ইরান আর আন্তর্জাতিক পরমাণু চুক্তি মানতে রাজি নয়। সরকারের তরফে বিবৃতি দিয়ে এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেওয়া হল৷
বিজ্ঞাপন
কাসিম সোলেইমানি হত্যার জের৷ আন্তর্জাতিক পরমাণু চুক্তি মানার দায়বদ্ধতা থেকে সরে আসছে ইরান৷ তেহরান সরকার পরিস্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে, ২০১৫ সালে পরমাণু চুক্তিতে যে সব শর্ত ছিল, বিশেষ করে হাতে কলমে পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে যে বিধিনিষেধ ছিল, তা তারা আর মানবে না৷ ইউরেনিয়াম প্রক্রিয়াকরণের সীমাও তারা মানতে নারাজ৷ ইরানের এই সিদ্ধান্তের ফলে মধ্য প্রাচ্যে উত্তেজনা আরও বাড়তে বাধ্য৷ তার প্রধান কারণ অবশ্য আমেরিকার ড্রোন হানা এবং তাতে সুলেইমানির মৃত্যু৷
ইরানের সঙ্গে জাতিসংঘের পাঁচ স্থায়ী সদস্য আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্স এবং জার্মানির পরমাণু চুক্তি হয়েছিল৷ বছর দুয়েক আগে আমেরিকা একতরফাভাবে এই চুক্ত থেকে বেরিয়ে আসে৷ তারপর থেকে চুক্তি নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু এ বার আমেরিকার হানায় সোলেইমানির মৃত্যুর পর ইরান কড়া অবস্থান নেওয়ায় চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে রীতিমতো সংশয় দেখা দিল৷ ইউরোপের দেশগুলি এখন চুক্তি বঁচানোর জন্য ইরানের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে৷ ইরানের বিদেশমন্ত্রী মহম্মদ জাভেদ জারিফকেও ব্রাসেলস ডেকে পাঠানো হয়েছে৷ কিন্তু ইরানের এই অবস্থানের পর সেই চেষ্টায় কোনও ফল হবে কি না, তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে৷
সোলেইমানির জানাযায় জনতার এক আওয়াজ, ‘প্রতিশোধ, প্রতিশোধ’
কাসিম সোলেইমানির জানাযায় লাখো মানুষের ঢল নামে৷ সেখানে কান্নায় ভেঙে পড়েন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা৷ সোলেইমানির কন্যা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কালো দিন অপেক্ষা করছে৷ জনতার ঢলে ওঠে, ‘‘প্রতিশোধ, প্রতিশোধ’’ আওয়াজ৷
ছবি: picture-alliance/AP/Tasnim/M. Hossein Thaghi
জানাযায় জনস্রোত
শুক্রবার এক ড্রোন হামলায় ইরানের কুদস বাহিনীর প্রধান কাসিম সোলেইমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী৷ হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে ইরান সরকার৷ ইরাক থেকে সোলেইমানির মৃতদেহ আনার পর সোমবার রাজধানী তেহরানে প্রথম জানাযা হয়৷ ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানাযায় ১০ লাখেরও বেশি মানুষের অংশ নেয়ার কথা বলেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP/ISNA/A. Mohammadi
ডুকরে কেঁদে ওঠেন খামেনি
তিনদিনের শোক শেষে অনুষ্ঠিত জেনারেল সোলেইমানির প্রথম জানাযা পড়ান ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লাহ আলী খামেনি৷সোলেইমানির কফিনের ওপর তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন৷ এ সময় প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি, কুদস বাহিনীর নতুন প্রধান এসমাইল কা’নিসহ ইরানের অন্য অনেক শীর্ষ নেতাও খামেনির পাশে ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Iran Press TV
সোলেইমানির কন্যার হুমকি
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সোলেইমানির কন্যা জয়নাব সোলেইমানি বলেন, ‘‘এখন থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যে সেনাসদস্যরা আছেন তাদের পরিবার সন্তানের মৃত্যুর খবরের অপেক্ষায় থাকবেন৷’’ তার বাবাকে হত্যার নির্দেশ দেয়া ডনাল্ড ট্রাম্পের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘‘উন্মাদ ট্রাম্প, ভেবো না আমার বাবা শহিদ হওয়ায় সব শেষ হয়ে গেছে৷’’ তিনি আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আর তার মিত্র ইসরায়েলের জন্য ‘কালো দিন’ অপেক্ষা করছে৷
ছবি: AFP/Office of Iran's Supreme Leader Ayatollah Ali Khamenei
‘যুক্তরাষ্ট্রকে তাড়াবো’
তেহরানে জানাযা শুরুর আগে রাষ্ট্রীয় বেতারকে সোলেইমানির মৃত্যুর পর কুর্দস বাহিনীর দায়িত্ব নেয়া কা’নিও প্রতিশোধের ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘‘আমরা আমাদের বাহিনী নিয়ে শহিদ সোলেইমানির দেখানো পথেই এগিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করছি৷ এ অঞ্চল থেকে আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে তাড়াবো, কারণ, এটাই উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ৷’’
জানাযায় দশ লাখেরও বেশি মানুষ অংশ নিয়েছে বলে দাবি করেছে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন৷ জনস্রোত থেকে বারবার ‘‘প্রতিশোধ, প্রতিশোধ’’ ওঠে৷
ছবি: Reuters/WANA/N. Tabatabaee
সোলেইমানির স্মৃতি
জানাযায় উপস্থিত জনতার হাতে আয়াতোল্লাহ আলী খামেনির হাত থেকে সোলেইমানির জোলফাঘর, অর্থাৎ সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ স্বীকৃতি নেয়ার ছবি৷
ছবি: AFP/A. Kenare
সেনাপ্রধানের কান্না
সোলেইমানির কফিনের ওপর নুয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ইরানের রেভোল্যুশনারি গার্ডের কমান্ডার ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি৷
ছবি: AFPAFP/Office of Iran's Supreme Leader Ayatollah Ali Khamenei
সেনাসদস্যদের হাতেও সোলেইমানির ছবি
আর্মি ক্যাডেটদের হাতেও দেখা যায় সোলেইমানির ছবি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Noroozi
‘আমরা সবাই সোলেইমানি’
জানাযায় উপস্থিত অনেকের হাতেই দেখা যায়, ‘আমরা সবাই সোলেইমানি’ লেখা পোস্টার৷
ছবি: Reuters/WANA/N. Tabatabaee
পরের জানাযা কেরমানে
মঙ্গলবার জেনারেল সোলেইমানির দ্বিতীয় জানাযা হবে তার নিজের শহর কেরমান-এ৷
ছবি: Reuters/WANA/N. Tabatabaee
10 ছবি1 | 10
ইরানের তরফে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, তাদের পরমাণু প্রকল্প আর কোনও সীমায় বাঁধা থাকবে না৷ ইউরেনিয়াম শোধনের ক্ষেত্রেই হোক, গবেষণা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রেই হোক, কোনও বিধিনিষেধ তারা মানবে না৷ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ''এখনও পর্যন্ত ইরানের পরমাণু প্রকল্প শুধুমাত্র প্রযুক্তি ভিত্তিক ছিল৷''
ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। এতদিনের বন্ধন এ বার ছিন্ন করে পরমাণু অস্ত্র বানাবার দিকে এগোতে চাইছে ইরান। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আঘাত হানার সিদ্ধান্ত রীতিমতো নড়িয়ে দিয়েছে ইরানকে৷ এতদিন পর্যন্ত ইরানের অবস্থান ছিল তারা মাত্র পাঁচ শতাংশ ইউরোনিয়ামকে সমৃদ্ধ করার কাজ করত, সেটাও পারমাণবিক জ্বালানি তৈরি করার জন্য৷ পারমাণবিক শক্তি প্রকল্পের জন্য এই জ্বালানি দরকার৷ কিন্তু ইরান আর এই সীমার মধ্যে থাকতে রাজি নয়৷ এরপরই জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন তাঁদের সংয়ত থাকার অনুরোধ করছে৷ জার্মান চ্যান্সেলার আঙ্গেলা ম্যার্কেল, ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন একটি বিবৃতিতে বলেছেন, ''আমরা ইরানকে অনুরোধ করছি, তারা যেন এমন কিছু না করে য়া পরমাণু চুক্তি বিরোধী৷ ইরান যেন কোনও সহিংসতা না করে ও কোনওরকম হিংসায় মদত না করে৷ এখন উত্তেজনা কমানোটাই অত্যন্ত জরুরি৷ তই সবাইকে সযত থাকতে হবে৷''
প্রশ্ন হল, এই আবেদনে ইরান সাড়া দেবে কি, না কি তাঁরা আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পিছু হঠবে?
জিএইচ/এসজি(রয়টার্স)
ইরান পরমাণু চুক্তি কী ও কেন?
অ্যামেরিকা একতরফাভাবে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি বাতিল করলেও বাকি স্বাক্ষরকারী দেশগুলি চুক্তি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর৷ ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন’ নামের এই চুক্তির প্রধান শর্তগুলি কী?
ছবি: picture-alliance/dpa/H. Neubauer
পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ?
২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ইরান শুধু পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালাতে পারবে না৷ তবে আন্তর্জাতিক নজরদারির মধ্যে শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচি চালু রাখার অধিকার সে দেশের রয়েছে৷ অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চিকিৎসার মতো ক্ষেত্রে পরমাণু শক্তি কাজে লাগানো যেতে পারে৷
ছবি: Getty Images/IIPA
ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ
চুক্তির প্রথম আট বছরে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের সীমা মেনে চলতে রাজি হয়েছিল৷ সেইসঙ্গে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত গবেষণাও বন্ধ থাকবে৷ আন্তর্জাতিক পরমাণু জ্বালানি সংস্থা আইএইএ ইরানের কার্যকলাপের উপর নজর রেখে চলেছে৷ জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, চীন ও রাশিয়া এক্ষেত্রে আইএইএ-র মূল্যায়নকেই গুরুত্ব দিয়ে আসছে৷
ছবি: Kazem Ghane/AFP/Getty Images
পরমাণু ভাণ্ডারের ভবিষ্যৎ
চুক্তির আওতায় ইরান ৩,৬৭ শতাংশ সমৃদ্ধকৃত ইউরেনিয়ামের ভাণ্ডার ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর অঙ্গীকার করেছিল৷ অর্থাৎ ১৫ বছরের জন্য ৩০০ কিলোগ্রামের বেশি এমন মানের ইউরেনিয়াম ইরানের হাতে থাকার কথা নয়৷ ফলে পরমাণু অস্ত্র তৈরির পথ আপাতত বন্ধ থাকছে৷
ছবি: BEHROUZ MEHRI/AFP/Getty Images
নিষেধাজ্ঞা শিথিল
ইরান শর্ত পূরণ করার পরিবর্তে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সে দেশের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ ফলে ইরান আবার আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়াম বিক্রি ও আন্তর্জাতিক অর্থ বাজারে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিল৷ অ্যামেরিকার চাপের মুখে সেই সুবিধা হাতছাড়া করতে চায় না ইরান৷
ছবি: FARS
চুক্তিভঙ্গের পরিণতি
পরমাণু কর্মসূচির উপর আন্তর্জাতিক নজরদারির ফলে একটি পরমাণু বোমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান তৈরি করতে ইরানের কমপক্ষে এক বছর লাগবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন৷ সে রকম প্রচেষ্টা চালালে আবার সে দেশের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা চাপানোর বিধান মেনে নিয়েছে ইরান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Jenis
চুক্তির মেয়াদ শেষের অবস্থা
সমালোচকরা বার বার চুক্তির ‘সানসেট ক্লজ’ বা মেয়াদ শেষের অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন৷ তাদের অভিযোগ, শান্তিপূর্ণ লক্ষ্যে পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা সত্ত্বেও ইরান চুক্তির মেয়াদ শেষে আবার অস্ত্র তৈরির কাজ শুরু করবে৷ তবে চুক্তির প্রবক্তারা মনে করিয়ে দেন, যে বিভিন্ন ধরনের কার্যকলাপের উপর ১০, ১৫, ২০ বা ২৫ বছর পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকবে৷
ছবি: Fars
ক্ষেপণাস্ত্র ও আঞ্চলিক প্রভাব
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকরা ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির বাড়বাড়ন্ত ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে সে দেশের প্রভাব প্রতিপত্তির কড়া সমালোচনা করেন৷ ইউরোপসহ অন্যান্য অনেক দেশও বিষয়ে একমত৷ তবে ‘সফল’ পরমাণু চুক্তি বাতিল করার বদলে তা কাজে লাগিয়ে ইরানের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চায় তারা৷