সোমবার উত্তর ইরাকে কুর্দিদের উপর হামলা চালায় তুরস্ক। ইরাক ও সিরিয়ার কুর্দি যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অভিযানের অংশ এই হামলা।
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবি, সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বাঁচতেই এই হামলা। ছবি: KENZO TRIBOUILLARD/AFP/Getty Images
বিজ্ঞাপন
উত্তর ইরাকে কুর্দিদের শিবির, টানেল, বাসস্থান ও গোলাবারুদ রাখার জায়গায় সোমবার হামলা করেছে তুরস্কের যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার এবং ড্রোন। তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, তাদের দেশকে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বাঁচাতে এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, এখনো পর্যন্ত পরিকল্পনামাফিক অপারেশন হয়েছে। যে সব টার্গেট প্রথম পর্যায়ে চিহ্নিত করা হয়েছিল, তাতে হামলা করা সম্ভব হয়েছে। তিনি অবশ্য হতাহতের কোনো সংখ্যা দেননি।
বলা হয়েছে, উত্তর ইরাকে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি বা পিকেকে-র নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকায় আক্রমণ শানিয়েছে তুরস্ক। তাদের দাবি, ওই এলাকা থেকে তুরস্কের উপর হামলা চালানো হয়।
কুর্দি কারা, কোথায় থাকে?
কুর্দিশ ইন্সটিটিউট অফ প্যারিসের ২০১৭ সালের হিসেবে বিশ্বে কুর্দিদের আনুমানিক সর্বোচ্চ সংখ্যা সাড়ে চার কোটির বেশি৷ আর্মেনিয়া, ইরাক, ইরান, সিরিয়া ও তুরস্কে বেশিরভাগ কুর্দির বাস৷
ছবি: Reuters/A. Lashkari
কুর্দির সংখ্যা ও ধর্ম
কুর্দিশ ইন্সটিটিউট অফ প্যারিসের ২০১৭ সালের হিসেবে বিশ্বে কুর্দিদের আনুমানিক সর্বোচ্চ সংখ্যা সাড়ে চার কোটির বেশি৷ তাদের বেশিরভাগই সুন্নি মুসলমান৷ বাকিরা শিয়া, অ্যালেভিজম, ইয়াদিজম, ইয়ারসানিজমসহ অন্যান্য ধর্মের অনুসারী৷ কুর্দিদের ভাষা অনেকটা ফার্সির মতো৷
ছবি: AFP/D. Souleiman
স্বাধীনতার প্রায় কাছাকাছি
অটোমান সাম্রাজ্যের শেষ দিকে ১৮৯০ দশকে কুর্দি জাতীয়তাবাদ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২০ সালে স্বাক্ষরিত এক চুক্তিতে কুর্দিদের স্বাধীনতা দেয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছিল৷ কিন্তু মাত্র তিন বছর পরই সেই চুক্তি ছিড়ে ফেলেন তুর্কি নেতা কামাল আতাতুর্ক৷ এরপর ১৯২৪ সালে অনুমোদন পাওয়া আরেক চুক্তির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে সৃষ্টি হওয়া দেশগুলোর মধ্যে কুর্দিদের আবাসস্থল ভাগ হয়ে যায়৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Souleiman
যেখানে থাকে
বর্তমানে বেশিরভাগ কুর্দির বাস আর্মেনিয়া, ইরাক, ইরান, সিরিয়া ও তুরস্কে৷ সেসব দেশে তারা মাঝেমধ্যে স্বশাসনের দাবি তুলে ধরে৷ এছাড়াও বিশ্বের অনেক দেশে কুর্দিরা বাস করেন৷
ছবি: Getty Images/C. Court
সিরিয়া
আরব বসন্ত শুরুর আগে সিরিয়ার জনসংখ্যার ৮-১০ শতাংশ ছিল কুর্দি৷ ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে লড়তে তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র৷ আর সিরিয়ার সরকার মূলত ব্যস্ত ছিল সুন্নি আরব বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করতে৷ ফলে একসময় কুর্দিরা সিরিয়ার প্রায় এক-চতুর্থাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে সক্ষম হয়৷ তবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার কুর্দি এলাকা থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিলে তুরস্ক সেখানে হামলা শুরু করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Souleiman
তুরস্ক
তুরস্কের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ কুর্দি৷ স্বশাসনের দাবিতে ১৯৮৪ সালে সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয় কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি, পিকেকে৷ সেই থেকে সংঘাতে প্রায় ৪০ হাজার জন প্রাণ হারিয়েছেন৷ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও তুরস্ক পিকেকে-কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে৷ তুর্কি প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান অবশ্য কুর্দি ভাষা ব্যবহারের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/N. Al-Khatib
ইরাক
উত্তরাঞ্চলের তিন রাজ্যে কুর্দিদের বাস৷ মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫-২০ শতাংশ৷ ১৯৮০-র দশকে সাদ্দাম হোসেন কুর্দিদের বিরুদ্ধে রাসায়নিক গ্যাস ব্যবহার করেছিলেন৷ ২০১৪ সালে আইএস ইরাকের একটি অংশ দখল করলে কেন্দ্রীয় সরকার দুর্বল হয়ে পড়ে৷ সেই সুযোগ কির্কুকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছিল কুর্দিরা৷ পরে ২০১৭ সালে স্বাধীনতার দাবিতে গণভোটের আয়োজন করে ব্যর্থ হয় তারা৷ উলটো বাগদাদের কাছ থেকে প্রতিশোধের শিকার হয় কুর্দিরা৷
ছবি: picture-alliance/AP/K. Mohammed
ইরান
ইরানের জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ কুর্দি৷ তুরস্কের পিকেকে সংগঠনের অনুসারী ইরানের ‘পার্টি অফ ফ্রি লাইফ অফ কুর্দিস্তান’এর বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি নিয়োগ করা হয়েছিল৷ সংগঠনটি ইরানের কুর্দিদের জন্য আরও বেশি সায়ত্ত্বশাসনের দাবি জানিয়েছিল৷ ইরানের কুর্দিরা বৈষম্যের শিকার ও তাদের নেতাদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড, এমনকি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় বলে মানবাধিকার সংস্থাগুলো অভিযোগ করে থাকে৷
ছবি: IRNA
7 ছবি1 | 7
তুরস্কের দাবি
তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দাবি, কুর্দিরা তুরস্কের উপর ব্যাপক হামলার প্রস্তুতি নিয়েছিল। তুরস্ক তাই বন্ধু ও শরিকদের সঙ্গে সমন্বয় করে কুর্দিদের উপর হামলা করেছে।
এই বন্ধু ও শরিক কারা তা প্রতিরক্ষামন্ত্রী জানাননি। তবে গত সপ্তাহে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান কুর্দ স্বশাসিত এলাকার প্রধানমন্ত্রী বারজানির সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। তুরস্কের ভয় হলো, কুর্দিরা স্বাধীন কুর্দিস্তান গঠন করতে পারলে তারা তুরস্কের উপর হামলা করবে। তাই তারা ইরাক ও সিরিয়ায় কুর্দিদের দুর্বল করতে চাইছে।
মুক্তির লড়াইয়ে কুর্দি নারী
নিজেদের অধিকার আদায়ে দীর্ঘদিন ধরেই লড়াই সংগ্রাম করে যাচ্ছেন কুর্দিরা৷ এখনো আসেনি কাঙ্খিত স্বাধীনতা৷ তাই মুক্তিকামী কুর্দিস্তান ফ্রিডম পার্টির পেশমারগা বাহিনীতে যুক্ত হলেন কুর্দি নারীরা৷
ছবি: Reuters/A. Rasheed
মুক্তির তীরন্দাজ
লড়াই সংগ্রামটা দীর্ঘদিনের৷ আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি কুর্দিদের অধিকার৷ তবুও হার মানা যাবে না৷ তাই ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে সামিল হলেন নারীরাও৷ পেশমারগা যোদ্ধাদের পায়ে পা মিলিয়ে লড়াই চান কুর্দি নারীরা৷ শুরু হলো প্রশিক্ষণ৷
ছবি: Reuters/A. Rasheed
বাধার দেয়াল পেরিয়ে
অস্ত্র হাতে যুদ্ধ নামলেই শুধু হয় না৷ আয়ত্ত্ব করতে হয় আরো সব সামরিক কৌশল৷ প্রতিপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে, দুর্গম পথ পাড়ি দেবার কৌশলটাও তো চাই৷ তাই শারীরিক কসরতের প্রশিক্ষণটাও নিচ্ছেন কুর্দি নারীরা৷
ছবি: Reuters/A. Rasheed
পায়ে পায়ে হেঁটে যাবো
মুক্তিকামীদের ঠেকানো খুব মুশকিল৷ ইরাকের ইরবিলে সেনাবাহিনীর পোশাকে মার্চ পাস্ট করে এগিয়ে যাচ্ছেন কুর্দি নারীরা৷ তারা এখন যোদ্ধা৷ তৈরি করছেন নিজেদের৷ লড়াই শুধু নিজের নয়, কুর্দিদের অধিকার আদায়ের৷
ছবি: Reuters/A. Rasheed
পাড়ি দিতে বন্ধুর পথ
অস্ত্র চালানো আর শারীরিক কৌশল তো গেল৷ কিন্তু যুদ্ধ মানেই তো পাড়ি দিতে হবে চড়াই-উৎরাই আর বন্ধুর পথ৷ তাই সম্মুখ যুদ্ধে যাওয়ার আগে নারী সেনারাও ঝালিয়ে নিচ্ছেন নিজেদের৷ পথ যতো কঠিন হোক,পাড়ি দিতে হবে দিগন্ত৷
ছবি: Reuters/A. Rasheed
কৌশলী পদচারণ
প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে যুদ্ধ কৌশলের কোনো শেষ নেই৷ ছবিটিই তার প্রমাণ৷ হাত উঁচিয়ে অস্ত্রের স্পর্শ এড়িয়ে পাড়ি দিতে হবে কঠিন পথ৷ কুর্দি নারীরাও বেশ মনোযোগ দিয়েই রপ্ত করে নিচ্ছেন এই সেনা কৌশল৷
ছবি: Reuters/A. Rasheed
উপসংহার: মার্শাল আর্ট
হাতে অস্ত্র না থাকলেও তো লড়ে যায় বীর৷ তার জন্যেও আছে প্রস্তুতি৷ তাই মার্শাল আর্টে পিছিয়ে থাকবেন না কুর্দি নারীরা৷ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন বলে কথা, সব প্রস্তুতি নিয়ে হানা দিতে চান প্রতিপক্ষ শিবিরে৷
ছবি: Reuters/A. Rasheed
6 ছবি1 | 6
তবে ইরাকে স্বশাসিত অঞ্চল যারা শাসন করে, সেই কুর্দিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি তুরস্কের সঙ্গে আছে।
অরাকেশন ক্ল লক
তুরস্ক এই অপারেশনের নাম দিয়েছে 'ক্ল লক'। তাদের দাবি, সীমান্ত সুরক্ষার জন্য তারা এই অপারেশন করছে। তাই সীমান্তে তারা গোলাবর্ষণও করছে। তারা পিকেকের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। অ্যামেরিকা এবং ইইউ পিকেকে-কে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বলে চিহ্নিত করেছে। এই গোষ্ঠী ১৯৮৪ সাল থেকে তুরস্কের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এখনো পর্যন্ত এই সংঘাতে ৪০ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন।