বাংলাদেশে যাতে ইবোলা ভাইরাসের সংক্রমণ না হয়, তার জন্য সতর্কতা জারি করা হয়েছে৷ যুক্তরাষ্ট্রের একদল বিশেষজ্ঞ সেই প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ করছে৷ এরই মধ্যে তাঁরা ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রস্তুতি সরেজমিন দেখেছেন৷
বিজ্ঞাপন
বুধবার রাজধানী ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি পরিদর্শন করেন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশেষজ্ঞ দল৷ তাঁদের সঙ্গে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা এবং বাংলাদেশে কর্মরত ‘ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল' বিভাগের সদস্যরাও ছিলেন৷
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের সদস্যদের সঙ্গে ‘বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল'-এর পরিচালক বে-নজীর আহমেদও ছিলেন৷ তিনি জানান, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবন্দরের কড়া স্বাস্থ্য-পরীক্ষা এড়িয়ে যদি সেখানে ভাইরাসটি ঢুকতে পারে, তাহলে বিশ্বের যে কোনো দেশেই এটি ঢুকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ বাংলাদেশেও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক রয়েছে৷ তাই তাঁদের ‘দুশ্চিন্তা'-র যথাযথ কারণও রয়েছে৷''
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়: ভারত সীমান্তে ১৯টি স্থলবন্দর, তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, দুটি সমুদ্রবন্দর এবং মিয়ানমারের সঙ্গে একটি স্থলবন্দর – এই ২৫টি স্থানে ‘মেডিকাল টিম' কাজ করছে৷ স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জানান, ‘‘ইবোলা ভাইরাস মোকাবেলায় অনেক আগেই সতর্কাবস্থা গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ৷ খুব শীঘ্রই দেশের সকল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ‘থার্মাল স্ক্যানিং'-এর ব্যবস্থা করার পাশাপাশি, বাইরে থেকে আসা সকল যাত্রীকে স্বাস্থ্য-পরীক্ষার আওতায় আনা হবে৷''
তিনি বলেন, আফ্রিকার পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ইবোলা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় দেশের বন্দরগুলোতে ‘মনিটরিং' কার্যক্রম জোরালো করা হয়েছে৷ এই ব্যবস্থা আগামী কয়েক মাস অব্যাহত থাকবে৷
বাংলাদেশের বিমানবন্দর বা চেকপয়েন্টগুলোতে সবার স্বাস্থ্য-পরীক্ষা এবং ‘থার্মাল স্ক্যানিং'-এর ব্যবস্থা নেই৷ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. দীন মো. নূরুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিমানবন্দরে দেশের বাইরে থেকে আসা সকল যাত্রীকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার আওতায় রাখা কঠিন কাজ৷ তবে তা এ মুহূর্তে জরুরি হয়ে পড়েছে৷ তবে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে আগত যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হচ্ছে ইতিমধ্যেই৷ বিমানবন্দরে বাইরে থেকে আগত সকল যাত্রীর জ্বর মাপার যন্ত্র বসানোর চিন্তা-ভাবনা রয়েছে৷''
সরকারের রোগতত্ত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাহামুদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বর্তমানে বিমানবন্দরে একটি ‘মেডিকাল টিম' কাজ করছে৷ সকল যাত্রীদের স্বাস্থ্য-পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই৷ শুধু পশ্চিম আফ্রিকার দেশ থেকে কেউ স্বাস্থ্যগত সমস্যা নিয়ে আসলে তাঁকে পরীক্ষা করা হবে৷ বিমানবন্দরে বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদের মধ্যে ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি আছেন কিনা, তা পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটি ‘মেডিকাল ডেস্ক'-ও বসানো হয়েছে৷''
মহামারি ইবোলা ভাইরাস
ইবোলা বা এবোলা ভাইরাসকে চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ভাইরাস হিসেবে উল্লেখ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷ এতে আক্রান্ত হলে ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যুর অবধারিত৷ তাই বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যবিষয়ক জরুরি অবস্থা জারি করেছে সংস্থাটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যবিষয়ক জরুরি অবস্থা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান মার্গারেট চান এবোলাকে মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি অন্যতম ঘাতক জ্বর হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছেন যে, আফ্রিকায় মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে রক্তপ্রদাহজনিত এই জ্বর৷ তাই বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যবিষয়ক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন তিনি৷
ছবি: picture alliance/dpa
পশ্চিম আফ্রিকায় মহামারি
মারাত্মক এবোলা ভাইরাসের আক্রমণে পশ্চিম আফ্রিকার কয়েকটি দেশে এ পর্যন্ত প্রায় ১,০০০ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৭১১৷ গিনিতে গত মার্চে প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে এবোলা ভাইরাসের প্রকোপ কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না৷
ছবি: picture-alliance/dpa
লাইবেরিয়ায় জরুরি অবস্থা
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হিসেবে বিশ্বে এই ভাইরাসে আক্রান্ত দেশগুলির মধ্যে অন্যতম দেশ লাইবেরিয়ায় বৃহস্পতিবার জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে৷ এতে সরকার বিভিন্ন কঠোর ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হবে৷ প্রাণঘাতী এবোলা ভাইরাস এখন আফ্রিকা থেকে বিশ্বের অন্যান্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
আক্রান্ত অন্যান্য দেশের নাগরিক
স্পেনের একজন প্রবীণ ক্যাথলিক ধর্মপ্রচারক মারাত্মক অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরে গেছেন৷ তিনি এবোলায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ সৌদি আরবে একজন রোগীর মৃত্যুর কারণও এবোলা বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা৷ নাইজেরিয়াতেও একজন নার্স এবোলার সংক্রমণে মারা গেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এবোলা সংক্রমণের লক্ষণ
এবোলায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মারাত্মক জ্বর এবং কারও কারও অবিরত রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে৷ সঙ্গে থাকে মাথা, পেশী এবং তলপেটে তীব্র ব্যথা৷ রোগীর একদিকে ক্ষুধা কমে যায়, অন্যদিকে শুরু হয় পাতলা পায়খানা৷ সাধারণত শরীর থেকে নিঃসৃত বিভিন্ন তরল পদার্থের মাধ্যমে ভাইরাসটির সংক্রমণ ঘটে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আক্রান্ত চিকিৎসক
বলা বাহুল্য, আক্রান্ত ব্যক্তির পরিচর্যাকারীর মধ্যে ভাইরাসটি সংক্রমণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি৷ লাইবেরিয়াতে যেমন এবোলা রোগীদের পরিচর্যাকারী দুই মার্কিন স্বাস্থ্যকর্মী এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর, তাঁদের চিকিৎসার জন্য সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সংক্রমণের আশঙ্কা
মূলত কোনো প্রাণী বা মানুষের রক্ত, বীর্য, যোনিরস বা দেহ নির্গত অন্য কোনো তরলের সংস্পর্শে এ রোগ ছড়ায়৷ বলা বাহুল্য, অনিয়ন্ত্রিত এবং অনিরাপদ যৌন মিলনেও এ রোগের সংক্রমণ হয়ে থাকে৷ অর্থাৎ কিছু কিছু ক্ষেত্রে এইডস রোগের সঙ্গে এবোলার মিল রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
উড়ন্ত খ্যাঁকশিয়াল
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, পশ্চিম আফ্রিকায় এবোলা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার প্রধান কারণ উড়ন্ত খ্যাঁকশিয়াল৷ এই প্রাণীটি ভাইরাসটি বহন করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছড়িয়ে দিচ্ছে৷ এমনকি সংক্রমিত প্রাণীটি যখন ফলমূল ও অন্যান্য প্রাণী খাচ্ছে, তখন সেসব খাদ্যের অবশিষ্ট অংশ থেকেও ছড়িয়ে পড়ছে এবোলা৷
ছবি: imago
সংক্রমণের ঝুঁকি
তার মানে শুধু মানুষ থেকে মানুষে নয়, মানুষ যখন এবোলায় আক্রান্ত প্রাণীর রক্ত বা মাংসের সংস্পর্শে আসে, তখনও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে৷ বরং সেক্ষেত্রে ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি বলে জানান চিকিৎসকরা৷ তাই খ্যাঁকশিয়াল থেকে অন্য প্রাণী বা ফলমূল হয়ে সহজেই মানুষের মধ্যে এবোলা ভাইরাস তার বংশবৃদ্ধি করে৷
ছবি: DW
৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যু
এবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যুর অবধারিত৷ সেজন্যই তো একে মহামারি বলে আখ্যা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷
ছবি: Reuters
বড় সমস্যা
বলা বাহুল্য, আফ্রিকায় বন্য প্রাণী খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে৷ সব বাজারেই এ সব মাংস পাওয়া যায়৷ গবেষকদের ধারণা, এ ধরনের বন্য প্রাণীর মাংস থেকে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে এবোলা৷ তার সঙ্গে অনিরাপদ যৌন মিলন তো রয়েছেই!
ছবি: picture-alliance/dpa
পরীক্ষামূলক ওষুধ এখনই নয়
এবোলা সংক্রমণ নিরাময়ের উপায় এখনো আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি৷ যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি একটি ওষুধ পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করার সময় এখনো আসেনি বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা৷ কারণ মার্কিন দুই স্বাস্থ্যকর্মীর ওপর ওষুধটি প্রয়োগে তাঁদের উন্নতির ধরণে তারতম্য দেখা গেছে৷
ছবি: LEON NEAL/AFP/Getty Images
12 ছবি1 | 12
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন জাকির হাসান বলেন, ‘‘কোনো যাত্রীকে সন্দেহ হলে তাঁর নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর রাখা হচ্ছে৷ আক্রান্ত কেউ ধরা পড়লে তাঁকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হবে৷ তাঁদের জন্য ২০টি পৃথক শয্যার ব্যবস্থাও করা হয়েছে৷''
তিনি জানান, ‘‘পশ্চিম আফ্রিকা থেকে বিমানে করে কোনো যাত্রী বাংলাদেশে আসছেন কিনা, তা বিমান চলাচলের আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে বাংলাদেশকে আগেই জানানো হচ্ছে৷ এ পর্যন্ত ১০৬ জন যাত্রী বাংলাদেশে এসেছেন৷ তাঁদের প্রত্যেকের ওপর নজর রেখেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর৷ তাঁদের ২১ দিন পর্যন্ত অনুসরণ করা হচ্ছে৷ অন্যদিকে পশ্চিম আফ্রিকার ওই দেশগুলোতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে থাকা বাংলাদেশি সদস্যদের ব্যাপারে নিয়মিত খোঁজখবর রাখছে সরকার৷''
সম্প্রতি শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে লাইবেরিয়া থেকে আগত ছয়জন বাংলাদেশি ইবোলা সংক্রান্ত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়াই দেশে ঢুকে পড়েন, যা নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে৷ তবে ‘বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল'-এর পরিচালক বে-নজীর আহমেদ দাবি করেন, ‘‘বিমানবন্দরে তাঁদের তাপমাত্রা মাপা হয়েছে৷ এবং তাতে ইবোলার উপস্থিতির কোনো লক্ষণ পাওয়া যায়নি৷''