বুধবার ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বে কোয়ালিশন বাহিনীর উপর রকেট হামলার পর বৃহস্পতিবার ইরান সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়া বাহিনীর উপর পালটা হামলা চালানো হয়েছে৷ ফলে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে৷
বিজ্ঞাপন
বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাস আতঙ্কের ফলে জনজীবন স্তব্ধ হয়ে গেলেও অনেক প্রান্তে সামরিক সংঘাত বন্ধ হচ্ছে না৷ ইরাকে মোতায়েন মার্কিন সেনাবাহিনী বৃহস্পতিবার ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া বাহিনীর স্থাপনার উপর ‘প্রতিরক্ষামূলক' বিমান হামলা চালিয়েছে৷ বুধবার বাগদাদ শহরের বাইরে তাজি সামরিক ঘাঁটির উপর হামলায় দুই মার্কিন ও এক ব্রিটিশ সৈন্য নিহত ও ১২ জন আহত হবার পর মার্কিন বাহিনী এমন প্রতিশোধমূলক হামলা চালালো৷ কোয়ালিশন বাহিনীর উপর কমপক্ষে ১৮টি রকেট হামলা চালানো হয়েছিল৷ তারপর অ্যামেরিকা ও ব্রিটেন এর পর পালটা হামলার ইঙ্গিত দেয়৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প সেনাবাহিনীকে সেই অধিকার দিয়েছেন৷
আপাতত অ্যামেরিকার নিশানা কাতাইব হেজবোল্লাহ গোষ্ঠী৷ মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুযায়ী বৃহস্পতিবার এই গোষ্ঠীর পাঁচটি অস্ত্রের গুদামের উপর হামলা চালানো হয়৷ ফলে এই গোষ্ঠী ভবিষ্যতে অ্যামেরিকার নেতৃত্বে কোয়ালিশন বাহিনীর উপর সহজে হামলা চালাতে পারবে না বলে আশা করছে ওয়াশিংটন৷ উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক কালে এই নিয়ে তিনবার কাতাইব হেজবোল্লাহর উপর হামলা চালালো ওয়াশিংটন৷ ভবিষ্যতেও দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাতের আশঙ্কা করা হচ্ছে৷
একই রাতে ইরাকের সীমান্তের কাছে সিরিয়ায় হামলা চালিয়ে কমপক্ষে হাশাদ আল শাবি গোষ্ঠীর ২৬ জন শিয়া মিলিশিয়াকে হত্যা করা হয়েছে৷ সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের ধারণা, কোয়ালিশন বাহিনীর উপর হামলার প্রতিশোধ নিতে সেখানে মার্কিন সামরিক হামলা চালানো হয়েছে৷
ইরাকের ভূখণ্ডে ইরানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা মেনে নেওয়া অ্যামেরিকার জন্য মোটেই সহজ নয়৷ তথাকথিত ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে বাধ্য হয়ে ইরানের সঙ্গে সহযোগিতার পথে গেলেও দুই পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামরিক সংঘাত সাম্প্রতিক কালে বেড়ে চলেছে৷
ইরাকের সরকার বর্তমান পরিস্থিতিতে উভয় সংকটে পড়েছে৷ প্রেসিডেন্টের দফতর কোয়ালিশন বাহিনীর উপর বুধবারের হামলার নিন্দা করেছে৷ এর ফলে ইরাক ও সে দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে৷ সেইসঙ্গে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, যে ইরাকের সরকারের অনুরোধেই কোয়ালিশন বাহিনী আইসিস সন্ত্রাসবাদীদের দমনের কাজে সহযোগিতা করছে৷ অন্যদিকে মার্কিন সৈন্যদের উপস্থিতি নিয়ে দেশে অসন্তোষের ফলে ইরাকের সরকার চাপের মুখে রয়েছে৷ বিশেষ করে ইরাকের ভূখণ্ডে ইরানের কুদস বাহিনীর জেনারেল কাসেম সোলেইমানির হত্যাকাণ্ডের পর থেকে উত্তেজনা আরও বেড়ে গেছে৷ জানুয়ারি মাসে ইরাকের সংসদ এক প্রস্তাব পাশ করে সরকারকে দেশ থেকে বিদেশি সৈন্য দূর করার নির্দেশ দিয়েছে৷
ইরানের শত্রু-মিত্র
১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকে ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর সর্ম্পকের অবনতি ঘটে৷ প্রভাব পড়ে বাকি দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগেও৷ ছবিঘরে দেখুন ইরানের আজকের শত্রু-মিত্র কারা, কার সঙ্গে তার কেমন সম্পর্ক৷
ছবি: picture-alliance/epa/A. Taherkenareh
যুক্তরাষ্ট্র: বন্ধু থেকে শত্রু
১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় মোসাদ্দেক সরকার উৎখাত হওয়ার পর ইরানের ক্ষমতায় আসেন রেজা শাহ পাহলভি৷ পরর্বতী ২৬ বছর ইরান-যুক্তরাষ্ট্র ছিল একে অপরের বন্ধু৷ ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবে শাহ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই সম্পর্ক শত্রুতায় রূপ নেয়৷ ১৯৮০ সাল থেকে দুই দেশের মধ্যে কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই৷ একে অপরকে তারা সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবেও অ্যাখ্যায়িত করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/C. Barria
ইসরায়েল: আন্তরিকতা থেকে অবিশ্বাস
তুরস্কের পর ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়া ২য় মুসলিম দেশ ইরান (১৯৫০ সাল)৷ রেজা শাহের শাসনকালে দুই দেশের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক ছিল৷ ১৯৭৯ সালে খোমেনি ক্ষমতায় এসে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইসরায়েলকেও শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন৷ তেহরান পরমানু অস্ত্র বানাচ্ছে বলে ১৯৯০ সালের পর থেকে অভিযোগ করছে ইসরায়েল৷ দেশটির বিরুদ্ধে হামাস ও হেজবোল্লাহকে মদদ দেয় ইরান৷ অন্যদিকে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রেকে সমর্থন দেয় ইসরায়েল৷
ছবি: AP
সৌদি আরব: ঘাড়ের কাছে শত্রু
মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতা বিস্তারের লড়াইয়ে ইরানের চিরশত্রু সৌদি আরব৷ ১৯৭৯ সালে তেহরানের ক্ষমতায় পরিবর্তন আসার পর থেকেই তা প্রকট আকার ধারণ করেছে৷ দুই দেশ কখনও সরাসরি যুদ্ধে না জড়ালেও চলছে তাদের ছায়াযুদ্ধ৷ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে বিবদমান গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা দেয়৷ গত বছরের সেপ্টেম্বরে সৌদির দুইটি তেলক্ষেত্রে হামলার পেছনে ইরান রয়েছে বলে দাবি করেছে রিয়াদ৷
ছবি: picture-alliance/AA/E. Yorulmaz
রাশিয়া: দখলদার থেকে মিত্র
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইরানে আস্তানা গাড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন৷ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও কয়েকবছর দখলদারি বজায় রাখে তারা৷ শাহের শাসনামলেও সম্পর্ক ভাল ছিল না৷ এমনকি ইরাক-ইরান যুদ্ধে সাদ্দামকে সহায়তা দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন৷ তবে ১৯৯১ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে ইরান হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার কৌশলগত অংশীদার৷
ছবি: AP GraphicsBank
ইউরোপ: আলোচনায় সমাধান
ইরানের ইসলামিক বিপ্লবের পর ইউরোপের সঙ্গেও তেহরানের সম্পর্ক শীতল হয়ে ওঠে ৷ তবে প্রেসিডেন্ট আলী আকবর রাফসানজানির সময়ে এই সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়৷ পরমাণুসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ইইউ বরাবরই ইরানের সঙ্গে আলোচনার উপর জোর দিয়ে আসছে৷ ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে পরমাণু কার্যক্রম স্থগিতকরণ চুক্তি বাতিল করলেও ইউরোপের দেশগুলো তা এখনও বজায় রেখেছে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/N. Economou
চীন: অস্ত্র আর বাণিজ্যের সম্পর্ক
১৯৮০ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধে তেহরানকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিল চীন৷ বেইজিংয়ের শীর্ষ তিনটি অস্ত্র ক্রেতা দেশের একটি ইরান৷ অন্যদিকে ইরানের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার চীন৷ যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর সেখান থেকে তেল আমদানি ব্যাপকভাবে কমিয়ে দিতে হয়েছে চীনকে৷ কাসেম সোলেইমানিকে হত্যাকাণ্ডের পর চীন জানিয়েছে তেহরানের সঙ্গে বেইজিংয়ে সম্পর্ক অটুট থাকবে৷
ছবি: AP / DW-Fotomontage
ইরাক: সর্ম্পকে নতুন মোড়
সাদ্দাম হোসেনের চালানো হামলা থেকে শুরু হওয়া ইরাক-ইরান যুদ্ধ অব্যাহত ছিল আট বছর৷ তবে বর্তমানে বাগদাদের শিয়া নেতৃত্বাধীন সরকারের সাথে সুসম্পর্ক রয়েছে তেহরানের৷ দেশটির একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠীকেও সামরিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে ইরান৷ এইসব গোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে ইরাকে অবস্থানরত মার্কিন বাহিনীর উপর হামলা চালানোর অভিযোগ রয়েছে৷
কথিত আছে লেবাননের হেজবোল্লাহ গোষ্ঠীর উত্থান ইরানের মাধ্যমেই৷ তাদের মূল টার্গেট মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের শত্রু ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আস্তানাগুলো৷ ২০১৮ সালে হেজবোল্লাহ ও তাদের জোট দেশটির নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে৷ যার মধ্য দিয়ে লেবাননের সরকারে ইরানের প্রভাব আরো বেড়েছে৷ এছাড়াও ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহী আর ফিলিস্তিনের হামাস ইরানের মিত্রশক্তি৷
ছবি: Reuters/O. Sanadiki
ভেনেজুয়েলা: শত্রু যখন একই
অবরোধ, অর্থনৈতিক সঙ্কট আর দুই দেশের একই শত্রু, ইরান-ভেনেজুয়েলাকে নিয়ে এসেছে কাছাকাছি৷ ২০০১ সালে ইরানের মোহাম্মদ খাতামি আর ভেনেজুয়েলার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজের মাধ্যমে সহযোগিতামূলক এই সম্পর্কের গোড়াপত্তন৷ আহমদিনেজাদ ক্ষমতায় আসার পর তা আরো নিবিড় হয়৷ একক শত্রু যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে দুইদেশ বেশি কিছু চুক্তিও করেছে৷
ছবি: picture-alliance/AA/ABACA/Iran Presidency
বাংলাদেশ: পাঁচ দশকের সম্পর্ক
১৯৭১ সালের পর থেকে ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক৷ বিভিন্ন সময়ে দুই দেশের রাষ্ট্রীয় সফর অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ ১৯৯৫ সালে প্রেসিডেন্ট রাফসানজানি ঢাকা এসেছিলেন৷ গত বছরের সেপ্টেম্বরে আসেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভাদ জারিফ৷ অক্টোবরে বাকুতে ন্যাম সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসার রুহানি ‘সাইডলাইন বৈঠক’ করেন৷ গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ১.৭৭ কোটি ডলারেরর পণ্য রপ্তানি করেছে দেশটিতে৷