তেলে কেনা বাবদ ইরানের কাছে ২৫ কোটি ডলারের বকেয়া রয়েছে শ্রীলঙ্কার৷ ঋণ পরিশোধ করতে আগামী মাস থেকেই ইরানের সঙ্গে চা বিনিময় শুরু করতে প্রস্তুত শ্রীলঙ্কা৷
বিজ্ঞাপন
দ্বীপরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা শুক্রবার রয়টার্সকে বলেন, অর্থনৈতিক সংকটে বিধ্বস্ত দেশ মূল বাজারে বিক্রি বাড়াতে এবং বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার রক্ষা করতে এই পরিকল্পনা নিয়েছে৷
২০১২ সালে আমদানি করা তেলের বিনিময়ের বিষয়টি নিয়ে ২০২১ সালে দুই দেশ সম্মত হয়েছিল৷ কিন্তু গত বছর শ্রীলঙ্কায় বিপুল পরিমাণ ডলারের ঘাটতির ফলে ভয়াবহ আর্থিক সংকট শুরু হয়৷ ফলে বিনিময় শুরু হতে দেরি হচ্ছে৷
শ্রীলঙ্কার চা বোর্ডের চেয়ারম্যান নীরজ ডি মেল রয়টার্সকে বলেছেন, ‘‘এটি আমাদের জন্য সময়োপযোগী কারণ আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজারে প্রবেশাধিকার পেয়েছি৷ ইরান ও শ্রীলঙ্কা উভয়েই ডলারের উপর নির্ভর না করে বাণিজ্য করতে পারে৷''
তিনি বলেন, ‘‘চুক্তিটি ছিল ৪৮ মাসের জন্য প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডলার মূল্যের চা পাঠানোর তবে আমরা প্রতি মাসে প্রায় ২০ লাখ ডলার মূল্যের চা দিয়ে এটি শুরু করার পরিকল্পনা করছি৷''
বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় সেইলন চা হলো শ্রীলঙ্কার সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী ফসল৷ এই বিনিময়ের ফলে শ্রীলঙ্কার অতি প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে৷ ইরানের কাছে সেইলন চা বিক্রি শ্রীলঙ্কান রুপিতে বন্দোবস্ত করা হবে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত বছর নগদ সংকটে থাকা দেশটিতে ১২৫ কোটি ডলার এনেছে এই চা৷
অর্থনৈতিক সংকটে যেভাবে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কার নিম্নবিত্ত মানুষ
অর্থনৈতিক অস্থিরতায় বিপাকে শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ৷ পরিস্থিতি এমন যে দিনে দুই বেলা খাবারের খরচ মেটাতেও পারছেন না তারা৷ বিস্তারিত জানুন ছবিঘরে৷
ছবি: Kim Kyung-Hoon/REUTERS
চাল নেই ঘরে
রাজধানী কলম্বোর কাছে ওয়ান্টামুলায় তিন সন্তান আর নাতি-নাতনি নিয়ে থাকেন এই নারী৷ রান্নার গ্যাস বিস্ফোরণে আহত হওয়ার পর স্বামী ছেড়ে যান তাকে৷ স্থায়ী কোনো চাকরি না থাকায় ছুটা কাজ করে পরিবারের খরচ চালান তিনি৷ এখন তার মতো কয়েক লাখ মানুষের পক্ষে এমনকি তিন বেলার খাবার জোগাড় করাও বড় এক চ্যালেঞ্চ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
ছবি: Kim Kyung-Hoon/REUTERS
প্রোটিনের ঘাটতি
৪৯ বছর বয়সি নিলান্থি গুনাসেকারার ঘরে মাছ বলতে এই শুটকিটুকুই অবশিষ্ট রয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘অর্থনৈতিক সংকটের আগে আমরা ভালোই খেতাম৷ সন্তানদের সপ্তাহে অন্তত তিন বা চারদিন মাংস বা মাছ খাওয়াতে পারতাম৷ এখন মাছ আমাদের পরিবারের খাদ্য তালিকা থেকে বাদ গেছে, একই অবস্থা মাংসেও৷’’
ছবি: Kim Kyung-Hoon/REUTERS
করোনার উপর নতুন খাঁড়া
৬০ বছর বয়সি গামাগে রূপাওয়াথির (ডানে) কলম্বোতে ফলের দোকান ছিল৷ সেখান থেকে আয় দিয়ে স্বামী (মাঝে), সন্তান (বামে) নিয়ে ভালোভাবেই চলছিল তাদের সংসার৷ কিন্তু মহামারি চলাকালীন দীর্ঘ লকডাউনের কারণে তার দোকান বন্ধ হয়ে যায়৷ অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সেটি আর পুনরায় চালু করতে পারেননি তিনি৷
ছবি: Kim Kyung-Hoon/REUTERS
এক কাপ চা, দুটি বিস্কুট
গামাগে রূপাওয়াথির স্বামীর জন্য কোনো কোনোদিন এটিই একমাত্র খাবার৷ দ্বীপ রাষ্ট্রটির সোয়া দুই কোটি বাসিন্দার এক চতুর্থাংশই বর্তমানে দুই বেলা খাবার জোগাতে হিমশিম খান৷
ছবি: Kim Kyung-Hoon/REUTERS
ওষুধের সংকট
হৃদরোগে আক্রান্ত মানেল পাইরিস তার ওষুধের খরচ বহন করতে হিমশিম খাচ্ছেন৷ ৬৮ বছর বয়সি এই নারী একটি সরকারি হাসপাতাল থেকে আগে নিয়মিত তিন মাসের ওষুধ পেতেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এখন আমাদের ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে মাসে তিন হাজার ৪০০ রুপি খরচ হয়, যা আমার পক্ষে বহন সম্ভব না৷ আমি বড়জোর এক সপ্তাহের ওষুধ কিনতে পেরেছি৷ কখনো কখনো আমার স্বামীকে টাকা ধার করতে হয় বা অগ্রিম মজুরির আবেদন করতে হয়৷’’
ছবি: Kim Kyung-Hoon/REUTERS
জলের অভাব
‘‘আমাদের কলে জলের সংযোগ আছে, কিন্তু খাবারের ক্রমবর্ধমান খরচ ছাড়াও জল আর বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করা খুব কঠিন৷ তাই এখন টাকা বাঁচানোর জন্য আমি প্রায়ই একটি পাবলিক কূপে স্নান করি,’’ বলেছিলেন শিবরাজা সঞ্জীওয়ান নামে ৩১ বছর বয়সি অটোরিকশা চালক৷
ছবি: Kim Kyung-Hoon/REUTERS
বিপদে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা
৫৩ বছরের প্রিয়ানি ধম্মিকা পান বিক্রি করেন৷ এর ভিতরে থাকে বাদাম৷ তিনি বলেন, ব্যবসা এখন খুব কঠিন, কেননা, বাদামের দাম তিনগুণ আর পাতার দাম আটগুণ বেড়েছে৷
ছবি: Kim Kyung-Hoon/REUTERS
কী দিয়ে রান্না করবেন?
বিদ্যাথিপাতিগে নিহাল আর তার পরিবারের গ্যাসের ট্যাংক আর চুলা চুরি গেছে৷ এর ফলে খোলা চুলায় রান্না করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা৷ কিন্তু গ্যাসের ঘাটতির কারণে জ্বালানি কাঠের চাহিদা দ্রুত বেড়েছে৷ বেড়েছে দামও।
ছবি: Kim Kyung-Hoon/REUTERS
8 ছবি1 | 8
শ্রীলঙ্কার অন্যতম প্রধান চা ক্রেতা ছিলো ইরান কিন্তু ২০১৮ সালের ১২৮ মিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২ সালে ৭০ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে এই রপ্তানি৷ ইরানের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এই বাণিজ্যে প্রভাব ফেলেছে৷
শ্রীলঙ্কার চায়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখন সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) হয়ে ইরানে পাঠানো হয়৷ সরকারি তথ্য বলছে, পাঁচ বছর আগের তুলনায় গত বছর নিজেদের চা আমদানির পরিমাণ দ্বিগুণ করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত৷
রাষ্ট্র-চালিত সেইলন পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বিনিময় কর্মসূচির অধীনে যে তেল কিনেছিল, শ্রীলঙ্কার রপ্তানিকারকদের মাধ্যমে চা পাঠানোর জন্য টি-বোর্ডকে অর্থ দেবে তারা৷
নীরজ ডি মেল বলেন, ইরানি চা আমদানিকারকরা ন্যাশনাল ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানিকে রিয়াল দেবে৷ তার কথায়, ‘‘আমরা চূড়ান্ত নথির জন্য অপেক্ষা করছি এবং জুলাই থেকে রপ্তানি শুরু হবে বলে আশা করছি৷''
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে ২৯০ কোটি ডলারের বেলআউট সুরক্ষিত করার পরে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মে মাসের শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫০ কোটি ডলারে, যা ১৪ মাসের সর্বোচ্চ৷ রেমিট্যান্স এবং পর্যটনও এই রিজার্ভ বাড়াতে সাহায্য করেছে, বলছেন বিশেষজ্ঞেরা ৷
শ্রীলঙ্কায় ক্যান্সার রোগীরা মহাবিপদে
অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কা৷ দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে ক্যান্সার রোগীদের জীবনে ভয়াবহভাবে পড়েছে অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব৷ দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: KIM KYUNG-HOON/REUTERS
প্রিয়ান্থার দুঃখ
প্রিয়ান্থা কুমারাসিংহের ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ে ২০২১ সালে৷ সেই সময় দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হওয়ায় চিকিৎসা শুরু করতে দেরি হয়ে যায়৷ ক্যান্সার বেশ ছড়িয়ে পড়ে৷ এখন তার আক্ষেপ, ‘‘জুন, জুলাই এবং আগস্টে আমি যদি উপযুক্ত চিকিৎসা পেতাম, তাহলে হয়ত আমার ফুসফুসের ক্যান্সার অনেক কমে যেতো৷’’
ছবি: KIM KYUNG-HOON/REUTERS
দ্বিমুখী সমস্যায় ক্যান্সার রোগীরা
শ্রীলঙ্কার ছোট শহর মহার্গমায় প্রিয়ান্থার দিন শুরু হয় এক কাপ চা এবং দুটি বিস্কুট দিয়ে সকালের নাশতা সারার পর বেশ কিছু ক্যান্সারের ওষুধ খেয়ে৷ অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হলে সবজি চাষি প্রিয়ান্থা ১৫৫ কিলোমিটার দূরের কলম্বো শহরে থেকেই চিকিৎসা করাতেন৷ কিন্তু টাকার অভাবে রাজধানীতে থাকতে তো পারছেনই না, চড়া দামে ওষুধ কিনতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন, ডাক্তারের পরামর্শমতো পুষ্টিকর খাবারও খেতে পারছেন না৷
ছবি: DINUKA LIYANAWATTE/REUTERS
হাসপাতালে ওষুধ নেই
হাসপাতালে গেলে রোগীদের শুনতে হয়- ওষুধ নেই৷ ‘সাধা রণ’ রোগের রোগীরাও অনেক ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত চিকিৎসা পান না৷ সরকারি মেডিকেল অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর মুখপাত্র ভাসান রত্নাসঙ্গম বলেন, ‘‘সব হাসপাতালে (ওষুধের) অভাব দেখা দিয়েছে৷ এমনকি রোগীদের প্যারাসিটামল, ভিটামিন সি বা স্যালাইনও দেয়া সম্ভব হচ্ছে না৷’’
ছবি: KIM KYUNG-HOON/REUTERS
মরার ওপর খাড়ার ঘা
গত বছর থেকে শ্রীলঙ্কায় রাসায়নিক সার নিষিদ্ধ৷ এর ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতির বাজারে চাষি প্রিয়ান্থার জন্য টেকা আরো দায় হয়ে উঠেছে৷ সারের দাম রাতারাতি প্রতি ব্যাগ ১৬০০ শ্রীলঙ্কান রূপি থেকে ৩০ হাজার রূপি হয়ে গেছে৷ তাই বাঁচার উপায় দেখছেন না প্রিয়ান্থা, ‘‘প্রতিটি ওষুধের দাম এক হাজার রূপির ওপরে৷ প্রতিমাসে আমার ৭০ হাজার রূপির মতো খরচ করতে হয়৷ খুব চেষ্টা করছি, কিন্তু দিনদিন ভীষণ কঠিন হয়ে যাচ্ছে৷’’
ছবি: KIM KYUNG-HOON/REUTERS
এক মায়ের দুর্ভাবনা
সাথিয়ারাজ সিলক্সনার পাঁচ বছরের সন্তান সাক্সন লড়ছে ক্যান্সারের সঙ্গে৷ ছেলে ৩৫০ কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে৷ তিনি বলেন নির্মাণশ্রমিক স্বামীর আয়ে সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে তারা বহুবিধ সমস্যার মুখোমুখি, ‘‘ শ্রীলঙ্কার চলমান সংকটের কারণে যাতায়াত, ওষুধ আর খাওয়াদাওয়ার খরচ জোগাড় করতে ভীষণ সমস্যা হচ্ছে৷ ছেলেকে তো বাঁচাতেই হবে, তাই নিজের গয়নাগুলো বিক্রি করে দিয়েছি৷’’