ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের ২০ বছর হয়ে গেল। যে কারণ দেখিয়ে এই আগ্রাসন হয়েছিল, তা ছিল মিথ্যা। তার ফল এখনো ভোগ করতে হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
দুই দশক পরেও ইরাকে সহিংসতা, হত্যা থামেনি। গত ফেব্রুয়ারিতেও বোমা, গুলি ও অন্য সহিংসতার বলি হয়েছেন ৫২ জন। ২০০৩ সালের ১৮-১৯ মার্চ-এ যে আগ্রাসন শুরু হয়েছিল, এ হলো তারই প্রভাব।
মার্কিন জোটের আগ্রাসন ও প্রচারের সামনে ইরাক কিছুই করতে পারেনি। সেই জোটে অ্যামেরিকা ছাড়াও ছিল অস্ট্রেলিয়া ও পোল্যান্ড।
তিন সপ্তাহের মধ্যে সাদ্দামের স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটে। এয়ারক্রাফট কেরিয়্যার ইউএসএস আব্রাহাম লিংকনের ডেকে দাঁড়িয়ে সেই সময়ের প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ঘোষণা করেন, মিশন সফল।
সেই সময় পর্যন্ত অ্যামেরিকা ও তার জোটসঙ্গীরা ২৯ হাজার ১৬৬টি বোমা ও রকেট ইরাকে ফেলেছিল। ইরাকি পরিকাঠামোর বড় অংশ মাটিতে মিশে গেছিল। ব্রিটিশ এনজিও বেবিকাউন্টের হিসাব, সাত হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষ মারা গেছিলেন। সবমিলিয়ে মৃতের সংখ্যা দুই লাখ থেকে ১০ লাখের মধ্যে।
২০১১ সালে মার্কিন সেনা ইরাক ছাড়ে। পরে তারা ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আবার ফিরে আসে।
যুদ্ধ জয়ের পরেও শান্তি ফিরলো না
ইরাকে অ্যামেরিকার ধাঁচে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ইরাকের পরিস্থিতি ও সামাজিক অবস্থান ছিল আলাদা। সেখানে ধর্মীয় ও জাতিগত জটিলতা ছিল প্রবল। মার্কিন অধিকারে থাকা প্রশাসনের সেই প্রস্তুতিও ছিল না। ২০০৩ সালের ১৯ অগাস্ট বাগদাদে জাতিসংঘের অফিস চত্বরে বিস্ফোরণে ২২ জনের মৃত্যু হয়।
সাবেক ন্যাটো সেক্রেটারি জেনারেল জাবিয়ার সোলানা বলেছিলেন, যদি এই অভিযানের লক্ষ্য থাকে ইরাককে সন্ত্রাসমুক্ত করা, তার পুনর্গঠন ও সর্বস্তরে সুরক্ষা বাড়ানো, তাহলে এই লক্ষ্যপূরণ হয়নি।
আন্তর্জাতিক আইনভঙ্গ
আইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কাই অ্যামবোস ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ''যেভাবে ইরাক আক্রমণ করা হয়েছে, তা জাতিসংঘের চার্টার ও আন্তর্জাতিক আইনের বিরোধী। জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে এই আগ্রাসন হয়নি। তাহলে একমাত্র আত্মরক্ষার জন্যই এই ধরনের আগ্রাসন করা যেতে পারে।''
অ্যামবোস জানিয়েছেন, ''এখানে আত্মরক্ষার কোনো বিষয় ছিল না।'' তাছাড়া সেই সময়ে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল কোফি আন্নান বলেছিলেন, ওই আগ্রাসন 'বেআইনি'।
ইরাক আগ্রাসনের ১৬ বছর
গত ২০ মার্চ পূর্ণ হলো যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন যৌথ বাহিনীর ইরাক আগ্রাসনের ১৬ বছর৷ বিশ্ব রাজনীতিতে যার প্রভাব ছিল সুদূর প্রসারী৷
ছবি: picture-alliance/Us Air Force/M. Bruch
বুশ প্রশাসনের পরিকল্পনা
২০০২ সালের ১১ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশকে ইরাকের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি ব্যবহারের অনুমতি দেয় মার্কিন কংগ্রেস৷ সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে – এমন তথ্য দিয়ে এই যুদ্ধের অনুমতি চান বুশ প্রশাসন৷ ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইরাকের বিরুদ্ধে সামরিক হামলার জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আহ্বান জানান৷
ছবি: AP
শুরু হল আক্রমণ
২০ মার্চ ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন সামরিক বাহিনী সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাতে কুয়েত থেকে ইরাকের উপর হামলা শুরু করে৷ সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই ইরাকের সামরিক আস্তানা তারা গুড়িয়ে দেয়৷
ছবি: picture-alliance/Us Air Force/M. Bruch
বাগদাদ দখল
আক্রমণ শুরুর ২০ দিনের মাথায় ইরাকের রাজধানী বাগদাদের পতন হয়৷ আত্মগোপন করেন সাদ্দাম হোসেন৷ আইন-শৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি হয় সেখানে৷ যা ফেরাতে ব্যর্থ হয় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যুদ্ধের সমাপ্তি
এক মে প্রেসিডেন্ট বুশ ‘ইরাক যুদ্ধের’ সমাপ্তি ঘোষণা করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এই যুদ্ধে আমরা এবং আমাদের মিত্ররা বিজয়ী হয়েছি৷’’ যুদ্ধে নিয়োজিত আব্রাহাম লিংকন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার থেকে এই ঘোষণাটি দেন৷ ছবিতে ক্রদের সাথে তাঁকে বিজয় উদযাপন করতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: AP
ধরা পড়লেন সাদ্দাম
১৩ ডিসেম্বর ২০০৩ সালে তিকরিতের কাছের একটি গুহা থেকে মার্কিন সৈন্যরা সাদ্দাম হোসেনকে আটক করে৷ এ সময় তার মুখ ভর্তি ছিল দাড়িতে৷ ১৪৮ জনকে হত্যার অভিযোগে দুই বছরের মাথায় তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়৷
ছবি: APTN
আবু গারিব কাণ্ড
ইরাক দখলের পর বাগদাদের কাছের আবু গারিব কারগারকে বন্দীশালা হিসেবে ব্যবহার করে মার্কিন বাহিনী৷ ২০০৪ সালের এপ্রিলে এই কারাগারের বন্দীদের উপর মার্কিন সেনাদের অমানবিক আচরণের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়৷ যার কারণে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক সমালোচনায় পড়ে যুক্তরাষ্ট্র৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উত্থান
মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে ইরাকে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উত্থান হয় ২০০৩ সালের শেষ থেকেই৷ ফাল্লুজা সহ সুন্নী মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে৷ শুরু হয় আত্মঘাতি বোমা হামলা৷
ছবি: AP
সৈন্য প্রত্যাহার
১৭ নভেম্বর ২০০৮ সালে ইরাক এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সৈন্য প্রত্যাহারের চুক্তি হয়৷ সে অনুযায়ী, ২২ মে ২০১১ সালে ব্রিটিশ বাহিনী ইরাক ছাড়ে৷ একই বছরের ডিসেম্বরের ১৮ তারিখ মার্কিন সৈন্যরা ইরাক ত্যাগ করে৷
ছবি: AP
গণবিধ্বংসী অস্ত্র কোথায়?
যেই অজুহাতে ইরাক আক্রমণ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র সেই গণবিধ্বংসী অস্ত্রের শেষ পর্যন্ত সন্ধান মেলেনি৷ ২০০৪ সালের ২৮ জানুয়ারিতেই মার্কিন অস্ত্র অনুসন্ধানকারী ডেভিড কে কংগ্রেসকে জানান ইরাকের গণবিধ্বংসী অস্ত্রের ব্যাপারে ‘‘আমরা সম্পূর্ণ ভুল ছিলাম’’৷
ছবি: AP
মানবিক বিপর্যয়
এই আগ্রাসণে কমপক্ষে ১,৩৪,০০০ বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে বলে গবেষণা তথ্য রয়েছে৷ সব মিলিয়ে মৃতের সংখ্যা ১,৭৬,০০০ থেকে ১,৮৯,০০০ হাজারে হতে পারে৷
জার্মানি এই যুদ্ধে অংশ নেয়নি। তবে জার্মানি এই আগ্রাসন সমর্থন করেছিল এবং গোয়েন্দা তথ্য দিয়েছিল এবং অর্থও দিয়েছিল। এভাবে তারা বেআইনি আগ্রাসনকে সমর্থন করেছিল বলে অ্যামবোস জানিয়েছেন।
অত্যাচার ও যুদ্ধাপরাধ
২০০৪-এর প্রথমদিকের মধ্যে যুদ্ধাপরাধ ও অত্যাচারের যে খবর সামনে আসে, তাতে অ্যামেরিকার ভাবমূর্তি আরো ক্ষুণ্ণ হয়। সাদ্দামের আমলে কুখ্যাত জেলে মার্কিন আগ্রাসনের সময়কার যে ছবি সামনে আসে তাতে শিউরে উঠতে হয়।
মার্কিন সেনা বেসামরিক মানুষের উপরও অত্যাচার করে। ২০০৫-এ হাদিথাতে মার্কিন নৌসেনা গুলি করে ২৪ জন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে। ২০০৭-এ মার্কিন কনট্রাক্টর গুলি করে ১৭ জনকে মারে। উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন হেলিকপ্টার নিরপরাধ মানুষের উপর আক্রমণ চালিয়েছে।
ইরাকে পঙ্গুদের একটি গ্রাম
যুদ্ধের পর পড়ে থাকা স্থলমাইনের আঘাতে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারিয়েছেন ইরাকের জুরফ আল-মিল গ্রামের শতশত বাসিন্দা৷ ফলে গ্রামটি এখন পঙ্গুদের গ্রাম নামে পরিচিত৷
ছবি: Reuters/E. Al Sudani
যুদ্ধের পরিণতি
১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত যুদ্ধে লিপ্ত ছিল ইরাক আর ইরান৷ সেই সময় হতাহতের ঘটনা তো ঘটেছেই৷ তবে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে৷ হারাতে হয়েছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ৷
ছবি: Reuters/E. Al Sudani
পরিচিতি
ইরাকের বসরা শহরের পূর্বের একটি গ্রাম জুরফ আল-মিল৷ তবে সেখানে অঙ্গপ্রত্যঙ্গহীন মানুষের সংখ্যা এত বেশি যে, স্থানীয়ভাবে সেটি ‘আল বিট্রান’ নামে পরিচিত পেয়েছে৷ আল বিট্রান মানে হচ্ছে পঙ্গু৷
ছবি: Reuters/E. Al Sudani
কারণ স্থলমাইন
যুদ্ধের সময় ইরানিরা বিমান থেকে ঐ গ্রামে বোমাবর্ষণ করলে অনেকে পালিয়ে অন্য জায়গায় চলে গিয়েছিলেন৷ পরে ফিরে আসেন৷ তবে তাঁরা জানতেন না যে, তাঁদের গ্রামের আশেপাশে স্থলমাইন পোঁতা আছে৷ ফলে অনেক গ্রামবাসী মেষ চড়াতে গিয়ে এসব মাইনের বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন৷ ছবিতে এক পঙ্গু দম্পতিকে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/E. Al Sudani
সামরিক সরঞ্জামের অংশবিশেষ
যুদ্ধের পর গ্রামবাসীরা তাঁদের এলাকায় বেশ কিছু সামরিক কামান, বন্দুক ইত্যাদি পড়ে থাকতে দেখেন৷ ১৯৯১ সালে কুয়েত দখল করার কারণে ইরাকের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা নেমে এলে দারিদ্র্য দেখা দেয়৷ তখন গ্রামবাসীরা পড়ে থাকা ঐ সামরিক সরঞ্জামাদির অংশবিশেষ সংগ্রহ করে সেগুলো বিক্রি করে জীবন চালাতেন৷ কিন্তু তা করতে গিয়েও অনেকে হাত-পা হারান৷
ছবি: Reuters/E. Al Sudani
আন্তর্জাতিক সহায়তা
দক্ষিণ ইরাকে পঙ্গুদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক রেডক্রসের সহায়তায় ১৯৯৫ সালে সেখানে কৃত্রিম হাত-পা তৈরির একটি ওয়ার্কশপ চালু হয়৷ সেখানে আল বিট্রান গ্রামের পঙ্গু ছাড়াও অন্যান্য কারণে পঙ্গু হওয়াদের জন্যও কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বানানো হয়৷
ছবি: Reuters/E. Al Sudani
মাইন সরানো শুরু হয়েছে
অবশেষে শিয়া একটি আধা সামরিক বাহিনী বুলডোজার ও অন্যান্য বিশেষ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে আল বিট্রানের আশেপাশের এলাকা মাইনমুক্ত করার কাজ শুরু করেছে৷
ছবি: Reuters/E. Al Sudani
6 ছবি1 | 6
মিথ্যা যুক্তি
অ্যমেরিকা বলেছিল, ইরাকের হাতে এমন অস্ত্র আছে, যা দিয়ে ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালানো সম্ভব। দেখা গেছে, এমন কোনো অস্ত্র ইরাকের হাতে ছিল না। অ্যামেরিকার এই যুক্তি মিথ্যা ছিল। অ্যামেরিকার যুক্তি ছিল, সাদ্দামের সঙ্গে আল কায়দা ও ওসামা বিন লাদেনের সম্পর্ক ছিল। এই যুক্তিও মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
হার্ভার্ডের অধ্যাপক স্টিফেন ওয়াল্ট বলেছেন, ''আসলে অ্যামেরিকা আগে ঠিক করে নিয়েছিল তারা কী করবে। তারপর তারা যুক্তি সাজিয়েছিল। এমন নয়, গোয়েন্দারা এইসব তথ্য দিয়েছিলেন। এই সব যুক্তি তৈরি করা হয়েছিল।''