লাইবেরিয়ায় মিশনারি হিসেবে কাজ করার সময় ইবোলা বা এবোলা রোগে আক্রান্ত হন ন্যান্সি রাইটবোল৷ বিমানযোগে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষামূলক জিম্যাপ ওষুধটি দিয়ে তাঁর চিকিৎসা করা হয়৷ ডিডাব্লিউ-কে সে কাহিনিই শোনালেন ন্যান্সি৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলে: লাইবেরিয়ায় প্রথম যখন অসুস্থ বোধ করেন, তখন আপনার কী অনুভূতি হয়েছিল?
ন্যান্সি রাইটবোল: প্রথমে মনে হয়েছিল যেন ম্যালেরিয়া৷ আসলে খুব জ্বর হয়েছিল, আর কোনো লক্ষণ ছিল না৷ ম্যালেরিয়ার টেস্ট করাতে দেখা গেল, পজিটিভ৷ কাজেই আমি বাড়ি গিয়ে ম্যালেরিয়ার ওষুধ খেতে শুরু করি৷ চার দিন বাড়িতেই ছিলাম, নড়াচড়া করিনি, ওষুধ খেয়েছি৷ কিন্তু অবস্থা যা ছিল, তা-ই রয়ে গেছে৷ তখন আমাদের ডাক্তার বলেন, ‘‘ন্যান্সি, আমি তোমার ইবোলা টেস্ট করাতে চাই৷ তোমার ইবোলা হয়েছে বলে আমার মনে হয় না, কেননা তোমার অন্য কোনো লক্ষণ নেই৷ কিন্তু ইবোলা টেস্ট করালে আমাদের সকলেরই মন শান্ত হবে৷'' ডাক্তার টেস্ট করালেন – বিকেলবেলা তার রেজাল্ট এলো: পজিটিভ৷
আপনার অবস্থা ক্রমেই আরো খারাপের দিকে যায়৷ আপনার কি পুরোটা সময় জ্ঞান ছিল?
সবসময়ে নয়, তবে মাঝেমধ্যে৷ আমার স্বামী ডেভিড বলেন, কোনো কোনোদিন আমি উঠে বসে ওর সঙ্গে কথা বলেছিল, হয়ত কিছু খেয়েছিও৷ কিছু কিছু আমার মনে আছে – আবার অনেকটাই মনে নেই৷ অনেকটা সময় ঘুমিয়েছি, বলে আমার মনে আছে – আর মনে আছে, দিনগুলো কী রকম মেঘলা আর বৃষ্টিবাদল ছিল৷ আমি খুবই দুর্বল ছিলাম৷ একা উঠে দাঁড়াতে পারতাম না, ডাক্তার কিংবা নার্সদের সাহায্য নিতে হতো৷ দিন দিন যেন আরো দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম৷ খুব খারাপ সময় গেছে৷
আপনার চিকিৎসার অঙ্গ হিসেবে আপনাকে জিম্যাপ সেরাম দেওয়া হয়৷ মাত্র ছ'জন রোগীকে এই ওষুধটি দেওয়া হয়েছে৷ আপনার কি তার ফলে কোনো সমস্যা হয়েছিল?
সিয়েরা লিওনে ইবোলার বিরুদ্ধে লড়াই
পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশে ইবোলা বা এবোলার সংক্রমণ মহামারির রূপ নিয়েছে৷ সিয়েরা লিওনও আছে সেই তালিকায়৷ ছোট্ট দেশটিতে চলছে ইবোলার বিরুদ্ধে বড় এক লড়াই৷ দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: DW/Scholz/Kriesch
জীবন তবু বহমান...
সিয়েরা লিওনের রাজধানী ফ্রিটাউনের সবজির বাজারে গোলমরিচ বিক্রি করেন সুয়ার্ড ডেম্বি (ডানে)৷ প্রতিদিন শত শত লোক এবোলায় সংক্রমিত হচ্ছে৷ বাজারে এত ভিড়, কার কাছ থেকে যে এবোলা এসে তাঁর শরীরেও বাসা বাঁধবে, কে বলবে! ভয় আছে ঠিকই, তবুও ডেম্বিকে প্রতিদিন আসতে হয় বাজারে৷ তাঁর আয়েই সংসারটা চলে৷ ডেম্বি মরিচ বিক্রি না করলে সংসার চলবে কী করে!
ছবি: DW/Scholz/Kriesch
স্থপতিও লড়াইয়ে
এবোলায় সংক্রমিতদের চিকিৎসা করতে হয় আলাদাভাবে৷ সে কারণে চাই বিশেষ ইউনিট৷ এখন অনেক জায়গাতেই এমন ইউনিট গড়ে তুলতে হচ্ছে৷ আছে উপযুক্ত স্থানের অভাব, প্রশিক্ষিত সেবাকর্মীর অভাব তো আরো বেশি৷ ছবির এই মানুষটির নাম কামারা৷ পেশায় স্থপতি৷ নানান প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন এতদিন৷ সব ছেড়ে চলে এসেছেন ফ্রিটাউনে৷ নিজেকে সঁপে দিয়েছেন এবোলা ভাইরাসে আক্রান্তদের জন্য বিশেষ ইউনিট গড়ার কাজে৷
ছবি: DW/Scholz/Kriesch
পুলিশই সবার ‘মা’
ইনি নিজের নাম কাউকে বলতে চান না৷ স্থানীয়রা তাঁর নাম দিয়েছেন ‘মামা জি’৷ সিয়েরা লিওনের সাধারণ এক মহিলা পুলিশ৷ স্বভাবে মায়ের মতো৷ সবার দুঃখ দুর্দশায় পাশে থাকেন৷ এখনো আছেন৷ এবোলার শিকার হয়ে কেউ মারা গেলে লাশ দাফন করতে আর কেউ না এলেও ‘মামা জি’ আসেন৷ ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ভয় আছে জেনেও লাশ হয়ে যাওয়া মানুষদের পরম মমতায় পৌঁছে দেন শেষ ঠিকানায়৷
ছবি: DW/Scholz/Kriesch
এক জার্মান
ওলে হ্যাঙ্গেলব্রক জার্মান নাগরিক৷ প্রায় এক বছর ধরে আছেন সিয়েরা লিওনে৷ ‘ক্যাপ আনামুর’ নামের এক বেসরকারি সংস্থার হয়ে পথশিশুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়েছেন পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিতে৷ লিওন প্রিমিয়ার লিগে একটি দলের হয়ে ফুটবলও খেলছেন চুটিয়ে৷ সে দেশে এখন এবোলা আতঙ্ক৷ ওলে হ্যাঙ্গেলব্রক তা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাচ্ছেন না৷ সিয়েরা লিওন তাঁর কাছে দ্বিতীয় জন্মভূমি৷ রোগের ভয়ে জন্মভূমি ছাড়বেন, তা হয় নাকি!
ছবি: DW/Scholz/Kriesch
প্রথম অভিজ্ঞতা
সংক্রমণ নিরোধক এই পোশাক আগে কখনো পরেননি মোমেডো লাম্বো৷ এবোলা রোগীদের ওয়ার্ডে কাজ করতে চান বলে ফ্রিটাউনে এসেছেন প্রশিক্ষণ নিতে৷ প্রশিক্ষণের প্রয়োজনেই পরতে হলো এ পোশাক৷
ছবি: DW/Scholz/Kriesch
সচেতনতা বাড়াতে...
এবোলার সংক্রমণ রুখতে হলে এ ভাইরাস সম্পর্কে সর্বস্তরে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন৷ পকেটের টাকা খরচ করে এ সম্পর্কে জেনেছেন উসমান রহিম বাহ৷ এখন দ্বারে দ্বারে গিয়ে এবোলা সম্পর্কে সচেতন করে তুলছেন সবাইকে৷
ছবি: DW/Scholz/Kriesch
সদাব্যস্ত স্টেলা
৩০ বছর বয়সি স্টেলা এক হাসপাতালের সেবিকা৷ রোগযন্ত্রণা, মৃত্যু, কান্না, আহাজারি কম দেখেননি৷ কিন্তু এবোলা-আতঙ্ক তাঁর জন্যও এক নতুন অভিজ্ঞতা৷ এবোলায় সংক্রমিত প্রথম রোগীটি যখন এলো, বলতে গেলে সব সহকর্মীই হাসপাতাল ছাড়লেন৷ কিন্তু স্টেলা যাননি৷ তাঁর দেশ শিগগিরই এ বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে আসবে - এ আশায় দিন-রাত রোগীর সেবা করে যাচ্ছেন এখনো৷
ছবি: DW/Scholz/Kriesch
পায়ে পায়ে বিপদ
ডেসমন্ড রিজ রেড ক্রসের টিম লিডার৷ দলনেতা হিসেবে তাঁর মূল দায়িত্ব, মৃতদেহ সৎকারের কাজে ব্যস্ত সহকর্মীদের সুস্থতা নিশ্চিত করা৷ বড় কঠিন দায়িত্ব৷ ডেসমন্ড রিজ বললেন, ‘‘আমরা যে ভালো প্রশিক্ষণ পেয়েছি এবং সংক্রমণ এড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েই কাজ করছি সেটা আমি জানি৷’’ তবু ভয় একটু থাকেই৷ রিজ প্রতিদিন ভাবেন, আজই হয়তো মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইটা শেষ হবে৷
ছবি: DW/Scholz/Kriesch
8 ছবি1 | 8
সে সময়ে নয়৷ ওটা একটি পরীক্ষামূলক ওষুধ হওয়ার কারণে আমরা ভেবেছিলাম, ‘‘আমি কি সত্যিই ঐ ওষুধটা নেব?'' কোনো এক সময় আমি ড. কেন্ট ব্র্যান্টলিকে টেলিফোন করি (ব্র্যান্টলি ন্যান্সির এক সহকর্মী, যিনি অনুরূপভাবে ইবোলা ভাইরাসে সংক্রমিত হন; ব্র্যান্টলি জেডম্যাপ সেরামটি পরীক্ষা করেছিলেন)৷ আমি তাঁকে জিগ্যেস করি: ‘‘তুমি কি ঐ ওষুধটা নিয়েছ?'' উনি বলেন, ‘‘আমি সেটা করব কিনা, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই৷'' তখন আমি তাঁকে বলি, ‘‘তুমি না নিলে, আমিও নেবো না৷'' (পরে ন্যান্সি অনেক দোনামোনা করার পর ওষুধটা নিতে মনোস্থির করেন)৷
আপনাকে একটি বেসরকারি বিমানে করে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া হয়, অ্যাটলান্টার এমোরি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য৷ বিমানযাত্রার কোনো খুঁটিনাটি আপনার মনে আছে?
আমাকে যখন বিমানে তোলা হয় আর ডেভিডের কাছ থেকে বিদায় নিতে হয়, তখন মনে হয়েছিল: আর কি কখনো ওর সঙ্গে দেখা হবে?...যে সব ডাক্তার আর নার্স উড়ালের সময় আমার দেখাশোনা করেছিলেন, তাদের কথা মনে আছে৷...উড়ালের সময় আমার সারাক্ষণ ভীষণ তেষ্টা পাচ্ছিল, কেন না আমি পুরোপুরি ‘ডিহাইড্রেটেড' হয়ে গেছিলাম৷...উড়ালের সময় আমি সবসময় সজ্ঞানে ছিলাম বলে আমার মনে হয় না৷
সুস্থ হয়ে ওঠার কথা নিশ্চয় মনে আছে?
আমার সেই দিনটা মনে আছে, ডাক্তাররা যেদিন ঘরে ঢুকে বলেন: ‘‘ন্যান্সি, তোমার বিপদ কেটেছে৷ তুমি বেঁচে যাবে৷''...আমি শুধু বলি: ‘‘প্রভুর কৃপা৷''....মনে আছে, আমার নাতিকে কোলে নিতে পেরে আমার কী রকম আনন্দ হয়েছিল৷
ন্যান্সি রাইটবোল ‘সার্ভিং ইন মিশন’ নামের একটি খ্রিষ্টীয় সংগঠনের হয়ে লাইবেরিয়ার রাজধানী মনরোভিয়ার একটি ইবোলা কেন্দ্রে কাজ করছিলেন৷ ৫৯ বছর বয়সি নার্স ন্যান্সির আদিবাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনা প্রদেশে৷