আবার নতুন করে কলকাতায় ‘মি টু' ঝড়৷ ফেসবুক তোলপাড় জোড়া অভিযোগে৷ এবারে বিতর্কে দুই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব৷
বিজ্ঞাপন
কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় দু'টি নারীর কথা৷ তাদের মতে, নাট্য পরিচালক ও অধ্যাপক সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় নাটকের মহড়ার অছিলায় অশালীন আচরণ করেন তাদের সাথে৷ উত্তরে একটি সংবাদসংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সুদীপ্ত জানান, যে যা ঘটেছিল তা সম্মতিবহির্ভূত ছিল না৷ এবং আসলেই এই আচরণ একটি বিশেষ ধরনের অভিনয়-পন্থা৷ সুদীপ্ত আরো বলেন যে এই বিশেষ পন্থা তিনি শিখেছিলেন তার নাট্যগুরু প্রখ্যাত অভিনেতা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে৷ অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘদিনের নাট্যসঙ্গী ও শিষ্যা মায়া ঘোষ যদিও এমন পন্থার সত্যতা নাকচ করে দেন৷ একই মত অজিতেশের অন্যান্য সঙ্গীদেরও৷ শেষ পাওয়া খবর, সুদীপ্তকে একটি এফআইআরের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ বর্তমানে তিনি পুলিশি হেফাজতে রয়েছেন৷
দ্বিতীয় ঘটনাটির কেন্দ্রে বিখ্যাত বাংলা ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি'র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য রঞ্জন ঘোষালের নাম৷ ১৬ বছর বয়েসি এক কিশোরী ফেসবুক মেসেঞ্জারে তার পাঠানো অশালীন মেসেজের স্ক্রিনশট সম্প্রতি প্রকাশ করেন সোশাল মিডিয়ায়৷ এরপর নতুন করে আলোচনায় উঠে আসে ১৫ বছর আগে রঞ্জন ঘোষালের বিরুদ্ধে ওঠা আরেকটি অভিযোগ৷ প্রথম অভিযোগকারিণী দেবলীনা মুখোপাধ্যায়, যিনি ঘটনাচক্রে লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কন্যা৷ দেবলীনা জানান যে রঞ্জনের সাথে দীর্ঘ পারিবারিক বন্ধুতা ছিল তাদের, এমনকি রঞ্জনকে ‘কাকু' সম্বোধন করতেন তিনি৷ ২০০৪ সালে এই ঘটনার প্রেক্ষিতে আদালতের দ্বারস্থও হয়েছিলেন তিনি৷ আনন্দবাজার পত্রিকাকে বলেন তিনি, ‘‘ সেই সময় তো সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না৷ কাউকে পাশে পাইনি৷ আমার চেনা এক জনের সঙ্গেও এমনটা করেছিলেন উনি৷
‘মি-টু’ ঝড়ে বেকায়দায় যারা
ভারতে ‘মি-টু’ আন্দোলনের জোয়ার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে৷ ইতিমধ্যে অভিযুক্তের তালিকায় উঠে এসেছে অন্তত ৩৭ জন ক্ষমতাশালী ব্যক্তির নাম৷ তেমন কয়েকজনের কথাই থাকছে এই ছবিঘরে৷
ছবি: Facebook/S. Mukherji
যেখান থেকে শুরু: নানা পাটেকর
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে সাবেক মিস ইন্ডিয়া ও অভিনেত্রী তনুশ্রী দত্ত তুলে আনেন ২০০৮ সালের ঘটনা, যার ভিত্তিতে বর্তমানে ভারতব্যাপী ঝড় তুলেছে ‘মি-টু’ আন্দোলন৷ তনুশ্রী জানান, সে বছর ‘হর্ণ ওকে প্লিজ’ ছবির সেটে অভিনেতা নানা পাটেকার তাঁকে যৌনহেনস্থা করেছিলেন৷ তবে সংবাদমাধ্যমের কাছে বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন পাটেকর৷ আপাতত দুজনেই আইনি লড়াইয়ে নেমেছেন৷
ছবি: Getty Images/AFP
অভিযোগের তির বিকাশের দিকে
প্রযোজনা সংস্থা ফ্যান্টম ফিল্মসের এক প্রাক্তন কর্মচারী গত বছর পরিচালক বিকাশ বেহেলের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন৷ বেহেলের দুই সহযোগী পরিচালক, অনুরাগ কাশ্যপ ও বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানে অভিযোগকারী মহিলাকে সমর্থন করে ফ্যান্টম ফিল্মস ভেঙে দেন৷ পরবর্তীতে অভিনেত্রী কঙ্গনা রনৌতও বেহেলের বিরুদ্ধে হেনস্থার অভিযোগ করেন৷ বিকাশের মতে, পুরো বিষয়টি পেশাগত ঈর্ষার কারনে কাশ্যপ ও মোতওয়ানের সাজানো৷
ছবি: Imago/Hindustan Times
বলিউডের ‘বাবুজী’ আলোক নাথ
লেখক-প্রযোজক বিনতা নন্দ’র দাবি, ১৯ বছর আগে অভিনেতা আলোক নাথ তাঁর সম্ভ্রমহানির চেষ্টা করেন৷ বিনতা ছাড়াও অভিনেত্রী সন্ধ্যা মৃদুল, আমাইরা দস্তুর, নবনীত নিশান ও কন্ঠশিল্পী সোনা মহাপাত্র’র মতো সুপরিচিত ব্যক্তিত্বরাও তাঁদের হয়রানির অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেন৷ ‘আদর্শ’ পিতার চরিত্রে খ্যাত আলোক তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘‘আজকের জগতে, যা-ই হোক না কেন, একজন মহিলার কথাতেই সবাই কান দেয়৷’’
ছবি: Getty Images/AFP
সুভাষ ঘাইয়ের কীর্তি
সম্প্রতি, টিভি অভিনেত্রী ও ভারতীয় মডেল কেট শর্মা বিশিষ্ট পরিচালক সুভাষ ঘাইয়ের বিরুদ্ধে জোর করে চুম্বন করার অভিযোগ তুলেছেন৷ যদিও সুভাষ ঘাই তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন৷কেট শর্মা পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
কেচ্ছায় জর্জরিত সাজিদ খান
বলিউডের আরেক পরিচালক, সাজিদ খানের বিরুদ্ধে অভিনেত্রী সালোনি চোপড়া, সিমরান সুরি ও সাংবাদিক করিশমা উপাধ্যায়সহ একাধিক নারীর যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে৷ সামনে এসেছে ‘কাস্টিং কাউচ’-এর নোংরা চিত্র৷ সাজিদের বোন চিত্র পরিচালক ফারাহ খান মনে করেন, তাঁর ভাইয়ের বিরুদ্ধে আনা যৌন হয়রানির অভিযোগের খবরে তিনি দুঃখিত এবং অভিযোগগুলি সত্য প্রমাণিত হলে সাজিদের উচিত আত্মসমর্পণ করা৷
ছবি: Imago/Hindustan Times
‘অ-শালীন’ রজত কাপূর
দু’জন নারী যৌন হয়রানি ও বেসামাল আচরণের অভিযোগ তুলেছেন এই বিখ্যাত মঞ্চ ও চলচ্চিত্র অভিনেতার বিরুদ্ধে৷ এর পরিপ্রেক্ষিতে টুইটারে পোস্ট করে ক্ষমা চেয়ে কাপূর দাবি করেন, তিনি সারা জীবন একজন ভদ্র ও শালীন মানুষ হওয়ার চেষ্টা করে এসেছেন৷
ছবি: imago/Hindustan Times/S. Bate
গানের জগতে ‘মি-টু’, অভিযুক্ত কৈলাশ খের
একটি সাক্ষাৎকার চলাকালীন এক নারী সাংবাদিকের সাথে আপত্তিকর আচরণ করার অভিযোগ ওঠে এই খ্যাতনামা কন্ঠশিল্পীর বিরুদ্ধে৷ এই অভিযোগ জানাজানি হবার পর আরেক গায়িকা সোনা মহাপাত্রও দাবি করেন, কৈলাশ তাঁর সাথেও আপত্তিকর আচরণ করেছেন৷ কৈলাশের অবশ্য দাবি, এমন কোনো ঘটনা তাঁর স্মরণে নেই৷ তবে তিনি এ-ও বলেন, অনিচ্ছাকৃতভাবে কিছু ভুল হয়ে থাকলে তিনি ক্ষমাপ্রার্থী৷
ছবি: AP
আবার বিতর্কে অভিজিৎ ভট্টাচার্য
‘মি-টু’র দাপটে উঠে এলো আরেক গায়ক অভিজিতের নাম৷ বলিউডের এই গায়কের বিরুদ্ধে রয়েছে একটি পাবে একজন বিমানবালাকে হয়রানির অভিযোগ৷ অভিজিৎ ভট্টাচার্য তাঁর বিরুদ্ধে সব অভিযোগ অস্বীকার করে মন্তব্য করেছেন, ‘‘শুধুমাত্র ‘মোটা ও কুশ্রী’ মেয়েরাই পুরুষদের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগ করছে৷’’ তাঁর এই মন্তব্য নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে৷ বিতর্কে জড়ানো অবশ্য অভিজিতের জন্য নতুন কোনো ঘটনা নয়৷
ছবি: Imago/Indiapicture
নগ্ন ছবি পাঠানোর অভিযোগ
নতুন প্রজন্মের আলোচিত অভিনেতা ও কমেডিয়ান উৎসব চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে উঠেছে মহিলাদের কাছে নিজের নগ্ন ছবি পাঠানো ও বিনিময়ে নগ্ন ছবি চাওয়ার অভিযোগ৷ জনপ্রিয় কমেডি দল এআইবি’র নিয়মিত অভিনেতা উৎসব তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের প্রেক্ষিতে টুইটারে ক্ষমা চেয়েছেন৷ ইতিমধ্যে উত্সবের সব ভিডিও এআইবি তাদের চ্যানেল থেকে মুছে দিয়েছে৷
ছবি: Twitter/U. Chakraborty
এবার ফাঁসলেন বিনোদ দুয়া
চিত্রনির্মাতা নিষ্ঠা জৈন পদ্মশ্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, বিনোদ দুয়াকে অভব্য ব্যবহার ও কর্মক্ষেত্রে হয়রানির দায়ে অভিযুক্ত করেছেন৷ এ বিষয়ে দুয়া কোনো মন্তব্য না করলেও তাঁর কন্যা কমেডিয়ান মল্লিকা দুয়া বাবার পাশে দাঁড়ান৷ বিনোদ দুয়া অনলাইন পোর্টাল ওয়্যার-এর সাংবাদিক৷ওয়্যার এক বিবৃতিতে জানায়, ‘‘আমাদের অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি (আইসিসি) অভিযোগগুলি সম্পর্কে সচেতন৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/P. Singh
অভিযুক্ত সাবেক মন্ত্রী এম জে আকবর
সাংবাদিক প্রিয়া রামানি, গজলা ওয়াহাব, সুতপা পল ও তুষিতা প্যাটেলসহ বেশ কয়েকজন যৌনহেনস্থার অভিযোগ করেন সাংবাদিক ও সম্প্রতি পদত্যাগ করা মন্ত্রী এম জে আকবরের বিরুদ্ধে৷ ইতিমধ্যে তিনি প্রিয়া রামানির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছেন৷ আকবরের হয়ে ভারতের ৯৭জন আইনজীবী লড়ছেন বলে জানা গেছে৷ তবে ২০ জন নারী সাংবাদিক জানিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের সহকর্মীদের হয়ে আদালতে সাক্ষ্য দেবেন৷
ছবি: IANS
নারীও অভিযুক্ত
সম্মতি ছাড়াই কমেডিয়ান কানিজ সুরকা-কে মঞ্চে চুম্বনের চেষ্টা করেছিলেন আরেক কমেডিয়ান অদিতি মিত্তল৷ এমনই অভিযোগ কানিজের৷ যদিও অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পর অদিতি কানিজের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেন, আসলে তিনি আঘাত দিতে চাননি৷
ছবি: Getty Images/AFP/N. Cassanelli
বলিউডের পর টলিউডেও ‘মি-টু’: সৃজিত মুখার্জী
অভিযোগ উঠেছে জনপ্রিয় পরিচালক সৃজিত মুখার্জির বিরুদ্ধে৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় একাধিক নারী লিখেছেন সৃজিতের বিরুদ্ধে৷ সোশ্যাল মিডিয়াতেই এসবের জবাব দিয়েছেন সৃজিত৷
ছবি: Facebook/S. Mukherji
13 ছবি1 | 13
তিনিও চেপে যান৷ রঞ্জনকাকুর পরিবার ভেঙে যাবে, এমনটাই বোঝানো হয়েছিল আমাকে৷'' সরকারি আইনজীবী বনাম রঞ্জনের নামী আইনজীবীর সঙ্গে পেরে ওঠেননি তিনি৷ এবং পরে মামলা তুলে নিতেও বাধ্য হন৷ যদিও রঞ্জন ঘোষালকে লিখিত ক্ষমা চাইতে হয়েছিল সেই সময়৷ ১৬ বছর বয়েসি কিশোরীর পোস্ট ছড়িয়ে পড়ার পরই ফেসবুকে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেন দেবলীনা৷ তাঁর মতে, রঞ্জন একজন ‘সিরিয়াল অফেন্ডার'৷
কিন্তু সুদীপ্তর মতো অভিযোগ অস্বীকার করেননি রঞ্জন৷ ফেসবুকেই একটি পোস্টে তিনি লেখেন, ‘‘আমি জানি আমার কথায় এবং আচরণে কারুর কারুর ব্যক্তিগত সীমারেখা (personal space) লঙ্ঘন করেছি, আমি এখন তার জন্য অনুতপ্ত ও নিঃশর্তে ক্ষমাপ্রার্থী৷ আমার নিজেকে শোধরাতে হবে৷ কেউ যেন কখনো আমার সান্নিধ্যে এসে নিরাপত্তাহীনতা বোধ না করে, সে বিষয়ে এখন থেকে বিশেষভাবে যত্নবান থাকব৷''
কিন্তু আসলেই কি রঞ্জন বা সুদীপ্তর আচরণের মধ্যে কোনো নীতিগত পার্থক্য রয়েছে? নাকি দুই ক্ষেত্রেই কাজ করছে সমকালীন সমাজের কিছু নির্দিষ্ট ধারা বা ট্রেন্ড?
এবারে কি কি শিখলো কলকাতা?
রঞ্জন ঘোষাল ও সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় দুজনেই সমাজের শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত অংশের মানুষ৷ দুজনেই বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের অঙ্গ হয়ে কাজ করেছেন কয়েক দশক ধরে৷ সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়ের সাথে পড়াশোনার খাতিরে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, নারী স্বাধীনতা, সামাজিক কাঠামো ও বাংলায় যৌনাচারণের পরিমিতি সম্পর্কে তিনি জনসাধারনের চেয়ে বেশ অনেকটাই বেশি অ্যাকাডেমিক জ্ঞান রাখেন৷ শুধু তাই নয়, তার গোটা কেরিয়ারের সাথে যেভাবে একাত্ম হয়েছে রিচার্ড শেখনার বা জাক দেরিদার মতো ‘মুক্তমনা' স্কলারদের নাম৷
বলিউডে যৌন হয়রানির অভিযোগ, ভারত জুড়ে তোলপাড়
সাবেক মিস ইন্ডিয়া থেকে বলিউড নায়িকা হলেও বহুদিন শিরোনামে ছিলেন না তনুশ্রী দত্ত৷ তবে দশ বছর আগে নানা পাটেকরের বিরুদ্ধে করা যৌন হয়রানির অভিযোগ ঘিরে এখন তোলপাড় চলছে ভারতে৷তনুশ্রীও ফিরেছেন শিরোনামে৷ বিস্তারিত এই ছবিঘরে৷
ছবি: imago/Hindustan Times/S. Bate
দশ বছর আগে...
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তনুশ্রী তুলে আনেন ২০০৮ সালের সেই ঘটনা৷ জানান, সে বছর ‘হর্ণ ওকে প্লিজ’ ছবির সেটে অভিনেতা নানা পাটেকার তাঁকে যৌন হেনস্থা করেছিলেন৷পরে সেই ছবি থেকে তিনি সরে দাঁড়ান৷ তাঁর বদলে নেওয়া হয় রাখি সাওয়ান্তকে৷ হেনস্থার বিষয়ে চলচ্চিত্র ও টিভি প্রোগ্রাম প্রযোজক সংস্থা, ‘সিন্টা’-র কাছে অভিযোগ করেও কোনো বিচার পাননি৷ এর আগে ২০১৩ সালেও এক সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে কথা বলেছিলেন তিনি৷
ছবি: Youtube/ABP News
কে এই তনুশ্রী দত্ত?
২০০৪ সালের মিস ইন্ডিয়া তনুশ্রী দত্ত একজন ভারতীয় মডেল এবং অভিনেত্রী৷ ‘চকলেট’ ও ‘আশিক বানায়া আপনে’-র মতো ছবিতে অভিনয় করে নজর কেড়েছিলেন তিনি৷ ২০০৪ সালের মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় দশজন ফাইনালিস্টের মধ্যেও ছিলেন তিনি৷ ২০০৮ সালের ঘটনার পর তনুশ্রী হতাশাগ্রস্ত হয়ে বলিউড থেকে বিদায় নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান৷
ছবি: Getty Images/AFP
দশ বছর পর...
যৌন হেনস্থাবিরোধী ‘মি টু’ আন্দোলনের ঢেউ অবশেষে ভারতেও লেগেছে৷ সম্প্রতি তনুশ্রী ভারতে ফিরে এসে জনসমক্ষে নানা পাটেকারকে অভিযুক্ত করেন, যার ফলে শুরু হয় তোলপাড়৷ দশ বছর আগে যে ঘটনায় কেউ কান দেয়নি, তা নিয়েই শুরু হয় তুমুল আলোচনা৷ দশ বছর আগে তনুশ্রীর বাবা যে নানা পাটেকার, পরিচালক রাকেশ সারং, কোরিওগ্রাফার গণেশ আচার্য ও প্রযোজক সামি সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে এফআইআর করেছিলেন – সেই সত্যও বেরিয়ে আসে৷
ছবি: Getty Images/AFP
মন্তব্যহীন ‘বিগ বি’
এক অনুষ্ঠানে বলিউড তারকা অমিতাভ বচ্চনের কাছে নানা পাটেকারের বিরুদ্ধে ওঠা যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে মন্তব্য করতে বলে প্রসঙ্গটি তিনি বেমালুম এড়িয়ে যান৷ তিনি বলেন, ‘‘ আমার নাম তনুশ্রী দত্ত বা নানা পাটেকার কোনটিই নয়, এ বিষয়ে আমি কেন মন্তব্য করব?’’
ছবি: picture alliance/ZUMA Press/India Today
সলমানও এড়িয়ে গেলেন
বলিউড সুপারস্টার সলমান খানও এই ঘটনা সম্পর্কে মন্তব্য করতে রাজি হননি৷ তাঁর মন্তব্য ছিল, ‘‘আমার এ বিষয়ে ভালো জানা নেই৷ গোটা বিষয়টি এখনও বুঝে না উঠলেও আমি নিশ্চিত যে আইনি পথেই বিষয়টি চলবে৷’’
ছবি: DW/S. Zain
আমির সন্দিহান!
জনপ্রিয় অভিনেতা আমির খানও ঘটনাটি সম্পর্কে সরাসরি মন্তব্য না করে সমালোচিত৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি মনে করি না যে, আমার এখানে কিছু বলা ঠিক হবে৷ আপাতত তদন্ত করে দেখা উচিত সত্যিই এই ধরনের ঘটনা আদৌ ঘটেছে কি না৷’’
ছবি: picture-alliance/AP Photo/R. Kakade
ভিডিও কী বলে?
ইতিমধ্যে ২০০৮ সালে অভিনেত্রী তনুশ্রী দত্তের গাড়ি ভাঙচুরের দৃশ্যসম্বলিত একটি ভিডিও বিভিন্ন মাধ্যমে ঘোরাফেরা করছে৷ ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, কিছু লোক তনুশ্রীর গাড়ির উপর হামলা করছে৷ তনুশ্রী মনে করেন, নানা পাটেকারের হয়ে একটি রাজনৈতিক দলের গুন্ডারা এ হামলা চালিয়েছিল৷ তাঁর মতে, অভব্য আচরণের প্রতিবাদে তিনি শুটিং স্পট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর নানা পাটেকারই মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনার ওই সদস্যদের খবর দিয়েছিলেন৷
ছবি: Youtube/ABP News
নানার পাল্টা জবাব
তনুশ্রী দত্তের নির্যাতনের অভিযোগের বিষয়ে সংবাদমাধ্যমকে নানা পাটেকার বলেন, ‘‘১০ বছর আগে যা সত্য ছিল আজও তাই আছে ও আগামীতেও তাই থাকবে৷’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘আমার আইনজীবী আমাকে বিষয়টি সম্পর্কে কথা না বলার পরামর্শ দিয়েছেন বলেই আমি নীরব৷ নইলে, প্রেসে কথা বলার কোনো সমস্যা আমার নেই৷’’ নানা পাটেকরের আইনজীবী ইতিমধ্যে তনুশ্রীকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন৷
ছবি: Gety Images/AFP
তনুশ্রীর পাশে সোহা আলি খান
অভিনেত্রী সোহা আলি খান তনুশ্রীর পাশে দাঁড়াতে গিয়ে বলেন,‘‘ভারতের মতো দেশে নারীর সঙ্গে প্রতিদিনই কিছু-না-কিছু ঘটতে থাকে৷’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘এমন ঘটনার বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াতে অনেক সাহস লাগে, তাই আমি মনে করি নারীদের এই বিষয়ে সমর্থন জানাতে হবে, উৎসাহিত করতে হবে।’’ সোহা জানান, তিনি তনুশ্রী বা যৌন হয়রানির শিকার এমন যে কোনো মহিলার পাশে আছেন৷
ছবি: UNI
ফারহানও তনুশ্রীর পাশে
তনুশ্রীর সাহসের প্রশংসা করে চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা ফারহান আখতার বলেছেন, ‘‘যদি কোনো নারী নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলতে চায়, তবে আমাদের তা শোনা অন্তত উচিত৷ আমরা তার কথা শোনার আগেই ঘোষণা করছি যে, অভিনেত্রী হিসেবে তাঁর কেরিয়ার শেষ হওয়ার কারণে তিনি মিডিয়ার আলোচনায় আসতে চান!’’ অভিযোগ তদন্তের দাবিও জানিয়েছেন তিনি৷ নেহা ধুপিয়া, অর্জুন কাপুরের মতো তারকারাও তনুশ্রীকে সমর্থন জানিয়েছেন৷
ছবি: AP
দায় এড়ানোর কৌশল?
২০০৮ সালে চলচ্চিত্র ও টিভি অনুষ্ঠান প্রযোজক অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্বে থাকা সাবেক সেন্সর বোর্ডপ্রধান পহলাজ নিহলানি পুরো বিষয়টিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে দাবি করেছেন, তিনি শুধু শুটিং সেটে মনোমালিন্য সম্পর্কে জানতেন৷ তনুশ্রী আগে কখনো হয়রানি সম্পর্কে কিছু বলেননি বা না পাটেকারের নাম কোথাও উল্লেখ করেননি বলেও দাবি তাঁর। অথচ দশ বছর আগেই এফআইআর করেছিলেন তনুশ্রী৷
ছবি: Getty Images/AFP/STR
তনুশ্রীর জবাব
মহারাষ্ট্র রাজ্য মহিলা কমিশনে ইতিমধ্যে নানা পাটেকার, রাকেশ সারং, গণেশ আচার্য ও সামি সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন তনুশ্রী৷ ১০ বছর আগে রাজনৈতিক হুমকি ও সহিংস হামলার জন্য মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনার কর্মীদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ করেন তিনি৷
ছবি: Getty Images/AFP/STR
আরো কেচ্ছা বেরোলো
এই ঘটনাবলীর আলোকে, 'মি টু' আন্দোলন ভারতে যেন নতুন প্রাণ পেয়েছে। রজত কাপুর ও বিকাশ বেহলের মতো তারকাদের বিরুদ্ধেও নতুন ও পুরোনো অভিযোগ খবরে উঠে আসছে। এখন দেখার এটাই যে, আন্দোলনটি আদৌ সমাজে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করতে সক্ষম হয় কিনা।
ছবি: imago/Hindustan Times/S. Bate
13 ছবি1 | 13
তারপরেও কেন এমন অভিযোগ? এই অভিযোগের ধারা কি আসলেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা? নাকি সংস্কৃতি জগতের ভেতরে প্রচলিত কোনো ট্রেন্ডের বহিপ্রকাশ?
এখানে আসলে কাজ করছে খুব সহজ দু'টি বিষয়৷ প্রথম, বর্তমানে সংস্কৃতির পরিসর ও ‘অবাধ' যৌনাচারের মধ্যে রয়েছে একটি সমান্তরাল যোগসূত্র, তা যতই জাঁদরেল ব্যক্তিত্বরা বিষয়টি এড়িয়ে যান না কেন৷ ভারতে, এমনকি বাংলাতেও, ‘কাস্টিং কাউচ' নামের একটি প্রথা প্রচলিত আছে, যেখানে যৌন আনুকূল্যকে বেশ বহু বছর ধরেই পরিণত করা হয়েছে একটি স্বাভাবিক বাস্তবিকতায়৷ ফলে, ‘কাজ পেতে গেলে বা কাজ শিখতে গেলে কিছু কিছু যৌন ইঙ্গিতকে প্রশ্রয় দিতেই হবে', এই ধারণা বাস্তবে পুরোপুরি ফেলনা নয় মোটেই৷ সংস্কৃতি জগতকে যদি পুরোদস্তুর পেশাদারিত্বের জায়গায় নিয়ে যেতে হয়, তবে অন্যান্য কর্মক্ষেত্রের মতো সেখানেও নিশ্চিত করতে হবে কিছু সীমারেখা৷ প্রয়োজনে আনতে হবে ‘বিশাখা গাইডলাইনস'র মতো নির্দিষ্ট আইনও৷
দ্বিতীয়ত, সোশাল মিডিয়া ও পরবর্তীতে মিডিয়া ট্রায়ালের রীতি গত কয়েক বছরে বর্তমান জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে৷ ফলে, অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ, ক্ষমা প্রার্থনা বা বিচারকার্যও হয়ে পড়েছে আন্তর্জালনির্ভর, যা আরো বেশি করে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে, অভিযোগ তোলা বা দায় এড়ানো কোনোটাই এখন আর আইননির্ভর নয়৷ যৌন হয়রানির মতো গুরুতর অভিযোগের উত্তরে দুই-এক মাসের জন্য ফেসবুক প্রোফাইল ‘ডিএক্টিভেট' করে দেওয়াই এখন দ্রুত সমাধান৷ বা নিদেনপক্ষে এক-দুটো ক্ষমাপ্রার্থী স্ট্যাটাস, ব্যস৷
হয়তো ২০০৪ সালে সোশাল মিডিয়ার এত জোর ছিলনা বলেই রঞ্জন ঘোষাল সেই যাত্রায় আইনী মারপ্যাঁচে পড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, যা এইবারের মতো তার কপালে নেই এখন পর্যন্ত৷ ফেসবুকে ক্ষমা চাওয়া হয়ে গেছে তার৷ উল্টোদিকে, অন্য অভিযোগকারিণী আইনের ওপর আস্থা রেখেছিল বলেই হয়ত সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় আজ কারাবন্দি৷
আমার মতে, কলকাতায় এই দ্বিতীয় দফার ‘মিটু' ঝড় থেকে উঠুক দু'টি দাবি৷ এক, সংস্কৃতি জগতের আনাচে কানাচে গজিয়ে ওঠা এই ‘কাস্টিং কাউচ' ও সীমালঙ্ঘনের প্রতি সহনশীলতা অবিলম্বে বন্ধ হোক৷ বন্ধ হোক অল্পবয়েসি সংস্কৃতিকর্মীদের অসহায়ত্ব ও আর্থিক দুর্বলতার সুযোগে তাদের হেনস্থার স্বাভাবিকীকরণ৷ দুই, ফেসবুকে লেখা হোক হয়রানির জবানবন্দি, কিন্তু আইনের সাথে এক পর্যায়ে তাকে না রেখে৷ যৌন হয়রানিকে মোকাবিলা করতে আইনই হোক মূল হাতিয়ার, দিনে ১৫০ রুপিতে হাতের মুঠোয় পাওয়া এক জিবি ইন্টারনেট নয়৷