সুলাওয়েসি দ্বীপে ধ্বংসস্তূপ যত পরিষ্কার করা হচ্ছে, উদ্ধার হচ্ছে মরদেহ, বেড়ে চলেছে মৃতের সংখ্যা৷ মঙ্গলবার দেশটির দুর্যোগ মোকাবিলা সংস্থা জানিয়েছে, এখন এ সংখ্যা পৌঁছেছে ১,২৩৪ জনে৷
বিজ্ঞাপন
সংস্থার মুখপাত্র সুতোপো পুরুও নুগ্রোহো জানিয়েছেন, এখনো উদ্ধারকাজ পুরোপুরি শেষ হতে অনেক সময় লাগবে৷ ভূমিকম্প ও সুনামির আঘাতে গুরুতর আহত ৭৯৯ জন এখনো সংকটাপন্ন অবস্থায় আছেন বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি৷
তাছাড়া সিগি ও বালারোয়া অঞ্চলে মৃত্যুর সংখ্যা এখনো গণনা করা হয়নি৷ ফলে এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলেও জানানো হয়েছে সংস্থার পক্ষ থেকে৷ শুক্রবার ৭ দশমিক ৫ মাত্রার শক্তিশালীর পর সুনামি আঘাত হানে সুলাওয়েসি দ্বীপে৷ এরপর থেকে এখনো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে অনেক এলাকা৷
উদ্ধারকাজ যাতে আরো দ্রুত শেষ করা যায়, সেজন্য অন্যান্য এলাকা থেকে আরো বেশি সংখ্যক উদ্ধারকর্মীকে সুলাওয়েসি দ্বীপে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো৷ পুলিশ এবং সেনাবাহিনীকেও এরই মধ্যে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট৷
বাড়ছে বিক্ষোভ
পালুতে সহজে পৌঁছানো গেলেও দ্বীপের ডোঙ্গালা ও অন্য অনেক এলাকায় এখনও ঠিকমতো উদ্ধারকাজ চালাতে পারছে না সরকার৷ ত্রাণ, খাবার, ওষুধ, জ্বালানির সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে৷
ইন্দোনেশিয়া: এক সুনামি-বিধ্বস্ত জনপদ
ভূমিকম্পের পর ভয়াবহ সুনামিতে বিধ্বস্ত হয়েছে পর্যটন দ্বীপ সুলাওয়েসি৷ এরই মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে আট শতাধিক মরদেহ, বিচ্ছিন্ন হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিধ্বস্ত হয়েছে ঘরবাড়ি, দেখা দিয়েছে খাদ্য ও চিকিৎসা সংকট৷
ছবি: BNPB
ধ্বংসপ্রাপ্ত সেতু
৭ দশমিক ৫ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে নিহত হয়েছেন শত শত মানুষ৷ উদ্ধারকাজ পুরোপুরি শেষ হলে এ সংখ্যা আরো বাড়বে বলে আশংকা কর্তৃপক্ষের৷ জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কায় ভেঙে পড়েছে পালুর ৩০০ মিটার দীর্ঘ সেতু৷
ছবি: BNPB
বিধ্বস্ত মসজিদ
শুক্রবার যখন পালুতে সুনামি আঘাত করে, তখন মসজিদে নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মুসল্লিরা৷ কর্তৃপক্ষ বলছে, সেসময় সমুদ্র সৈকতে আয়োজিত এক উৎসবের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন অনেকে৷ তাঁদের বেশিরভাগই নিহত হয়েছেন৷
ছবি: AFP/Getty Images/J. Samad
জায়গা নেই হাসপাতালে
আহতদের ভিড় সামাল দিতে পারছে না স্থানীয় হাসপাতাল৷ আহতদের হাসপাতালের বাইরে চিকিৎসা দিতে বাধ্য হচ্ছেন চিকিৎসকরা৷ পালুর একটি হাসপাতালের পরিচালক কোমাং আদি সুয়েন্দ্র বলছেন, ‘‘আমাদের এই মুহূর্তে সব ধরনের সাহায্য প্রয়োজন৷ ফিল্ড হাসপাতাল, মেডিকেল কর্মী, ওষুধ, কম্বল, সবকিছু৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/M. Rifki
নিখোঁজ অনেকেই
এখনো শহরজুড়ে ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে আছেন অনেকে৷ যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হওয়ায় উদ্ধাকাজ চালানো যাচ্ছে না পূর্ণ গতিতে৷ উদ্ধারকর্মীরা আশংকা করছেন, নিহতের সংখ্যা কয়েক হাজারে পৌঁছুতে পারে৷
ছবি: Reuters/Antara Foto
জ্বালানি সংকট
ভূমিকম্প ও সুনামির আঘাতে পুরো দ্বীপ এখনো বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন রয়েছে৷ ফলে দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির সংকটও৷ অনেককেই দেখা গেছে, বাসার জেনারেটরের জন্য গ্যাস স্টেশনে নিজ হাতে গ্যাস নিতে৷
ছবি: DW/N. Amir
বেড়েছে লুটতরাজ
নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সংকটে পড়েছে পালু৷ বেঁচে থাকা অধিবাসীদের অনেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রবেশ করছেন বিধ্বস্ত শপিং মল ও সুপারমার্কেটে৷ খুঁজে বের করছেন ব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্র৷
ছবি: Reuters/DRONE PILOT TEZAR KODONGAN
জেল ভেঙে পলায়ন
অস্থিরতার সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন দ্বীপের কয়েদিরাও৷ স্থানীয় বিভিন্ন জেল ভেঙে অন্তত ১২০০ অপরাধী পালানোর তথ্য জানানো হয়েছে সংবাদমাধ্যমে৷ পলাতক কয়েদিদের ধরতে শিগগিরই অভিযান পরিচালনা শুরুর কথা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/T. Syuflana
পুনর্নিমাণের ঘোষণা
সুনামির আঘাতে বন্ধ হয়ে যাওয়ার একদিন পর পালু বিমানবন্দর খুলে দেয় কর্তৃপক্ষ৷ তখন থেকে ত্রাণ সরবরাহ শুরু করে সেনাবাহিনী৷ ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদোও সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন দ্বীপের অবস্থা, অঙ্গীকার করেছেন পুনর্নিমাণের৷
ছবি: Biro Pers Setpers
8 ছবি1 | 8
ডোঙ্গালার প্রশাসনিক প্রধান কাসমান লাসা জানিয়েছেন, কোথাও খাবার পাচ্ছে না মানুষ৷ স্থানীয় এক টেলিভিশনে দেয়া সাক্ষাকারে তিনি বলেন, ‘‘সবাই খুব ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে৷ কয়েকদিন ধরে না খেয়ে দিন কাটানোর পর তাঁরা পেট ভরে খেতে চায়৷ আমরা কিছু খাবার সরবরাহের চেষ্টা করছি, কিন্তু তা মোটেও যথেষ্ট নয়৷''
এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিন পর ক্ষুব্ধ জনতাকে আটকে রাখা মুশকিল হয়ে পড়তে পারে বলে মনে করেন লাসা৷ এরই মধ্যে অনেক জায়গায় লুটতরাজের খবর জানাচ্ছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম৷ জরুরি চাহিদা দ্রুত মেটানো না গেলে বিক্ষুব্ধ মানুষের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলেও আশংকা লাসার৷
সুনামির পর থেকে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন রয়েছে পুরো দ্বীপ৷ বন্ধ হয়ে গেছে গ্যাস স্টেশনও৷ অনেককেই দেখা গেছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্টেশনগুলো থেকে নিজেরাই বিকল্প উপায়ে জ্বালানি সংগ্রহ করছেন৷
পালুর রাস্তা জুড়ে এখন শুধু ‘আমাদের খাবার লাগবে', ‘সাহায্য চাই' লেখা ব্যানার-প্ল্যাকার্ডের ছড়াছড়ি৷
আন্তর্জাতিক সহায়তা
এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক সহায়তা নেয়ার বিষয়টি অনুমোদন দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট উইদোদো৷ এই মুহূর্তে জেনারেটর, উদ্ধারকাজে প্রয়োজনীয় ভারি যন্ত্রপাতি এবং তাঁবুকেই সবচেয়ে জরুরি বলে মনে করা হচ্ছে৷
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন জানিয়েছেন, তাঁর সরকার এরই মধ্যে দুর্গতদের সহায়তায় সাড়ে তিন লাখ ডলারের ত্রাণ ইন্দোনেশিয়াকে দিয়েছে৷ আরো ত্রাণ পাঠানোর ব্যাপারে আলোচনা চলছে বলেও জানিয়েছেন মরিসন৷
এডিকে/এসিবি (এপি, রয়টার্স)
সুনামি ঠেকাতে উঁচু দেয়াল
জাপানের উপকূলবর্তী কয়েকটি এলাকায় সৈকত আর বসতির মাঝে সাড়ে ১২ মিটার উঁচু প্রাচীর বসানো হয়েছে৷ সুনামির আঘাত থেকে বাঁচতে এই উদ্যোগ৷
ছবি: Reuters/Kim Kyung-Hoon
আগের কথা
২০১১ সালে ভূমিকম্প ও সুনামির আঘাতে জাপানে প্রায় ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল৷ সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে জাপান৷
ছবি: Reuters/Kim Kyung-Hoon
উঁচু দেয়াল
২০১১ সালের সুনামির আগে উপকূলীয় বিভিন্ন এলাকায় চার মিটার উঁচু বাঁধ ছিল৷ কিন্তু সুনামির ঢেউয়ের উচ্চতা কোনো কোনো স্থানে প্রায় ৩০ মিটার ছিল৷ এই অবস্থার উন্নয়নে পৌনে ১৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করে বাঁধের জায়গায় সাড়ে ১২ মিটার উঁচু কংক্রিটের দেয়াল তৈরি করা হয়েছে৷
ছবি: Reuters/Kim Kyung-Hoon
দেয়াল নির্মাণের কারণ
গবেষক হিরোইয়াসু কাওয়াই বলছেন, এই দেয়াল সুনামি ঠেকাবে এবং ভূমিতে পানি প্রবেশ প্রতিহত করবে৷ সুনামির উচ্চতা দেয়ালের চেয়ে বেশি হলেও বন্যার পানি ঢুকতে দেরি হবে, আর স্থান পরিত্যাগের জন্য বেশি সময় পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন কাওয়াই৷
ছবি: Reuters/Kim Kyung-Hoon
সমালোচনা
দেয়াল নির্মাণের বিষয়কে ঐ এলাকার মানুষ শুরুতে স্বাগত জানালেও দিন যত যাচ্ছে ততই সমালোচনা বাড়ছে৷ যেমন ৫২ বছর বয়সি আতসুশি ফুজিতা বলছেন, ‘‘খারাপ কিছু না করেও মনে হয় যেন আমরা জেলখানায় আছি৷’’
ছবি: Reuters/Kim Kyung-Hoon
অসহ্য
একটি টুনা মাছ সরবরাহকারী কোম্পানির প্রধান সোতারো উসুই বলছেন, ‘‘কয়েক প্রজন্ম ধরে আমরা সাগর পারে বাস করছি৷ এই দেয়াল আমাদের সাগর থেকে পৃথক করছে - যা অসহনীয় এক ব্যাপার৷’’
ছবি: Reuters/Kim Kyung-Hoon
ক্ষতিগ্রস্ত পর্যটন
রাইকো লিজিমা নামের জাপানি এক পর্যটক বলছেন, তিনি ৫০ বছর আগে সন্তানদের নিয়ে রিকুসেনতাকাতা শহরে ঘুরতে গিয়েছিলেন৷ সেখানকার সৈকতে দাপাদাপি করেছিলেন৷ এখন দেয়াল ওঠায় সেই সৌন্দর্যের কিছুই নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি৷ ফলে দেয়ালের কারণে ঐ এলাকায় পর্যটক আসার সংখ্যা কমে যেতে পারে বলে আশংকা করছেন স্থানীয়রা৷
ছবি: Reuters/Kim Kyung-Hoon
আছে প্রশংসাও
তবে প্রাচীর তৈরি হওয়ার বিষয়টিকে যে সবাই নেতিবাচক হিসেবে দেখছেন, তা নয়৷ যেমন কাতসুহিরো হাতাকেয়ামা নামে স্থানীয় এক হোটেলের মালিক বলছেন, সুনামির কারণে তাঁর হোটেল ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল৷ এখন প্রাচীর থাকায় সেই একই জায়গায় তিনি আবার হোটেলটি দাঁড় করিয়েছেন৷
ছবি: Reuters/Kim Kyung-Hoon
জানালা
কেসেননুমা শহরের প্রাচীরের কিছু অংশে ফাঁকা জায়গা রাখা হয়েছে৷ দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন জানালা৷ কিন্তু এই বিষয়টিও পছন্দ করছেন না কেউ কেউ৷ যেমন ইয়ুইচিরো ইতো বলছেন, ‘‘এগুলো প্যারোডি৷ এর মাধ্যমে এমন কিছু দিয়ে আমাদের খুশি করার চেষ্টা করা হয়েছে, যা আমরা প্রথমত চাইনি৷’’