জার্মানির এক ইমাম ও সৌদি আরবের এক মুফতির দু'টি বক্তব্য সমালোচনার ঝড় তুলেছে৷ হতাশ, বিস্মিত এবং ক্ষুব্ধ অনেকের মনে ‘ইসলাম ধর্ম' এবং বিভিন্ন দেশে মসজিদের ভূমিকা এবং কার্যকলাপ নিয়েই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
গত ৩১শে ডিসেম্বর রাতে কোলনে ব্যাপক নারী নিপীড়নের কারণ সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে ইমাম সামি আবু-ইউসুফ বলেছেন, নারীদের খোলামেলা পোশাক এবং তাঁদের ব্যবহার করা পারফিউমই নাকি সেই রাতের যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের জন্য দায়ী৷ রাশিয়ার রেন টিভি-কে দেয়া সাক্ষাৎকারে তাঁর এই বক্তব্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে৷
২০১৫ সালকে বিদায় এবং নতুন বছর ২০১৬-কে স্বাগত জানানোর উৎসবের রাতে কোলনসহ জার্মানির কয়েকটি শহরে নারীরা ব্যাপক যৌন নিপীড়নের শিকার হন৷ কোলনের ঘটনায় এ পর্যন্ত একজন ধর্ষণ এবং ৮শ'রও বেশি নারী যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেছেন৷
অভিযোগগুলোর তদন্ত যখন চলছে তখনই রাশিয়ার একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে কোলনের ইমাম সামি আবু-ইউসুফ পুরো ঘটনার জন্য নারীদেরই দায়ী করলেন৷ স্বাভাবিকভাবেই তাঁর এ বক্তব্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে৷ টুইটারের একজন লিখেছেন, ইমামের এমন বক্তব্যের পর কোলনের মসজিদটি বন্ধ করে দেয়া উচিত৷ পাশাপাশি ইমাম সামি আবু-ইউসুফসহ ঐ মসজিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আটক করে তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি৷
এমন বক্তব্যের মাধ্যমে ইমাম আবু ইউসুফ কি ইসলামের অপব্যাখ্যা এবং ইসলামের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছেন? ইসলাম ধর্ম কি অপরাধীর অপরাধকে গৌন করে দেখতে বা দেখাতে শেখায়? তাছাড়া জার্মানির মানুষ জার্মানিতে তাঁদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য অনুযায়ী পোশাক পরলে তাতে কি কারো আপত্তি থাকতে পারে? বিশ্লেষকদের আলোচনায় এসব প্রশ্ন উঠে আসছে৷
ওদিকে সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা গ্র্যান্ড মুফতি শেখ আবদুল আজিজ বিন-আব্দুল্লাহ আল শেখ বলেছেন, মুসলমানদের জন্য দাবা খেলা ‘হারাম'৷ তাঁর মতে, দাবা খেলা শত্রুতা ও ঘৃণার জন্ম দেয়৷ অনেকেই তাঁর এই বক্তব্যের কোনো যুক্তি খুঁজে পাননি৷ ধর্মের সঙ্গে এর সম্পর্ক বা বিরোধও বোধগম্য হচ্ছে না অনেকের কাছে৷
তাঁর এই মন্তব্যে বিস্ময়, হতাশা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই৷ সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকজন ধর্মীয় নেতার কাছ থেকেই ইসলামকেই প্রশ্নবিদ্ধ করার মতো মন্তব্য এসেছে৷ হঠাৎ ইমামদের এমন তৎপরতা শুরুর কারণও বোঝার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ৷
বিবিসি বাংলা বিভাগ দাবা খেলা সম্পর্কে সৌদি ধর্মীয় নেতার মন্তব্যের যথার্থতা যাচাই করার উদ্দেশ্যে হাজির হয়েছিল বাংলাদেশের স্বনামধন্য দাবাড়ুদের কাছে৷ সৌদি মুফতির মন্তব্যকে যথারীতি প্রত্যাখ্যানই করেছেন তাঁরা৷ দাবাড়ুরা বলেছেন, দাবা একটি নির্দোষ খেলা, যাতে বুদ্ধির চর্চা হয় এবং মস্তিষ্ক ক্ষুরধার হয়৷ বিশ্বখ্যাত দাবাড়ু গ্যারি ক্যাসপারভ-ও এর তীব্র নিন্দা করেছেন৷
খ্যাতিমান মহিলা দাবাড়ু রানি হামিদ জানিয়েছেন, দাবা খেলা সম্পর্কে সৌদি গ্র্যান্ড মুফতির এ ধরনের মন্তব্য শুনে তার খারাপ লেগেছে৷ তিনি বলেন, ‘‘লোকে হয়ত ভাববে, আমরা বুঝি খারাপ কোনো কাজ করছি৷ অথচ আমরা তো দাবা খেলি সময় কাটানোর জন্য, আনন্দের জন্য৷ এটা এত নির্দোষ একটা খেলা৷ দাবা খেললে বুদ্ধির চর্চা হয়, অংকে ভালো করা যায়৷ কারণ এটা তো বুদ্ধির খেলা৷''
রানি হামিদ জানিয়েছেন, তিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দাবা খেলে যাবেন৷
বাংলাদেশের প্রথম গ্র্যান্ড মাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ বলেছেন, দাবা খেলা নিয়ে কোনো নেতিবাচক পদক্ষেপ কখনও টিকতে পারেনি৷ তাঁর মতো, ‘‘ভালোবাসা এবং সংগীত যেভাবে আপনাকে আনন্দ দেয়, দাবা খেলা থেকেও আপনি সেই আনন্দ পেতে পারেন৷''
নিয়াজ মোর্শেদ জানান, ‘‘আয়াতুল্লাহ আলি খামেনেই কিন্তু ইরানে দীর্ঘ সময় দাবা খেলা নিষিদ্ধ করেছিলেন৷ ইরানে এক সময় দাবা খেলা হতো না৷ কিন্তু খামেনেই নিজেই কিন্তু আবার দশ বছর পর এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন৷
সংকলন: আশীষ চক্রবর্ত্তী
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ
বন্ধুরা, আপনারা কি ইমাম সামি আবু-ইউসুফ অথবা সৌদি গ্র্যান্ড মুফতিকে সমর্থন করেন? জানান নীচের ঘরে৷
কেন এত ধর্ষণ? কী করলে কমবে এ জঘন্য অপরাধ?
নারী স্বাধীনতা, নারী আন্দোলন, নারী অধিকার নিয়ে সর্বত্র আলোচনা, সমালোচনা, বক্তৃতা, অন্যদিকে বেড়ে চলেছে ধর্ষণের সংখ্যা৷ কিন্তু কেন? এর জন্য কারা দায়ী, কী করে ধর্ষণ কমিয়ে আনা সম্ভব? বা ধর্ষিতা নারীদের কী-ই বা করা উচিত?
ছবি: Advocate Tanbir ul Islam Siddiqui
নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট
নারী নির্যাতন সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন রিপোর্ট বলছে, বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অহরহ৷ তার ওপর পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধের যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, সেটাও যথার্থ নয়৷ এছাড়া বিশ্বের মোট নারীর ৭ শতাংশ নাকি জীবনের যে কোনো সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷
ছবি: Fotolia/DW
উন্নত বিশ্বের নারীরাও রেহাই পান না
ধর্ষণ শব্দটি শুনলেই মনে হয় এ ধরণের অপরাধ হয়ে থাকে শুধু অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে৷ আসলে কিন্তু মোটেই তা নয়৷ সমীক্ষায় দেখা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে ১৫ বছর বয়স হওয়ার আগেই শতকরা ৩৩ জন মেয়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়৷ এমনকি জার্মানির মতো উন্নত দেশের নারীরাও যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত৷
ছবি: Fotolia/detailblick
ধর্ষিতা নারীরা জানাতে ভয় পান
জার্মানিতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত বা ধর্ষিত নারীদের সঠিক পদ্ধতিতে ‘মেডিকেল টেস্ট’-এর ব্যবস্থা করে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত স্ত্রী বিশেষজ্ঞ ডা. সোনিয়া পিলস বলেন, ‘‘ধর্ষণের শিকার নারী লজ্জায় এবং আতঙ্কে থাকেন৷ তিনি পুলিশের কাছে গিয়ে সে অভিজ্ঞতা বা ধর্ষক সম্পর্কে তথ্য জানাতে ভয় পান, কুণ্ঠা বোধ করেন৷ অনেকদিন লেগে যায় ধর্ষণের কথা কাউকে বলতে৷
ছবি: detailblick/Fotolia
ধর্ষককে ধরার জন্য দ্রুত ডাক্তারি পরীক্ষা
ধর্ষণের পর নারীদের কী করণীয় – এ বিষয়ে জার্মানির ধর্ষণ বিষয়ক নির্দেশিকায় কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে৷ যেমন ধর্ষণের পর একা না থেকে কারো সাথে কথা বলা৷ গোসল, খাওয়া, ধূমপান, বাথরুমে যাওয়ার আগে, অর্থাৎ ধর্ষণের চিহ্ন মুঝে না যাবার আগে ডাক্তারি পরীক্ষা করানো৷ এ পরীক্ষা করালে ধর্ষক কোনো অসুখ বা এইচআইভি-তে আক্রান্ত ছিল কিনা, তা জানা সম্ভব৷ নারীর শরীরে নখের আচড় বা খামচি থাকলে ধর্ষকের চিহ্ন সহজেই পাওয়া যায়৷
ছবি: DW/M. Ruettinger
যাঁরা ধর্ষণের শিকার, তাঁদের জন্য জরুরি বিভাগ
ধর্ষক যেসব জিনিসের সংস্পর্শে এসেছে, অর্থাৎ অন্তর্বাস, প্যাড এ সব তুলে রাখুন৷ ছবিও তুলে রাখতে পারেন৷ নিজেকে দোষী ভাববেন না, কারণ যে ধর্ষণের মতো জঘণ্যতম কাজটি করেছে – সেই অপরাধী, আপনি নন৷ জার্মানির বেশ কয়েকটি শহরের হাসপাতালে যৌন নির্যাতন বিষয়ক আলাদা জরুরি বিভাগ রয়েছে৷ তাছাড়া ধর্ষণ সংক্রান্ত নানা প্রশ্নের উত্তর জানতে রয়েছে ‘গেভাল্ট গেগেন ফ্রাউয়েন’, যেখানে ২৪ ঘণ্টাই টেলিফোন করা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গ্রুপ থেরাপি
যৌন নিগ্রহ বা ধর্ষণের শিকার নারীদের মানসিক ও শারীরিক সমস্যা সমাধানের জন্য জার্মানিতে রয়েছে গ্রুপ থেরাপি, যার সাহায্যে নারীরা আবার সমাজে সহজভাবে মিশতে পারেন এবং তাঁদের জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটি সহজে ভুলে যেতে পারেন৷
ছবি: dpa
সবচেয়ে বেশি যৌন অপরাধ হয় বাড়িতেই
ভারতের কোথাও না কোথাও প্রতি ২২ মিনিটে একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে৷ তাই আদালতের নির্দেশে ভারতের পুলিশ বিভাগ এক সমীক্ষা চালিয়েছিল দিল্লির ৪৪টি এলাকায়৷ চলতি বছরের গত আট মাসে ২,২৭৮টি ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন এবং যৌন অপরাধের তদন্তের ফলাফলে দেখে গেছে: ১,৩৮০টি ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা হলেন পরিবারের লোকজন এবং পরিচিতজনেরা৷ অর্থাৎ নিজের বাড়িতেও মেয়েরা নিরাপদ নয়!
ছবি: Fotolia/Miriam Dörr
সঠিক বিচার চাই
২০১৩ সালের ১৬ই ডিসেম্বর দিল্লিতে গণধর্ষণ ঘটনার পর, ভারতে ঘটা করে বিচার বিভাগীয় কমিশন বসিয়ে ধর্ষণ, যৌন নিগ্রহ দমনে আইন-কানুন ঢেলে সাজানো হয়৷ শাস্তির বিধান আরো কঠোর করা হয়৷ কিন্তু তাতে যৌন অপরাধের সংখ্যা না কমে বরং বেড়েছে৷
ছবি: picture alliance/abaca
বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার
বাংলাদেশে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১১ সালে ৬২০ জন, ২০১২ সালে ৮৩৬ জন, ২০১৩ সালে ৭১৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ মাত্র ছ’মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৩১টি এবং এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮২ জন৷ তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে অপহরণ করে ধর্ষণ এবং পরে হত্যার ঘটনাও অনেক বেড়েছে৷
ছবি: DW
নারীর পোশাকই কি ধর্ষণের জন্য দায়ী?
বাংলাদেশের একজন পুলিশ কর্মকর্তা একটি মার্কিন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘‘বাংলাদেশের নারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেপরোয়াভাবে, বেপর্দায় চলাফেলার কারণে ধর্ষণের শিকার হন৷’’ পুলিশের কর্মকর্তার দাবি, ধর্ষণের দায় প্রধানত নারীদের৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘বখাটে ছেলেরা তো ঘোরাফেরা করবেই৷’’ এ কথা শুধু পুলিশ কর্মকর্তার নয়, ভারত-বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থাই এরকম৷ ধর্ষণ বন্ধ করতে এই মধ্যযুগীয় চিন্তা, চেতনার পরিবর্তন প্রয়োজন৷
ছবি: AFP/Getty Images/M. Uz Zaman
ছোট বেলা থেকে সচেতন করতে হবে
ধর্ষণ সম্পর্কে ছোটবেলা থেকে সঠিক ধারণা দিলে স্বাভাবিকভাবে ধর্ষণের সংখ্যা কমবে৷ তাছাড়া পাঠ্যপুস্তকেও বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া উচিত৷ ধর্ষিতা নারীকে শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার শিকার হতে হয়, সে সম্পর্কেও সচেতনতা দরকার৷ অনেকে যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন৷ গোটা সমাজও নারীকেই দোষ দিয়ে থাকে৷ ডাক্তারি বা মনস্তাত্ত্বিক সাহায্য ছাড়াও প্রয়োজন পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও সমাজের বন্ধুবৎসল আচরণ৷