পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলার প্রসারের মোকাবিলা, ইউরোপ ও উত্তর অ্যামেরিকায় আরও সতর্কতা এবং পারস্পরিক সমন্বয়ের মাধ্যমে এই বিপদের মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে একাধিক দেশ ও সংগঠন৷ তবে সমালোচনাও থেমে নেই৷
বিজ্ঞাপন
ইবোলার প্রকোপ মূলত আফ্রিকার পশ্চিমেই সীমাবদ্ধ থাকবে- প্রথমদিকে এমনটাই ধারণা করা হয়েছিল৷ কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে হলেও বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় বেড়ে চলেছে ইবোলা রোগীর সংখ্যা৷ এ অবস্থায় বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে সুরক্ষা আরও বাড়ানোর চেষ্টা করছে৷
ইবোলা ভাইরাসের আতঙ্ক সারা বিশ্বে
পশ্চিম আফ্রিকায় ইতিমধ্যে ৪,০০০ মানুষ ইবোলা সংক্রমণে মারা গেছে৷ ইউরোপ এবং অ্যামেরিকায় ইবোলার প্রথম সংক্রমণের পর মহামারির রূপ নিতে পারে এমন আতঙ্ক বাড়ছে৷ দেখুন ইবোলার বিস্তার এবং আতঙ্ক নিয়ে আজকের ছবিঘর৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ডালাস, অ্যামেরিকা
টেক্সাসের এক হাসপাতালের একজন নার্স ইবোলা ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ায় তাঁর বাড়িতে ঢোকার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে স্থানীয় পুলিশ৷ স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদেও একজন ইবোলায় সংক্রমিত হয়েছেন৷ আক্রান্ত হওায়ার আগে ইবোলায় আক্রান্ত রোগীর সেবা করেছিলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/Jaime R. Carrero
মিলান্ডু, গিনি
গিনির গ্রাম মিলান্ডুতে গত বছর ইবোলার সূত্রপাত হয়৷ এ রোগে আক্রান্ত হয়ে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর দু’বছরের এক শিশু মারা যায়৷ সম্ভবত ওই শিশুটিই ছিল সাম্প্রতিক কালে মহামারির রূপ নেয়া ইবোলার প্রথম শিকার৷ তারপরই এই ভাইরাসে মারা যায় শিশুটির বোন, মা এবং নানি৷ এ বছরের মার্চ মাসে গিনির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ডাব্লিউএইচও-কে ইবোলার প্রাদুর্ভাবের কথা জানায়৷
মনরোভিয়া, লাইবেরিয়া
গিনির পর ইবোলা আঘাত হানে পার্শ্ববর্তী দেশ সিয়েরা লিওন ও লাইবেরিয়ায়৷ লাইবেরিয়ায় নার্সদের ধর্মঘটে ইবোলা রোগীদের সংকট কিছুটা বেড়ে যায়৷ তবে আশার কথা, সেনেগাল এবং নাইরেজিয়ায় এরই মধ্যে ইবোলা সংক্রমণের হার কিছুটা কমেছে৷
জেনেভা, সুইজারল্যান্ড
ইবোলা একটি সংক্রামক রোগ৷ রক্ত, বীর্য, যোনিরস, লালা বা দেহ নির্গত অন্য পদার্থ যেমন মলমূত্র বা বমির সংস্পর্শে এ রোগ ছড়ায়৷ আক্রান্ত রোগীদের পরিবারের সদস্য, ডাক্তার ও সেবাকর্মীদের এ রোগে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা বেশি৷ তবে সংক্রমণ নিরোধক পোশাক এবং জীবাণুনাশক ব্যবহার করলে ইবোলায় সংক্রমিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, মনে করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: Getty Images/P. Guyot
লাইপসিশ, জার্মানি
গত মঙ্গলবার জার্মানিতে আসা জাতিসংঘের দু’জন কর্মীর মধ্যে একজন লাইপসিশে মারা গেছেন, যিনি লাইবেরিয়াতেই ইবোলা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিলেন৷ আর একজনকে বিশেষ ব্যবস্থায় ফ্রাংকফুর্ট শহরে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে৷ জার্মান স্বাস্থ্যমন্ত্রী হ্যারমান গ্যোহে অবশ্য আশার কথা শুনিয়েছেন৷ তাঁর মতে, ‘‘জার্মানিতে ইবোলা সংক্রমণের আশঙ্কা খুবই কম৷’’
ছবি: Reuters/R. Orlowski
5 ছবি1 | 5
প্রথমেই বিমানবন্দরসহ আন্তর্জাতিক সীমান্তে ইলা প্রতিরোধের জন্য যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেগুলি নতুন করে খতিয়ে দেখা হচ্ছে৷ কারণ,পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আসা যাত্রীদের মাধ্যমেই ইবোলা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি৷ প্রবেশদ্বারের মুখেই তাদের শনাক্ত করতে না পারলে তারা এই ভাইরাস আরও ছড়িয়ে যেতে পারে৷
পশ্চিম আফ্রিকায় বিমানে ওঠার আগেই যাত্রীদের স্ক্রিনিং, সন্দেহ দেখা দিলে কোনো যাত্রীকে বিমানে উঠতে না দেওয়া অত্যন্ত জরুরি পদক্ষেপ৷ এসব বাধা পেরিয়ে ইবোলা আক্রান্ত কোনো যাত্রী যদি শেষ পর্যন্ত ইউরোপ বা অ্যামেরিকায় পৌঁছে যায়, তখন বিমানবন্দরেও তাকে শনাক্ত করে বাকিদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে হয়৷ হাসপাতালে চিকিৎসার সময়ও কড়া নিয়ম মেনে চলার কথা৷ কিন্তু ঢিলেমির কারণে গাফিলতির ঘটনা বাড়ছে৷ স্পেন থেকে অ্যামেরিকা – অনেক দেশেই এমন ঘটনার খবর পাওয়া যাচ্ছে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বাস্থ্যমন্ত্রীরা এ ক্ষেত্রে পারস্পরিক সমন্বয় আরও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷
এদিকে পশ্চিম আফ্রিকার ১৫টি দেশকে ইবোলা মোকাবিলায় আরও সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও)৷ লাইবেরিয়া, সিয়েরা লিওন ও গিনি – এই তিনটি দেশেই ইবোলা সবচেয়ে মারাত্মক রূপ নিয়েছে৷ বাকি দেশগুলোরও পরিস্থিতিও খারাপ৷ এবোলা যাতে আরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, ডাব্লিউএইচও তা নিশ্চিত করতে চায়৷
সিয়েরা লিওনে ইবোলার বিরুদ্ধে লড়াই
পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশে ইবোলা বা এবোলার সংক্রমণ মহামারির রূপ নিয়েছে৷ সিয়েরা লিওনও আছে সেই তালিকায়৷ ছোট্ট দেশটিতে চলছে ইবোলার বিরুদ্ধে বড় এক লড়াই৷ দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: DW/Scholz/Kriesch
জীবন তবু বহমান...
সিয়েরা লিওনের রাজধানী ফ্রিটাউনের সবজির বাজারে গোলমরিচ বিক্রি করেন সুয়ার্ড ডেম্বি (ডানে)৷ প্রতিদিন শত শত লোক এবোলায় সংক্রমিত হচ্ছে৷ বাজারে এত ভিড়, কার কাছ থেকে যে এবোলা এসে তাঁর শরীরেও বাসা বাঁধবে, কে বলবে! ভয় আছে ঠিকই, তবুও ডেম্বিকে প্রতিদিন আসতে হয় বাজারে৷ তাঁর আয়েই সংসারটা চলে৷ ডেম্বি মরিচ বিক্রি না করলে সংসার চলবে কী করে!
ছবি: DW/Scholz/Kriesch
স্থপতিও লড়াইয়ে
এবোলায় সংক্রমিতদের চিকিৎসা করতে হয় আলাদাভাবে৷ সে কারণে চাই বিশেষ ইউনিট৷ এখন অনেক জায়গাতেই এমন ইউনিট গড়ে তুলতে হচ্ছে৷ আছে উপযুক্ত স্থানের অভাব, প্রশিক্ষিত সেবাকর্মীর অভাব তো আরো বেশি৷ ছবির এই মানুষটির নাম কামারা৷ পেশায় স্থপতি৷ নানান প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন এতদিন৷ সব ছেড়ে চলে এসেছেন ফ্রিটাউনে৷ নিজেকে সঁপে দিয়েছেন এবোলা ভাইরাসে আক্রান্তদের জন্য বিশেষ ইউনিট গড়ার কাজে৷
ছবি: DW/Scholz/Kriesch
পুলিশই সবার ‘মা’
ইনি নিজের নাম কাউকে বলতে চান না৷ স্থানীয়রা তাঁর নাম দিয়েছেন ‘মামা জি’৷ সিয়েরা লিওনের সাধারণ এক মহিলা পুলিশ৷ স্বভাবে মায়ের মতো৷ সবার দুঃখ দুর্দশায় পাশে থাকেন৷ এখনো আছেন৷ এবোলার শিকার হয়ে কেউ মারা গেলে লাশ দাফন করতে আর কেউ না এলেও ‘মামা জি’ আসেন৷ ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ভয় আছে জেনেও লাশ হয়ে যাওয়া মানুষদের পরম মমতায় পৌঁছে দেন শেষ ঠিকানায়৷
ছবি: DW/Scholz/Kriesch
এক জার্মান
ওলে হ্যাঙ্গেলব্রক জার্মান নাগরিক৷ প্রায় এক বছর ধরে আছেন সিয়েরা লিওনে৷ ‘ক্যাপ আনামুর’ নামের এক বেসরকারি সংস্থার হয়ে পথশিশুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়েছেন পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিতে৷ লিওন প্রিমিয়ার লিগে একটি দলের হয়ে ফুটবলও খেলছেন চুটিয়ে৷ সে দেশে এখন এবোলা আতঙ্ক৷ ওলে হ্যাঙ্গেলব্রক তা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাচ্ছেন না৷ সিয়েরা লিওন তাঁর কাছে দ্বিতীয় জন্মভূমি৷ রোগের ভয়ে জন্মভূমি ছাড়বেন, তা হয় নাকি!
ছবি: DW/Scholz/Kriesch
প্রথম অভিজ্ঞতা
সংক্রমণ নিরোধক এই পোশাক আগে কখনো পরেননি মোমেডো লাম্বো৷ এবোলা রোগীদের ওয়ার্ডে কাজ করতে চান বলে ফ্রিটাউনে এসেছেন প্রশিক্ষণ নিতে৷ প্রশিক্ষণের প্রয়োজনেই পরতে হলো এ পোশাক৷
ছবি: DW/Scholz/Kriesch
সচেতনতা বাড়াতে...
এবোলার সংক্রমণ রুখতে হলে এ ভাইরাস সম্পর্কে সর্বস্তরে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন৷ পকেটের টাকা খরচ করে এ সম্পর্কে জেনেছেন উসমান রহিম বাহ৷ এখন দ্বারে দ্বারে গিয়ে এবোলা সম্পর্কে সচেতন করে তুলছেন সবাইকে৷
ছবি: DW/Scholz/Kriesch
সদাব্যস্ত স্টেলা
৩০ বছর বয়সি স্টেলা এক হাসপাতালের সেবিকা৷ রোগযন্ত্রণা, মৃত্যু, কান্না, আহাজারি কম দেখেননি৷ কিন্তু এবোলা-আতঙ্ক তাঁর জন্যও এক নতুন অভিজ্ঞতা৷ এবোলায় সংক্রমিত প্রথম রোগীটি যখন এলো, বলতে গেলে সব সহকর্মীই হাসপাতাল ছাড়লেন৷ কিন্তু স্টেলা যাননি৷ তাঁর দেশ শিগগিরই এ বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে আসবে - এ আশায় দিন-রাত রোগীর সেবা করে যাচ্ছেন এখনো৷
ছবি: DW/Scholz/Kriesch
পায়ে পায়ে বিপদ
ডেসমন্ড রিজ রেড ক্রসের টিম লিডার৷ দলনেতা হিসেবে তাঁর মূল দায়িত্ব, মৃতদেহ সৎকারের কাজে ব্যস্ত সহকর্মীদের সুস্থতা নিশ্চিত করা৷ বড় কঠিন দায়িত্ব৷ ডেসমন্ড রিজ বললেন, ‘‘আমরা যে ভালো প্রশিক্ষণ পেয়েছি এবং সংক্রমণ এড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েই কাজ করছি সেটা আমি জানি৷’’ তবু ভয় একটু থাকেই৷ রিজ প্রতিদিন ভাবেন, আজই হয়তো মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইটা শেষ হবে৷
ছবি: DW/Scholz/Kriesch
8 ছবি1 | 8
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইবোলার মোকাবিলায় সামরিক বাহিনীর এক অভিযান অনুমোদন করেছেন৷ রিজার্ভিস্ট সৈন্যরা তাতে অংশ নেবেন৷ তবে ওবামা বর্তমান পরিস্থিতিতে পশ্চিম আফ্রিকায় ভ্রমণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে চান না৷ ফলে এসব দেশের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে না৷ তবে অ্যামেরিকার প্রবেশদ্বারে সতর্কতা আরও বাড়ানো হচ্ছে৷ ইবোলা মোকাবিলার যাবতীয় উদ্যোগের সমন্বয়ের জন্য একটি পদ সৃষ্টির কথাও ভাবছে ওবামা প্রশাসন৷
ইবোলা মোকাবিলার ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিক্রিয়ার তীব্র সমালোচনা শোনা যাচ্ছে৷ জাতিসংঘের প্রাক্তন মহাসচিব কোফি আন্নান অভিযোগ করেছেন, রোগটি আফ্রিকায় দেখা দেয়ায় প্রথমে কেউই বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি৷ এখন ইবোলা ইউরোপ ও উত্তর অ্যামেরিকায় প্রবেশ করতে শুরু করায় উন্নত দেশগুলি নড়েচড়ে বসেছে৷ ইবোলা মোকাবিলায় গঠিত রিজার্ভ তহবিলে যথেষ্ট অর্থ জমা না পড়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব বান কি-মুন৷ শুক্রবার পর্যন্ত শুধু কলম্বিয়া ১ লক্ষ ডলার জমা করেছিল৷ তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের উদ্যোগের প্রশংসা করেন বান৷ তিনি বাকি দেশগুলোর উদ্দেশ্যে আরও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করার ডাক দিয়েছেন৷