ইবোলা ভাইরাসের মোকাবিলার ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য টিকা একটা গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হতে পারে৷ এই মুহূর্তে আফ্রিকার পশ্চিমাঞ্চলে কিছু মানুষের উপর তার পরীক্ষা চলছে৷ সেই পরীক্ষা সফল হলে সাধারণ মানুষের উপর এই টিকা প্রয়োগ করা হবে৷
বিজ্ঞাপন
অঁতোয়ান মাগাংগা মম্বো-র জন্য রক্ত পরীক্ষা স্বাভাবিক রুটিন হয়ে পড়েছে৷ গত বছরের শেষে তাঁকে এবোলার পরীক্ষামূলক টিকা দেওয়া হয়েছিলো৷ তার পর থেকে নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা চলছে৷ তিনি বলেন, ‘‘শরীরে সব কিছু ঠিক আছে কিনা, এভাবে জানতে পারি এবং মানুষকে সাহায্য করতে পারি৷''
জোসে ফার্নান্ডেস গ্যাবন-এ পড়াশোনা করেছেন, দীর্ঘদিন সে দেশে কাজ করেছেন৷ তিনি এই কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত এবং ৬০ জন স্বেচ্ছাসেবীকে পরীক্ষা করেন৷ পরীক্ষার প্রথম পর্যায়ে বিভিন্ন ডোজ কতটা নিরাপদ ও সেগুলির টলারেন্স-এর মাত্রা খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷ এই কর্মসূচির কারণে তিনি জার্মানিতে তাঁর দ্বিতীয় ডক্টরেট আপাতত বন্ধ রেখেছেন৷ ফার্নান্ডেস বলেন, ‘‘আমার কাছে এটা ছিল খুবই সহজ সিদ্ধান্ত৷ কারণ এটা বিজ্ঞানের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ৷ এই রোগের টিকা উদ্ভাবন হবে এক বিশাল সাফল্য৷''
‘অপরাধবোধ’ থেকে হাসপাতাল, সেখানেই ইবোলা-বিরোধী যুদ্ধ
অন্যের ‘অপরাধেও’ লজ্জিত হয়ে যিনি মহৎ কাজে ব্রতী হতে পারেন তিনি নিশ্চয়ই সর্বজনশ্রদ্ধেয়৷ তেমনি এক ‘মহানায়ক’ একটা হাসপাতাল গড়েছিলেন গ্যাবনে৷ ছবিঘরে আজ এক নোবেল বিজয়ীর স্মৃতিবিজড়িত হাসপাতাল এবং ইবোলার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কথা৷
ছবি: DW/J.-P. Scholz/A. Kriesch
ছোট্ট এক জেলেপল্লী
পশ্চিম আফ্রিকার ছোট্ট দেশ গ্যাবনের ছোট্ট শহর লামবারেনে৷ শহরের বেশির ভাগ মানুষই জেলে বা মৎস্যজীবী, অর্থাৎ মাছ ধরাই তাঁদের পেশা৷ কিন্তু এ শহর সারা বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে একটি হাসপাতালের জন্য৷ হাসপাতালটির নাম আলব্যার্ট শোয়াইৎসার হাসপাতাল৷
ছবি: DW/J.-P. Scholz/A. Kriesch
আলব্যার্ট শোয়াইৎসার এবং তাঁর অনন্য কীর্তি
আলব্যার্ট শোয়াইৎসারের জন্ম ১৮৭৫ সালে, জার্মানিতে৷ তবে ১৯১৯ সাল থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন ফ্রান্সের নাগরিক৷ দর্শন ধর্মতত্ত্ব আর সংগীতেই ডুবে ছিলেন জীবনের বেশ বড় একটা সময়৷ শেষমেশ হলেন ডাক্তার৷ গ্যাবনের লামবারেনে শহরের হাসপাতালটি তাঁরই গড়া৷ আফ্রিকায় ইউরোপীয় উপনিবেশের অতীত তাঁকে কষ্ট দিতো৷ অনুশোচনাও হতো৷ সেই অনুশোচনা থেকেই হাসপাতালটি গড়ে তুলেছিলেন আলব্যার্ট শোয়াইৎসার৷
ছবি: DW/J.-P. Scholz/A. Kriesch
তাঁর ছায়া আছে, তবে প্রাচুর্য নেই
১৯১৩ সালে হাসপাতালটির উদ্বোধন করেন আলব্যার্ট শোয়াইৎসার৷ ১৯৫২ সালে চিকিৎসায় নোবেল দেয়া হয় তাঁকে৷ ১৯৬৫ সালে মারা যান তিনি৷ হাসপাতালের সমস্যা মূলত একটাই – অর্থ৷ হাসপাতালের পরিচালক হান্সইয়র্গ ফোটুরি জানালেন, গত কয়েক বছর ধরে খুব একটা অনুদান পাওয়া যাচ্ছেনা, ফলে হাসপাতালের আধুনিকায়নের কাজও এগোচ্ছেনা৷ আলব্যার্ট শোয়াইৎসারকে স্থানীয়দের অনেকেই এখন চেনে না৷ অনুদান দেবে কে!
ছবি: DW/J.-P. Scholz/A. Kriesch
ইবোলার বিরুদ্ধে লড়াই
আলব্যার্ট শোয়াইৎসার হাসপাতালের পাশেই এক গবেষণা কেন্দ্রে চলছে ইবোলার টীকা নিয়ে গবেষনা৷ আফ্রিকান এবং ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন সেখানে৷
ছবি: DW/J.-P. Scholz/A. Kriesch
জার্মানি থেকে গ্যাবনে
ইবোলার টীকা কতটা কার্যকর তা পরীক্ষা করে দেখা শুরু হয়েছে৷ সেই কাজের তদারকি করছেন ডাক্তার জোসে ফার্নান্দেস৷ জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা অসমাপ্ত রেখে তিনি গ্যাবন চলে যান৷ ৬০ জন সবল স্বেচ্ছাসেবীর দেহে পরীক্ষা করা হচ্ছে এই টীকা৷
ছবি: DW/J.-P. Scholz/A. Kriesch
সাহসী স্বেচ্ছাসেবী
আন্টোইন মাগাঙ্গা মোম্বো একজন স্বেচ্ছাসেবী৷ রক্ত পরীক্ষা করাতে মাসে একবার অন্তত গবেষণা কেন্দ্রে আসতে হয় তাঁকে৷ ২২ বছর বয়সী মোম্বো জানালেন, টীকা নেয়ায় তাঁর বিশেষ কোনো সমস্যা হচ্ছে না৷ মোম্বো যে ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সামলে নিতে পারছেন গবেষকদের জন্য এটা নিশ্চয়ই ভালো খবর৷
ছবি: DW/J.-P. Scholz/A. Kriesch
দারিদ্র্যে অবলম্বন
মোম্বোকে নিয়ে তাঁর পরিবার গর্বিত৷ তাঁর এক চাচা বললেন, ‘‘এমন কাজ করতে তো সাহস লাগে!’’ বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখেন মোম্বো৷ টীকার ট্রায়ালে অংশ নেয়ার জন্য ৪৪৯ ডলার দেয়া হয় তাঁকে৷ টাকাটা পরিবারের জন্য খুব দরকার! গ্যাস স্টেশনে কাজ করে মোম্বো যা পান তাতে তো সংসার চলেনা৷
ছবি: DW/J.-P. Scholz/A. Kriesch
তথ্য সংগ্রহ
গবেষণা সংক্রান্ত, বিশেষ করে টীকা প্রয়োগের পর স্বেচ্ছাসেবীদের স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য সংরক্ষণের কাজটি করছেন পাউল পিৎসিঙার৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও)-র হয়ে কাজ করছেন ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা শাস্ত্রের ছাত্র পাউল৷ আফ্রিকার আরো কয়েকটি দেশ, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রেও চলছে ইবোলা টীকার ট্রায়াল৷ সব জায়গার সব গবেষণা কেন্দ্রের তথ্যই সংগ্রহ করছে ডাব্লিউএইচও৷
ছবি: DW/J.-P. Scholz/A. Kriesch
দিনক্ষণ অজানা
পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশে কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হবে ইবোলা টীকার দ্বিতীয় পর্বের ট্রায়াল৷ ল্যামবারেনের প্রকল্প পরিচালক বেট্রাম লেল জানালেন টীকা আদৌ অনুমোদন পাবে কিনা, পেলেও কবে পাবে তা এখনো অজানা৷
ছবি: DW/J.-P. Scholz/A. Kriesch
9 ছবি1 | 9
শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতা ইবোলা ভাইরাস-কে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করবে, এটাই লক্ষ্য৷ সেটা সম্ভব করতে জেনেটিক পদ্ধতিতে পরিবর্তিত একটি ভাইরাস টিকা হিসেবে শরীরে ঢোকানো হয়৷ ইমিউন সিস্টেমকে এই প্রোটিনের মোকাবিলা করতে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে হবে৷ ল্যাবে সবার রক্ত পরীক্ষা করা হচ্ছে৷ এখনো পর্যন্ত কোনো সমস্যা চোখে পড়েনি৷ দ্বিতীয় পর্যায়ে আফ্রিকার পশ্চিমাঞ্চলে এই টিকার প্রভাব পরীক্ষা করা হবে৷
গ্যাবন-এর গবেষকরা জার্মানির ট্যুবিঙেন শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রপিকাল মেডিসিন ইনস্টিটিউট-এর বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছেন৷ প্রকল্পের সমন্বয়ক ব্যার্ট্রাম লেল বলেন, ‘‘যে সব কাজে সাধারণত কয়েক বছর সময় লাগে, আজকাল কয়েক মাসেই তা করা হয়েছে৷ কয়েক মাসের কাজ কয়েক সপ্তাহে হয়েছে৷ জেনিভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সবকিছুর সমন্বয় করছে, তাদের হাতেই রাশ রয়েছে৷ তাদের সহায়তার কারণেই এবার সব কিছু এত দ্রুত ঘটছে এবং ঘটা সম্ভব৷''
প্রাণীদের দ্বারা রোগে আক্রান্ত
অনেক মানুষ প্রাণীদের সাথে খুব সহজেই বন্ধুত্ব করতে পারে৷ তাছাড়া কুকুর, বিড়াল তো অনেক শিশুর খেলার সাথী, এমনকি তারা কেউ কেউ এক বিছানায় ঘুমায়ও৷ আতঙ্কের ব্যাপার হলো, প্রাণীদের গায়ে থাকে নানা রোগের জীবাণু৷
ছবি: Fotolia/pitrs
কুকুরের লোম থেকে অ্যালার্জি
পোষা কুকুরের লোম থেকে অনেক সময় শিশুদের শরীরে অ্যালার্জির সংক্রমণ হয়ে থাকে যা পরবর্তীতে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে৷ তাছাড়া জার্মানিতে প্রতিটি কুকরকেই জলাতঙ্ক রোগের টিকা দিতে হয় এবং কুকুরদের বিভিন্ন অসুখের জন্য টিকা দেওয়ারও নিয়ম রয়েছে৷ বিশেষ করে বিদেশে কোথাও ভ্রমণ করার আগে তো অবশ্যই৷
ছবি: Fotolia/Simone van den Berg
বেড়ালদের ‘চুলকানো’ অসুখের
বেড়াদের ‘চুলকানো’ অসুখ খুবই বিপজ্জনক৷ অসুস্থ বেড়ালের ক্ষত থেকে মানুষে শরীরে সংক্রমিত হয়ে থাকে এ অসুখ৷ তবে বেড়াল নিজে বছরের পর বছর এই রোগের জীবাণু রক্তের মধ্যে বহন করতে পারে৷ জার্মানিতে শতকরা ১৩টি বেড়ালই এই রোগের ভাইরাসে সংক্রমিত৷ মানুষের এ রোগ হলে অল্পক্ষণের জন্য জ্বর হয় এবং চুলকানির ফলে বিভিন্ন জায়গা ফুলে যায়৷
ছবি: Fotolia/millaf
ইবোলার সংক্রমণ ছড়ানোর প্রথম বাহক বাঁদুর
আমরা জানি বাঁদুরকে ‘ইবোলা’ সংক্রমণ ছড়ানোর প্রথম বাহক হিসেবেই ধরা হয়৷ তবে পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি এলাকায় বাঁদুরের মাংস সুস্বাদু খাবার হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে৷ ইবোলার প্রথম ভাইরাস কিন্তু প্রাণী থেকেই মানুষের শরীরে প্রবেশ করে৷ তারপর একজন মানুষের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে সংক্রমিত হয়৷ এভাবেই ছড়িয়ে পরে ভয়ংকর ইবোলা ভাইরাস৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গরু-বসন্ত
গরুরও বসন্ত রোগ হয়, বিশেষ করে বাছুর বা শিশু গরুদের৷ আর মানুষেরও হয় এই গরু-বসন্ত৷ জার্মানিতে গরু-বসন্তের টিকা এখনো বের হয়নি৷ তবে যাঁদের সাধারণ বসন্তের টিকা দেয়া থাকে, তাঁরা গরু-বসন্ত হবার ভয় থেকে সুরক্ষিত৷ আগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গো-দোহনের সময়ই এ সব অসুখ মানুষের শরীরে সংক্রমিত হতো, বিশেষকরে প্রথমেই আক্রান্ত হতো হাত দুটো৷
ছবি: Witolld Janczus
বিপজ্জনক কামড়
আজকের দিনে মানুষ বা প্রাণী কারো জন্যই এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণ করা কোনো সমস্যাই নয়, ঠিক এশীয় টাইগার মশার মতো৷ বিভিন্ন দেশ থেকে জাহাজের মাধ্যমে পণ্যদ্রব্যের সাথে মশা রোগের জাবাণু বহন করে ইউরোপে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় ডেঙ্গু জ্বর৷
ছবি: picture alliance/Mary Evans Picture Library
টিয়া পাখির অসুখ
টিয়া পাখি অসুখ হচ্ছে ‘জু-নোজ’, যা শিশু এবং দুর্বল মানুষদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই টিয়া পাখি বা পায়রার শুকনো মল বা বিষ্ঠা থেকে বাতাসের মাধ্যমে মানুষেকে সংক্রমিত করে৷
ছবি: Proaves
শেয়াল
২০০৮ সাল পর্যন্ত জার্মানিতেও ছিল জলাতঙ্ক রোগ৷ এই রোগ সাধারণত শেয়ালের থেকেই সংক্রমিত হয়ে থাকে৷ বিশাল এক টিকা অভিযানের মাধ্যমে এই বিপজ্জনক রোগ নির্মূল করা হয়েছে৷ আগে এই ভাইরাসে যাঁরা আক্রান্ত হতেন, তাঁরা মৃত্যুর ছোবল থেকে রক্ষা পেতেন না৷ জার্মানি অবশ্য এখন এই রোগের সংক্রমণ থেকে মুক্ত৷
ছবি: imago/blickwinkel
7 ছবি1 | 7
অঁতোয়ান মম্বো এই স্টাডি কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে মোটেই আক্ষেপ করছেন না, যদিও অনেক বন্ধু তাঁকে এ সব থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছিল৷ প্রায় ৪০০ ইউরো পারিশ্রমিকও তাঁকে এই সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে৷ তাঁর পরিবারের টাকার প্রয়োজন রয়েছে৷ আফ্রিকার এই দেশে তাঁর মতো অনেকেই বেশ গরিব৷ ইবোলা পরিস্থিতি আরও কঠিন করে তুলেছে৷ এই টিকা আশার আলো দেখাচ্ছে৷ জোসে ফার্নান্ডেস বলেন, ‘‘এই প্রকল্প থেকে কোনো সিদ্ধান্তে আসার সময় এখনো আসে নি৷ তবে আমরা আশাবাদী৷ যে গবেষণা শুরু করেছি, তা চালিয়ে যাবো৷ শীঘ্রই নির্ভরযোগ্য ফলাফল এলে আরও বেশি জানা যাবে৷''
জোসে ফার্নান্ডেস মনে করেন, স্টাডির ফলাফল শীঘ্রই প্রকাশিত হবে৷ যদি জানা যায় যে, এই টিকা মানুষের জন্য নিরাপদ, তার পরেই ইবোলা আক্রান্ত এলাকায় টিকা দেওয়া শুরু হবে৷