষণা করেছিলেন কাশ্মীর থেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদ তুলে দেওয়া হবে। অর্থাৎ, এতদিন কাশ্মীর যে বিশেষ সুবিধা পেত, তা আর পাবে না। শুধু তাই নয়, জম্মু এবং কাশ্মীরকে ভেঙে দু'টি পৃথক কেন্দ্রশাসিত রাজ্য তৈরির ঘোষণাও একই সঙ্গে করা হয়। এই ঘোষণার পরেই উত্তেজনা চরমে পৌঁছয় কাশ্মীর উপত্যকায়। যার জেরে গোটা কাশ্মীর জুড়ে ১৪৪ ধারা ঘোষণা করে সরকার। বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট পরিষেবা। সংবাদপত্র থেকে শুরু করে বিবিধ গণমাধ্যমের উপরেও আংশিক নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকার জানায়, উপত্যকার নিরাপত্তার কথা ভেবেই এই সমস্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ইন্টারনেটহীন কাশ্মীরে ফিরছে পর্যটক
00:49
মাঝে কেটে গিয়েছে ৫ মাস। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ইন্টারনেট ফেরেনি কাশ্মীরে। সেখানকার মানুষ চরম অসুবিধায় বলে অভিযোগ। ব্যবসা বাণিজ্য থেকে হাসপাতাল পরিষেবা, বিঘ্ন ঘটছে সবেতেই। এমন পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। চার্লস ডিকেন্সের 'টেল অফ টু সিটিস' উদ্ধৃত করে ৩ বিচারপতির বেঞ্চ এ দিন বলে, পরাধীন সময়ে ব্রিটিশ সরকার ১৪৪ ধারা ব্যবহার করে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ দমন করার চেষ্টা করত। কিন্তু স্বাধীন দেশে সেই ধারার অপব্যবহার করা উচিত নয়। যে ভাবে ওই ধারা ব্যবহৃত হচ্ছে, তা ঠিক নয়। শুধু তাই নয়, সুপ্রিম কোর্টের আরও বক্তব্য, সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার সকলের আছে। আন্দোলনের স্বাধীনতাও আছে। ১৪৪ ধারা দিয়ে, ইন্টারনেট বন্ধ করে তা দমন করা ঠিক নয়। বস্তুত, নিরাপত্তার কারণে পাঁচ মাস ধরে কাশ্মীরের ৩ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকেও আটক করে রেখেছে সরকার।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, এই মুহূর্তে কাশ্মীরের জরুরি ক্ষেত্রগুলিতে ইন্টারনেট ফিরিয়ে আনতে হবে। বাকি ক্ষেত্রের জন্য প্রশাসনকে এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে পরিস্থিতির পর্যালোচনা করে সুপ্রিম কোর্টকে রিপোর্ট দিতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশে স্বাভাবিক ভাবেই খুশি কাশ্মীরবাসী। তবে সংশয়ও আছে। অনেকেই বলছেন, ইন্টারনেট ব্যবহার যদি মৌলিক অধিকার হয়, তাহলে সরকার ফের এক সপ্তাহ পর্যালোচনার সুযোগ পেল কেন?
কাশ্মীর নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিলেন কংগ্রেস নেতা গুলাম নবি আজাদ এবং কাশ্মীর টাইমসের সম্পাদক অনুরাধা ভাসিন। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর ডয়চে ভেলেকে অনুরাধা জানান, ''সংবিধানকে সামনে রেখে সুপ্রিম কোর্ট এ দিন যা নির্দেশ দিয়েছে, তাকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। তবে আমাদের যে মূল বক্তব্য ছিল, তার সুরাহা এখনও হয়নি। এক সপ্তাহ পর সরকারের পর্যালোচনা বিবেচনা করে আদালত কী রায় দেয়, তার দিকেই আমরা তাকিয়ে আছি।''
সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মতো আমরা আমাদের বক্তব্য সর্বোচ্চ আদালতকেই জানিয়ে দেব।
কাশ্মীরে বহুদিনের সংঘাত, বহুদিনের ক্ষত
স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্কে যেন গলার ফাঁস হয়ে রয়েছে কাশ্মীর৷ তাই কাশ্মীর সংক্রান্ত ঘটনাবলী আজ নিজেরাই ইতিহাস৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Bhat
১৯৪৭
বলা হয় দেশবিভাগের পর পাকিস্তান থেকে আগত উপজাতিক যোদ্ধারা কাশ্মীর আক্রমণ করে৷ তখন কাশ্মীরের মহারাজা ভারতের সাথে সংযোজনের চুক্তি করেন, যা থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়৷
ছবি: dapd
১৯৪৮
ভারত জাতিসংঘে কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে পর, ৪৭ ক্রমিক সংখ্যক প্রস্তাবটি গৃহীত হয়৷ ঐ প্রস্তাব অনুযায়ী গোটা কাশ্মীরে গণভোট অনুষ্ঠিত হবার কথা রয়েছে৷
ছবি: Keystone/Getty Images
১৯৪৮
কিন্তু পাকিস্তান প্রস্তাব অনুযায়ী, কাশ্মীর থেকে সৈন্যাপসারণ করতে অস্বীকার করে৷ অতঃপর কাশ্মীরকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়৷
ছবি: Getty Images
১৯৫১
ভারতীয় কাশ্মীরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ও ভারতের সঙ্গে সংযোজনকে সমর্থন করা হয়৷ অতঃপর ভারত বলে, আর গণভোট অনুষ্ঠানের কোনো প্রয়োজন নেই৷ জাতিসংঘ ও পাকিস্তানের মতে, গণভোট অনুষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Khan
১৯৫৩
কাশ্মীরের ‘প্রধানমন্ত্রী’ শেখ আব্দুল্লাহ গণভোটের সমর্থক ছিলেন ও ভারতের সঙ্গে সংযোজনকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করেন৷ ফলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ জম্মু-কাশ্মীরের নতুন সরকার ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযোজনকে পাকা করেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Khan
১৯৬২-৬৩
১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীন আকসাই দখল করে৷ তার আগের বছর পাকিস্তান কাশ্মীরের ট্রান্স কারাকোরাম ট্র্যাক্ট এলাকাটি চীনকে প্রদান করে৷
ছবি: Getty Images
১৯৬৫
কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে আবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হয়৷ কিন্তু যুদ্ধশেষে উভয় দেশের সেনা তাদের পুরোনো অবস্থানে ফিরে যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Singh
১৯৭১-৭২
আবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ৷ যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর সিমলা চুক্তি সম্পাদিত হয় ১৯৭২ সালে৷ যুদ্ধবিরতি রেখাকে লাইন অফ কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণ রেখায় পরিণত করা হয় ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিবাদ সমাধান সম্পর্কে ঐকমত্য অর্জিত হয়৷
ছবি: AP
১৯৮৪
ভারত সিয়াচেন হিমবাহ নিজ নিয়ন্ত্রণে আনার পর পাকিস্তান তা একাধিকবার দখল করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হতে পারেনি৷
ছবি: AP
১৯৮৭
জম্মু-কাশ্মীরে বিতর্কিত নির্বাচনের পর রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়৷ ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উগ্রপন্থাকে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ করে, কিন্তু পাকিস্তান সে দোষারোপ চিরকাল অস্বীকার করে এসেছে৷
ছবি: AP
১৯৯০
গওকাদল সেতুর কাছে ভারতীয় সিআরপি রক্ষীবাহিনী কাশ্মীরি বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালালে পর শতাধিক আন্দোলনকারী নিহত হন৷ প্রায় সমস্ত হিন্দু কাশ্মীর উপত্যকা ছেড়ে চলে যান৷ জম্মু-কাশ্মীরে সেনাবাহিনীকে আফসা বা আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট অনুযায়ী বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করা হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images/Tauseef Mustafa
১৯৯৯
কাশ্মীর ভ্যালিতে গোটা নব্বই-এর দশক ধরে অশান্তি চলে৷ ১৯৯৯ সালে আবার ভারত-পাকিস্তানের লড়াই হয়, এবার কারগিলে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
২০০১-২০০৮
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলাপ-আলোচনার যাবতীয় প্রচেষ্টা প্রথমে নতুন দিল্লির সংসদ ভবন ও পরে মুম্বই হামলার ফলে ব্যর্থ হয়৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/F. Khan
২০১০
ভারতীয় সেনার গুলি লেগে এক বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর পর কাশ্মীর ভ্যালি উত্তেজনায় ফেটে পড়ে৷ বিক্ষোভ চলে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে, প্রাণ হারান অন্তত ১০০ জন৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/U. Asif
২০১৩
সংসদ ভবনের উপর হামলার মুখ্য অপরাধী আফজল গুরুকে ফাঁসি দেওয়া হয়৷ এর পর যে বিক্ষোভ চলে, তা-তে দু’জন প্রাণ হারায়৷ এই বছরই ভারত আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় মিলিত হয়ে উত্তেজনা উপশমের কথা বলেন৷
ছবি: Reuters
২০১৪
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ উপস্থিত থাকেন৷ কিন্তু এর পর নতুন দিল্লিতে পাকিস্তানি হাই কমিশনার কাশ্মীরি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে মিলিত হওয়ায় ভারত আলাপ-আলোচনা স্থগিত রাখে৷
ছবি: Reuters
২০১৬
আজাদ কাশ্মীর ভিত্তিক হিজবুল মুজাহিদীন-এর অধিনায়ক বুরহান ওয়ানি-র মৃত্যুর পর কাশ্মীরে স্বাধীনতা সমর্থকরা আবার পথে নেমেছেন৷ এই আন্দোলনে এ পর্যন্ত অন্তত ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে ও বিক্ষোভ অব্যাহত আছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R.S.Hussain
২০১৯
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামা সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ)-এর গাড়িবহরে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে৷ এতে ৪২ জওয়ান নিহত হন৷ বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন জৈশ-ই-মোহাম্মদ হামলার দায় স্বীকার করেছে৷ এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সীমান্তের ভেতরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালায় ভারতীয় বিমান বাহিনী৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Wire/P. Kumar Verma
২০১৯
ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নং ধারা অনুযায়ী, জম্মু ও কাশ্মীরের কাছে কিছু বিশেষ অধিকার ছিল। ৫ আগস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ৩৭০ ধারাটি অবসানের দাবি তোলেন৷ বিল পাস হয়। একই দিনে তাতে সই করেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ৷ ফলে, কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা' বাতিল হয়। তাছাড়া মোদী সরকারের সিদ্ধান্তের ফলে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের মর্যাদা হারায়। জম্মু ও কাশ্মীর ও লাদাখ নামে দুইটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠিত হয়।