পরমাণু চুক্তিতে বেধে দেয়া ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার সীমা লঙ্ঘন করেছে ইরান৷ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ইসরায়েলসহ বেশ কিছু দেশ তীব্র ভাষায় এর নিন্দা করে ইরানকে সতর্ক করে দিয়েছে৷ বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইইউ৷
বিজ্ঞাপন
রোববার সংবাদ সম্মেলন করে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার বেধে দেয়া সীমা অতিক্রম করার ঘোষণা দেন ইরান সরকারের মুখপাত্র আলি রাবিয়েই৷ বার্তা সংস্থা এপি বলছে, ঘোষণার পর কাজও শুরু হয়ে গেছে৷ অর্থাৎ ২০১৫ সালে জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) নামে এক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে তিন দশমিক ৬৭ মাত্রার তিনশ' কিলোগ্রাম পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার যে সীমা বেধে দেয়া হয়েছিল ইরান সেই সীমা লঙ্ঘন শুরু করেছে৷
গত বছর ডনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে এই চুক্তি থেকে সরিয়ে নিয়ে ইরানের ওপর কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ শুরু করেন৷ ইরান বলে আসছিল, অবরোধ তুলে না নিলে, অথবা অবরোধের ক্ষতি পূরণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এগিয়ে না এলে তারা আর চুক্তি মানবে না৷
ব্যাপক প্রতিক্রিয়া
ইরান ইউরেনিয়াম বাড়ানোর নির্ধারিত সীমা অতিক্রমের ঘোষণা দেয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ৷ রোববার প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘‘ইরান সতর্ক হলে ভালো হয়৷'' তিনি আরো বলেন, ‘‘অনেক খারাপ কাজ করছে ইরান৷'' যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন, ‘‘আণবিক কর্মসূচির বিস্তারের এই ঘোষণা ইরানকে আরো একাকিত্ব এবং অবরোধের দিকে নিয়ে যাবে৷''
‘‘ইরান পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হলে তা সারা বিশ্বের জন্য আরো বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে''— এমন শঙ্কা প্রকাশ করে পম্পেও জানান, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে সব দেশের উচিত ইরানকে বাধা দেয়া৷
জার্মানিও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে৷ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘‘চুক্তির সঙ্গে যায় না এমন সব বিচ্যুতি বন্ধ করা বা তা থেকে সরে আসার জন্য আমরা ইরানের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি৷''
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মনে করেন, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার সীমা অতিক্রম করে ইরান আসলে পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করেছে৷ চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর প্রতি ইরানের ওপর আরো কঠোর অবরোধ আরোপের আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি৷ গত সপ্তাহে সিরিয়ায় তেল নেয়ার সময় ইরানের একটি তেলবাহী ট্যাঙ্কার জব্দ করে ব্রিটিশ রয়্যাল মেরিন৷ সেই থেকে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে৷ তেহরানের রোববারের ঘোষণার প্রতিক্রিয়া কড়া ভাষাতেই প্রকাশ করেছে ব্রিটেন৷ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘‘ইরানকে থামতেই হবে৷''
এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নও বিষয়টি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুখপাত্র মায়া কোচিয়ানিচ জানিয়েছেন, ২০১৫ সালের চুক্তিতে স্বাক্ষর করা দেশগুলোকে এখন পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে ভাবতে হবে৷
এসিবি/ কেএম (এপি, রয়টার্স)
ইরান পরমাণু চুক্তি কী ও কেন?
অ্যামেরিকা একতরফাভাবে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি বাতিল করলেও বাকি স্বাক্ষরকারী দেশগুলি চুক্তি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর৷ ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন’ নামের এই চুক্তির প্রধান শর্তগুলি কী?
ছবি: picture-alliance/dpa/H. Neubauer
পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ?
২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ইরান শুধু পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালাতে পারবে না৷ তবে আন্তর্জাতিক নজরদারির মধ্যে শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচি চালু রাখার অধিকার সে দেশের রয়েছে৷ অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চিকিৎসার মতো ক্ষেত্রে পরমাণু শক্তি কাজে লাগানো যেতে পারে৷
ছবি: Getty Images/IIPA
ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ
চুক্তির প্রথম আট বছরে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের সীমা মেনে চলতে রাজি হয়েছিল৷ সেইসঙ্গে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত গবেষণাও বন্ধ থাকবে৷ আন্তর্জাতিক পরমাণু জ্বালানি সংস্থা আইএইএ ইরানের কার্যকলাপের উপর নজর রেখে চলেছে৷ জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, চীন ও রাশিয়া এক্ষেত্রে আইএইএ-র মূল্যায়নকেই গুরুত্ব দিয়ে আসছে৷
ছবি: Kazem Ghane/AFP/Getty Images
পরমাণু ভাণ্ডারের ভবিষ্যৎ
চুক্তির আওতায় ইরান ৩,৬৭ শতাংশ সমৃদ্ধকৃত ইউরেনিয়ামের ভাণ্ডার ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর অঙ্গীকার করেছিল৷ অর্থাৎ ১৫ বছরের জন্য ৩০০ কিলোগ্রামের বেশি এমন মানের ইউরেনিয়াম ইরানের হাতে থাকার কথা নয়৷ ফলে পরমাণু অস্ত্র তৈরির পথ আপাতত বন্ধ থাকছে৷
ছবি: BEHROUZ MEHRI/AFP/Getty Images
নিষেধাজ্ঞা শিথিল
ইরান শর্ত পূরণ করার পরিবর্তে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সে দেশের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ ফলে ইরান আবার আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়াম বিক্রি ও আন্তর্জাতিক অর্থ বাজারে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিল৷ অ্যামেরিকার চাপের মুখে সেই সুবিধা হাতছাড়া করতে চায় না ইরান৷
ছবি: FARS
চুক্তিভঙ্গের পরিণতি
পরমাণু কর্মসূচির উপর আন্তর্জাতিক নজরদারির ফলে একটি পরমাণু বোমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান তৈরি করতে ইরানের কমপক্ষে এক বছর লাগবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন৷ সে রকম প্রচেষ্টা চালালে আবার সে দেশের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা চাপানোর বিধান মেনে নিয়েছে ইরান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Jenis
চুক্তির মেয়াদ শেষের অবস্থা
সমালোচকরা বার বার চুক্তির ‘সানসেট ক্লজ’ বা মেয়াদ শেষের অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন৷ তাদের অভিযোগ, শান্তিপূর্ণ লক্ষ্যে পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা সত্ত্বেও ইরান চুক্তির মেয়াদ শেষে আবার অস্ত্র তৈরির কাজ শুরু করবে৷ তবে চুক্তির প্রবক্তারা মনে করিয়ে দেন, যে বিভিন্ন ধরনের কার্যকলাপের উপর ১০, ১৫, ২০ বা ২৫ বছর পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকবে৷
ছবি: Fars
ক্ষেপণাস্ত্র ও আঞ্চলিক প্রভাব
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকরা ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির বাড়বাড়ন্ত ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে সে দেশের প্রভাব প্রতিপত্তির কড়া সমালোচনা করেন৷ ইউরোপসহ অন্যান্য অনেক দেশও বিষয়ে একমত৷ তবে ‘সফল’ পরমাণু চুক্তি বাতিল করার বদলে তা কাজে লাগিয়ে ইরানের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চায় তারা৷