ইরাকে বাংলাদেশিরা এক ভীতিকর অবস্থার মধ্যে আছেন৷ তাঁরা শিকার হচ্ছেন নির্যাতনের৷ তাঁরা শিয়া-সুন্নি উভয় পক্ষের হাতেই মার খাচ্ছেন৷ অনেকে দেশে ফিরে আসতে চাইলেও সুযোগ পাচ্ছেন না৷ আর কেউ কেউ মানবেতর জীবনযাপন করছেন৷
ছবি: Reuters
বিজ্ঞাপন
ইরাকের বিভিন্ন স্থানে কর্মরত ৪১ জন বাংলাদেশি মঙ্গলবার দেশে ফিরে এসেছেন৷ সকালে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে এসে পৌঁছান তাঁরা৷ তাঁদের কথায়, ইরাকের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশিরা খুবই ভীতিকর অবস্থায় আছেন৷ অনেক সময় ইরাকি পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে তাঁদের নির্যাতনের শিকারও হতে হচ্ছে৷
বেশ কয়েকজন ইরাক ফেরত শ্রমিক জানান, শুধু সুন্নি বিদ্রোহী নয়, তাঁরা শিয়া নিরাপত্তা বাহিনীর হাতেও নির্যাতিত হয়েছেন৷ সুন্নি পরিচয় পেলেই পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা তাঁদের ওপর নির্যাতন করেছে৷ বন্দুকের নল ঠেকিয়ে গুলি করার হুমকি দিয়েছে৷ তাই ভয়ে তাঁরা নিজ খরচে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন৷
ইরাকে জিহাদিবিরোধী যুদ্ধ
চরমপন্থি ইসলামি সংগঠন আইএস-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে ইরাকে৷ সন্ত্রাসবাদী এ সংগঠনটির সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশেও তৎপরতা রয়েছে৷ দেখুন ইরাকে আইএস-বিরোধী যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট কিছু ছবি৷
ছবি: Reuters
টিকরিট পুনরুদ্ধারের চেষ্টা
সুন্নিদের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া (আইসিস) উত্তর ও দক্ষিণ ইরাকের কিছু অংশ দখল করে নিয়েছে৷ বাগদাদ থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরের শহর টিকরিটও এখন তাদের দখলে৷ সে এলাকায় ইরাক সরকারের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের জন্য আইসিস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়ছে সেনাবাহিনী৷
ছবি: Reuters
মধ্যপ্রাচ্যে কর্তৃত্ব চায় আইসিস
আন্তর্জাতিক ইসলামি জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার সঙ্গে আইসিস-এর একসময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ ২০০৬ থেকে ২০০৭-এর দিকে ইরাকে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াই চলছে তখনই আইসিস-এর জন্ম৷ সংগঠনটির লক্ষ্য সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, ফিলিস্তিন এবং জর্ডান মিলিয়ে বেশ বড় একটা অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা৷ ইরাকে নুসরা ফ্রন্টসহ বেশ কিছু সংগঠন তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
বিদ্রোহীদের পাশে যুক্তরাষ্ট্র
সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ আর ইরাকে নুরি আল মালিকির সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বিদ্রোহীদের মধ্যে মধ্যপন্থি এবং মৌলবাদী সংগঠনের কর্মী রয়েছে৷ সিরিয়ায় ন্যাশনাল কোয়ালিশনের মতো কিছু মধ্যপন্থি সংগঠনকে সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র৷ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামা বিদ্রোহীদের একাংশকে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখছেন৷
ছবি: Reuters
ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি জানিয়েছেন, কংগ্রেস বিদ্রোহীদের জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব অনুমোদন করলে তা সিরিয়া এবং ইরাকে দেয়া হবে৷ এই বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ, কেননা, ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বড় একটা অংশ যে আইসিস-এর কাছে যাবেনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই৷
ছবি: Reuters
কুর্দিরা চায় স্বাধীন কুর্দিস্তান
যুক্তরাষ্ট্র চায় ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকি সুন্নি এবং কুর্দিদের অংশিদারিত্বের সরকার গঠন করুন৷ ইরাকের কিছু অংশে কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসন রয়েছে৷ কুর্দিরা ‘পেশমেরগা’, অর্থাৎ কুর্দিদের স্বাধিকার আন্দোলনের অংশ হিসেবে আইসিসের বিরুদ্ধে লড়ছে৷ কুর্দিদের মূল লক্ষ্য ইরাকে স্বাধীন কুর্দিস্তান প্রতিষ্ঠা করা৷
ছবি: Reuters
ইরানের ভূমিকা
ইরাকে শিয়া-সুন্নি সংঘাতের মধ্যে জড়াতে চায়না ইরান৷ কিন্তু শিয়া প্রধান দেশ ইরানের সরকার ইরাকের মালিকি সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে বলে ধারণা করা হয়৷ নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইসিস-বিরোধী যুদ্ধে মালিকি সরকারকে ড্রোন এবং অন্যান্য সমর উপকরণ দিয়ে সহায়তা করছে ইরান সরকার৷
ছবি: Atta Kanare/AFP/Getty Images
এক হাজারেরও বেশি নিহত
সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের সমর্থন দিচ্ছে সৌদি আরব৷ ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকি মনে করেন, আইসিসকেও মদদ দিচ্ছে সৌদি সরকার৷ ইরাকে চলমান সংঘাতে কমপক্ষে এক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে৷ মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ জন্য ইরাক সরকার এবং আইসিস-এর কঠোর সমালোচনা করেছে৷
ছবি: Reuters
বাড়ছে শরণার্থী
আইসিসের হামলা শুরুর পর থেকে ইরাকের বিভিন্ন স্থান থেকে অন্তত ১২ লাখ মানুষ ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন৷ সিরিয়া সংকট শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত আড়াই লাখ সিরীয় স্বায়ত্তশাসিত কুর্দি রাজ্যগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে৷ এখন আইসিসের দখল করে নেয়া শহরগুলো থেকে পালিয়ে ইরাকিরাও আসছে৷ ছবিতে খাজাইর চেকপয়েন্ট অতিক্রম করে কুর্দিদের নিয়ন্ত্রিত শহর এরবিলের দিকে যেতে দেখা যাচ্ছে মসুল থেকে আসা ইরাকিদের৷
ছবি: Getty Images
স্বেচ্ছাসেবীরাও নেমেছে যুদ্ধে
প্রধানমন্ত্রী মালিকি জানিয়েছেন, রাশিয়া আর বেলারুশের কাছ থেকে পুরোনো যুদ্ধ বিমান কিনেছে ইরাক৷ আইসিসের বিরুদ্ধে সেগুলো ব্যবহার করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি৷ বাড়ছে সমরাস্ত্র৷ বাড়ছে যোদ্ধা৷ স্বেচ্ছাসেবীরাও যোগ দিচ্ছেন আইসিস বিরোধী যুদ্ধে৷
ছবি: Reuters
9 ছবি1 | 9
নির্যাতনের শিকার সাইফুল ইসলাম তাঁর ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘‘আমার দাড়ি ছিল, পাসপোর্ট আছে৷ তারপরও আমার ওপর অকথ্য নির্যাতন করা হয়েছে৷ আমার পায়ের গোড়ালিতে বার বার আঘাত করেছে তারা৷''
জিম্মি দশায় নির্যাতনের শিকার অপর এক বাংলাদেশি শ্রমিক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘‘আমাদের ওপর যে পরিমাণ নির্যাতন হয়েছে, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়৷ সেই ঘটনা মনে পড়লে এখনো আমাদের গা শিউরে ওঠে৷''
শ্রমিকরা জানিয়েছেন, তাঁদের ফিরে আসতে প্রত্যেককে বিমানের টিকিট বাবদ খরচ করতে হয়েছে ৫৫ হাজার টাকা৷ টাকার অভাবে আরো প্রায় ছয় হাজার শ্রমিক দেশে ফিরতে পারছে না বলেও জানান তাঁরা৷
জিম্মি দশা থেকে বাংলাদেশে ফেরত আসা শ্রমিক আবু বকর বলেন, ‘‘আমার বাড়ি থেকে ৫৫ হাজার টাকা দিয়ে টিকেট কেটে পাঠিয়েছে, তাই আমি দেশে আসতে পেরেছি৷ আমার মতো অসংখ্য মানুষ ইরাকে রয়েছেন, যাঁরা এই টাকা যোগার করতে না পারায় দেশে ফিরতে পারছেন না৷''
রাকের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশিরা খুবই ভীতিকর অবস্থায় আছেনছবি: Reuters
ইরাকে বাংলাদেশি দূতাবাসের বিরুদ্ধে তাঁরা নির্লিপ্ততার অভিযোগ তুলে বলেন, ‘‘আমাদের ওপর এত অত্যাচার সত্ত্বেও সেখানকার প্রতিনিধি কোনো উদ্যোগ নেয়নি৷ দূতাবাসে ফোন করার পর তারা শুধু বলেছে – ‘আমরা দেখছি'৷''
ফিরে আসা এই শ্রমিকরা বাগদাদ এবং ইরাকের বিভিন্ন শহরের নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন৷ তাঁরা জানান যে, মসুলে ১,৫০০ বাংলাদেশি আছেন, যাঁরা সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন৷
সরকারি হিসেবে বাংলাদেশের ১৪ হাজার নাগরিক এখন ইরাকে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত৷ তাঁরা প্রধানত নির্মাণ শিল্পে কাজ করেন৷ তবে বাস্তবে সেখানে ৩০ হাজারের মতো বাংলাদেশি শ্রমিক আছেন৷
উল্লেখ্য, গত ১লা জুলাই আরো ২৭ জন বাংলাদেশি নিজ খরচে ইরাক থেকে দেশে ফিরে আসেন৷ যদিও বাংলাদেশ সরকার এর আগে সরকারি খরচে বাংলাদেশিদের ফেরত আনার কথা বলেছিল৷