অস্ত্র বিক্রির ক্ষেত্রে ইরানের উপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়াতে তৎপর হয়ে উঠেছে ট্রাম্প প্রশাসন৷ রাশিয়া ও চীন এই প্রচেষ্টার বিরোধিতা করছে৷ আগামী সপ্তাহে নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টির ফয়সালা হবার কথা৷
বিজ্ঞাপন
করোনা সংকট সত্ত্বেও বিশ্বে সংঘাতের কারণগুলি থেমে যায়নি৷ যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে৷ অস্ত্র বিক্রির ক্ষেত্রে ইরানের উপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়ানোর সময় এসে যাওয়ায় সেই সংঘাত আবার প্রকাশ্যে আসছে৷ আগামী ১৮ই অক্টোবরের মধ্যে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও আগামী সপ্তাহে নিরাপত্তা পরিষদে এই প্রস্তাব নিয়ে ভোটাভুটির ঘোষণাকরেছেন৷ জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইরানকে ‘বিশ্বের এক নম্বর সন্ত্রাসের মদতকারী দেশ' হিসেবে বর্ণনা করেছেন৷ নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাবে চীন বা রাশিয়া বাধা দিলে সেই দেশগুলিও সন্ত্রাসবাদের ‘কো স্পনসর' বা দোসর হয়ে যাবে বলে সতর্ক করে দিয়েছে অ্যামেরিকা৷
জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেলি ক্রাফট রাশিয়া ও চীনের কাছে এই সিদ্ধান্তের বৃহত্তর গুরুত্ব তুলে ধরেছেন৷ ক্রাফট বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির গুরুত্ব বিবেচনা করে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত প্রস্তাবে এই দুই দেশ বাধা দেবে না বলে অ্যামেরিকা আশা করছে৷ তবে ইরান ছাড়াও অন্য অনেক ক্ষেত্রে রাশিয়া ও চীনের সহযোগিতার ফলে এই দুই দেশের সীমানার বাইরে অরাজকতা, সংঘাত ও সংঘর্ষে মদত দিয়ে যাবে৷ তাই তাদের কোণঠাসা করতে হবে৷
রাশিয়া ও চীনও হাত গুটিয়ে বসে নেই৷ এই দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গত মাসে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ও নিরাপত্তা পরিষদের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে অ্যামেরিকার কড়া সমালোচনা করেছেন৷ ইরান সংক্রান্ত প্রস্তাব অনুমোদন করতে ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদে প্রয়োজনীয় নয়টি ভোট সম্ভব হলে এই দুই দেশ নিজস্ব ভেটো শক্তি প্রয়োগের ইঙ্গিত দিয়েছে৷ রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচার অভিযানের অভিযোগ এনেছেন৷ অস্ত্র বিক্রির ক্ষেত্রে ইরানের উপর স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চাপানোর প্রচেষ্টার জন্য তিনি সব দেশের উদ্দেশ্যে অ্যামেরিকার নিন্দার আহ্বান জানিয়েছেন৷ চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই আগামী ১৮ই অক্টোবর সরাসরি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পক্ষে সওয়াল করেছেন৷
পম্পেও জানিয়ে দিয়েছেন যে, সেই প্রস্তাব অনুমোদন করা সম্ভব না হলে অ্যামেরিকা তথাকথিত ‘স্ন্যাপব্যাক' প্রক্রিয়ার আশ্রয় নেবে, যার ফলে ইরানের উপর জাতিসংঘের যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা আবার কার্যকর হবে৷ উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ে এই শর্ত রাখা হয়েছিল৷ এর আওতায় ইরান নিজস্ব পরমাণু কর্মসূচির উপর নিয়ন্ত্রণের শর্ত লঙ্ঘন করলে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে ছাড় প্রত্যাহার করা হবে৷ তবে ট্রাম্প প্রশাসন একতরফাভাবে এই চুক্তি বর্জন করলেও রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি এখনো সেই চুক্তি চালু রাখতে বদ্ধপরিকর৷
এদিকে ওয়াশিংটনের ইরান-নীতির কেন্দ্রস্থলে এক নাটকীয় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে৷ ইরান-নীতির দায়িত্বপ্রাপ্ত দূত ব্রায়ান হুক আচমকা পদত্যাগের ঘোষণা করেছেন৷ রাষ্ট্রদূত কেলি ক্রাফটের সঙ্গে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এই সিদ্ধান্তের কথা জানা গেছে৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এক টুইট বার্তায় ইঙ্গিত দিয়েছেন, যে হুক প্রশাসনের কাজ ছেড়ে বেসরকারি ক্ষেত্রে সক্রিয় হতে চলেছেন৷
ইরান-যুক্তরাষ্ট্র: বন্ধু থেকে শত্রু
একটা সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু ছিল ইরান৷ সেখান থেকে চিরশত্রুতায় রূপ নিয়েছে তাদের সম্পর্ক৷ কীভাবে এই মেরুকরণ ঘটল দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: gemeinfrei
ইরানের সরকার উৎখাত
১৯৫১ সালে ইরানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন মোহাম্মদ মোসাদ্দেক৷ তিনি ব্রিটিশদের কাছ থেকে দেশটির তেল সম্পদ জাতীয়করণ করেন৷ ১৯৫৩ সালে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই সিক্স এবং এবং মার্কিন সিআইএ ক্যু ঘটিয়ে মোসাদ্দেককে উৎখাত করে৷
ছবি: picture-alliance/CPA Media Co. Ltd
শাহের ক্ষমতা আরোহন
মোসাদ্দেকের পতনের পর ক্ষমতায় ফেরেন ইরানের নির্বাসিত শেষ সম্রাট রেজা শাহ পাহলভি৷ পরবর্তী দুই দশক ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গড়ে ওঠে নিবিড় বন্ধুত্ব৷ এক পর্যায়ে মার্কিন অস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতায় পরিণত হয় পারস্য উপসাগরের দেশটি৷ যুক্তরাষ্ট্রের কোন অনুরোধই এসময় ফেলেননি শাহ, এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার৷
ছবি: gemeinfrei
ইসলামী বিপ্লব
শাহের আমলে ইরানের তেল ব্যবসায় প্রায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল ব্রিটিশ ও অ্যামেরিকান কোম্পানিগুলোর৷ ইরানি জনগণের মধ্যে রাজতন্ত্রবিরোধী ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে৷ ১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি দেশ ছাড়তে বাধ্য হন রেজা শাহ পাহলভি৷
ছবি: Getty Images/Afp
খোমেনির ফেরা
দুই সপ্তাহ পর দেশে ফেরেন নির্বাসিত নেতা আয়াতোল্লাহ খোমেনি৷ তিনি ইরানের ‘ইসলামি বিপ্লবের’ নেতৃত্ব দেন৷ কিছুদিনের মধ্যেই দেশটির ছাত্ররা তেহরানে মার্কিন দূতাবাস দখল করে৷ ৪৪৪ দিনের জন্য বন্দী হয় ৫২ অ্যামেরিকান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AFP/G. Duval
প্রথম অবরোধ
বন্দী সঙ্কটের সমাধান না হওয়ায় ইরানের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার৷ দেশটিতে মার্কিন পণ্য রপ্তানি ও তেল আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়৷ জব্দ করা হয় ইরানের ১২ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ৷ বের করে দেয়া কূটনীতিকদের৷
ছবি: Imago/ZumaPress
ইরাক-ইরান যুদ্ধ
এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ইরান আক্রমণ করে সাদ্দাম হুসেন৷ যুদ্ধ চলাকালে ইরাককে গোয়েন্দা প্রতিবেদন, অর্থ, সামরিক প্রযুক্তি এমনকি রাসায়নিক অস্ত্রও সরবরাহ করে যুক্তরাষ্ট্র৷ এই যুদ্ধ চলে আট বছর৷ এসময় লেবাননে ইরানের সমর্থিত হেজবুল্লাহ গোষ্ঠীর হামলায় বৈরুতের একটি ব্যারাকে ২৪৪ অ্যামেরিকান নিহত হয়৷
ছবি: picture-alliance/Bildarchiv
ইরানের বিমানে হামলা
১৯৮৮ সালে পারস্য উপসাগরে ইরানের একটি যাত্রিবাহী বিমানে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র৷ নিহত হয় ইরানের ২৯০ জন যাত্রী৷ একে দুর্ঘটনা হিসেবে অভিহিত করেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান৷ এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক আরও তিক্ততায় রূপ নেয়৷
ছবি: picture alliance/dpa/A. Taherkenareh
নতুন অবরোধ
ইরান সন্ত্রাসীদের মদত দেয়ার পাশাপাশি পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে, এমন অভিযোগে দেশটিকে একঘরে করার জন্য প্রচার চালায় ক্লিনটন প্রশাসন৷ ১৯৯৬ সালে বিদেশি কোম্পানিগুলোর ইরানে বিনিয়োগের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয় ওয়াশিংটন৷
ছবি: AP
সম্পর্ক সহজীকরণ
১৯৯৮ থেকে পরবর্তী দুই বছর মোহাম্মদ খাতামি সরকারের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আগ্রহ প্রকাশ করে ক্লিনটন প্রশাসন৷ এজন্য রোডম্যাপও ঘোষণা করা হয়৷ খাতামি দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের প্রস্তাব দেন৷ ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পণ্য আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়৷
ছবি: AP
পরমাণু আকাঙ্ক্ষা
২০০৫ সালে আহমদিনেজাদের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের আবারও অবনতি ঘটে৷ ইরান এসময় পরমাণু কার্যক্রম শুরু করে৷ বুশ ইরানকে সন্ত্রাসের রপ্তানিকারক হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করেন৷ তবে ২০১৫ সালে ওবামা যুক্তরাষ্ট্র ও জোট রাষ্ট্রগুলোর সাথে ইরানের পরমাণু কার্যক্রম স্থগিতকরণ চুক্তিতে বৈরিতার সেই বরফ কিছুটা গলে৷
ছবি: AP
যুদ্ধের দামামা
২০১৮ সালে ইরানের সঙ্গে পরমানু চুক্তি বাতিল করে ডনাল্ড ট্রাম্প৷ ইরানের উপর চাপ প্রয়োগ করতে নতুন করে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে ওয়াশিংটন৷ দুই দেশের প্রক্সি ওয়ার অনেকটাই যুদ্ধাবস্থায় রূপ নিয়েছে চলতি বছরের তিন জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের জেনারেল কাসিম সোলেইমানিকে হত্যার পর৷