দু’টি কর্মকালের পর ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমদিনেজাদ আর প্রার্থী হচ্ছেন না৷ তাঁর উত্তরসূরিকে চালাতে হবে অর্থনৈতিক দুরবস্থা পীড়িত, আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন একটি দেশ৷
বিজ্ঞাপন
২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর আহমদিনেজাদ অনেক বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন৷ খনিজ তেল লব্ধ অর্থ নাকি দেশের ‘‘প্রতিটি পরিবারের খাবার টেবিলে'' দেখতে পাওয়া যাবে৷ এছাড়া তিনি বছরে বিশ লাখ করে নতুন চাকুরি সৃষ্টি করবেন, কর্মহীনদের সংখ্যা শূন্যে এবং মুদ্রাস্ফীতি দশ শতাংশের নীচে নামাবেন৷
আট বছর পরে আহমদিনেজাদ প্রেসিডেন্ট পদ থেকে বিদায় নিচ্ছেন, কিন্তু ইরানের বাস্তব চিত্র তাঁর প্রতিশ্রুতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা৷ সরকারি হিসাব অনুযায়ী মুদ্রাস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৩০ শতাংশের কাছাকাছি; বেকারত্ব প্রায় ১২ শতাংশ; অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এখন বিয়োগে নেমেছে৷ পরিসংখ্যান বাস্তবিক এর চেয়ে খারাপ হতে পারে না৷
ইরানে নারীর ভোটাধিকারের পঞ্চাশ বছর
১৯৬৩ সালে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলাভি’র আমলে তৎকালীন ‘সাদা বিপ্লব’ এর আওতায় আনুষ্ঠানিকভাবে ইরানের নারীদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়৷
ছবি: AP
‘সাদা বিপ্লব’
গত পঞ্চাশ বছর ধরে ভোটদানের ক্ষমতা রয়েছে ইরানের নারীদের৷ ১৯৬৩ সালে শাহ মোহাম্মদ পাহলাভির মেয়াদকালে এই অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়৷ সেবছরের ২৬ জানুয়ারি গণভোটের মাধ্যমে এটি অনুমোদন করা হয়৷ প্রথমদিকে এই ‘সাদা বিপ্লবের’ প্রতি জনগণের সমর্থন ছিল৷
ছবি: Kayhan
ধর্মীয় নেতাদের তরফ থেকে বাধা
১৯৬৩ সালের মাঝামাঝি নারীর ভোটাধিকারসহ বিভিন্ন সংস্কার বাধার মুখে পড়ে৷ ইরানের ধর্মীয় নেতারা সাদা বিপ্লবের বিরোধিতা করেন৷ সেসময় রাজনীতির ময়দানে আয়াতোল্লা খোমায়েনির উত্থান ঘটে৷ তবে সরকার বিরোধীদেরকে কঠোর হাতে দমন করা শুরু করলে নির্বাসনে চলে যান তিনি৷
ছবি: IRNA
কয়েক দশকের সংস্কার
শাহ পাহলাভির চার দশকের শাসনকাল, মানে ১৯৪১ থেকে ১৯৭৯ সাল অবধি ইরানের নারীরা অনেক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন৷ এগুলোর মধ্যে সন্তানের দায়িত্ব গ্রহণের অধিকার এবং বিয়ের জন্য মেয়েদের নূন্যতম বয়সসীমা, ১৮ বছর৷ তারা সেসময় বিবাহবিচ্ছেদ এবং গর্ভপাতের অধিকারও পায়৷ অন্যদিকে, পুরুষের বহুবিবাহের প্রথা সীমিত করা হয়৷
ছবি: footballitarin
ইসলামি বিপ্লবের ফলাফল
১৯৭৯ সালে শাহকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা হয়৷ সেসময় ইরানের নারীরা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন৷ শাহ’র পতনের পর পরই প্রগতিশীল নারী অধিকার বিষয়ক আইনগুলো বাতিল করা হয়৷ নারীদের বিবাহবিচ্ছেদ এবং সন্তানের দায়িত্ব নেওয়ার অধিকার সঙ্কুচিত করা হয়৷ মেয়েদের বিয়ের নূন্যতম বয়স আবারো নয় বছর করে দেওয়া হয়৷ পুরুষকে ইচ্ছেমত বহুবিবাহের সুযোগ দেওয়া হয়৷
চাপ সত্ত্বেও এগনোর চেষ্টা
আইনিভাবে কম অধিকার থাকা সত্ত্বেও অনেক ইরানি নারী তাদের স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার চেষ্টা করেছেন, বিশেষ করে চাকুরির ক্ষেত্রে৷ যেসব কাজে সাধারণত পুরুষদের আধিপত্য থাকে, সেসব কাজও করছেন ইরানের মেয়েরা৷ আজকাল ইরানের নারীরা ট্যাক্সি এমনকি দূরপাল্লার ট্রাকও চালাচ্ছেন৷ তারা এখন শিক্ষক, চিকিৎসক, পুলিশ, সাংসদ এমনকি রাষ্ট্রপতির পরামর্শকও হচ্ছেন৷
ছবি: AP
মোহাম্মদ খাতামিকে সমর্থন
১৯৯৭ এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন নারী এবং তরুণ সমাজ৷ তারাই সংস্কারপন্থী মোহাম্মদ খাতামিকে ক্ষমতায় আনেন৷ প্রথমবার জয়ের পর নারীদের সংগঠন ও ক্লাব তৈরির ক্ষেত্রে যে আইনি বাধা ছিল, তা শিথিল করেন খাতামি৷
ছবি: AP
নারী অধিকারের প্রতীক
ইরানে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে শিরিন এবাদির নাম৷ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি ২০০৩ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার জয় করেন৷ ২০০৯ সালের শেষ অবধি ইংল্যান্ডে নির্বাসিত জীবন কাটান এবাদি৷ ইরান এবং ইরানের বাইরে অনেকে ‘আইকন’ হিসেবে বিবেচনা করেন এই আইনজীবী তথা অ্যাক্টিভিস্টকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সবুজ আন্দোলনের দোসর
ইরানে নারীর সমানাধিকারের দাবিতে ২০০৬ সালে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, যেখানে দশ লাখ মানুষের স্বাক্ষর আহ্বান করা হয়৷ সেই উদ্যোগের সূত্র ধরে ২০০৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় সবুজ আন্দোলন গড়ে তোলা হয়৷ তখন নারীর সমানাধিকারের দাবিতে রাস্তায় নামে পুরুষরাও৷
ছবি: AP
‘আমার কণ্ঠ কোথায়?’
সবুজ আন্দোলনের সমর্থকরা ইরানের সংস্কারপন্থী প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মির-হোসেন মুসাভিকে সমর্থন জানায়৷ কিন্তু অত্যন্ত বিতর্কিত নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় পুর্ননির্বাচিত হয়েছেন মাহমুদ আহমেদিনেজাদ৷ সেসময় নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে কয়েক সপ্তাহ ধরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে হতাশ নারী-পুরুষরা৷ তারা ‘হোয়্যার ইজ মাই ভয়েস?’ শীর্ষক ব্যানার এবং শ্লোগানে তেহরানের রাজপথ ভরিয়ে ফেলে৷
ছবি: AP
আশা আছে?
চলতি বছরের জুন মাসে ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে৷ এই নির্বাচনকে সামনে রেখে আশাবাদী হয়ে উঠছেন ইরানের নারী অধিকার বিষয়ক অ্যাক্টিভিস্টরা৷ আগামী নির্বাচনকে তারা আবারো নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজে লাগাতে চান৷ এই লক্ষ্যে তৈরি হচ্ছে সুনির্দিষ্ট দাবি৷ সেসব দাবির ভবিষ্যত অবশ্য সময়ই বলে দেবে৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
বলতে কি, কর্মভার গ্রহণ করার সময় আহমদিনেজাদের বস্তুত কোনো অর্থনৈতিক পরিকল্পনাই ছিল না - বলছেন বিশেষজ্ঞরা৷ আর যেটুকু ছিল, তা'ও নিজের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর প্রচেষ্টায়, যেমন গ্রামাঞ্চলের মানুষদের জন্য ভরতুকি কিংবা তরুণ দম্পতিদের জন্য বিবাহের ‘‘যৌতুক''৷ কিন্তু অর্থনীতির মূল সমস্যাগুলির কোনো সুরাহা করতে পারেননি তিনি৷
রিয়ালের পতন
দেশের মুদ্রা রিয়াল'এর বিনিময়মূল্যের কোনো হানি ঘটবে না, তা স্থায়ী থাকবে, এ'প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন আহমদিনেজাদ৷ কিন্তু যা ঘটেছে, তা হল এই যে, ২০১১ সাল যাবৎ মার্কিন ডলারের তুলনায় রিয়াল তার বিনিময়মূল্যের এক-তৃতীয়াংশ হারিয়েছে - যার ফলে মুদ্রাস্ফীতির হার আরো বৃদ্ধি পেয়েছে৷ আহমদিনেজাদ প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হওয়ার সময় মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ১২ শতাংশ৷ তিনি যাবার সময়, অর্থাৎ এখন সে হার দাঁড়িয়েছে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশে, বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা৷ বিশেষ করে খাবারদাবার, বাড়িভাড়া ও বাস-ট্রামের ভাড়া বেড়েছে দারুণভাবে৷
যুগপৎ পশ্চিমি শাস্তিমূলক পদক্ষেপের ফলে অর্থনীতির অতীব দুরবস্থা৷ আট বছর আগে ইরানের প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় সাত শতাংশ, এখন সেটা নেগেটিভ, অর্থাৎ বিয়োগের কোঠায়, যদিও ২০১৪'য় তা কিছু বাড়ার সম্ভাবনা আছে, বলে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের অভিমত৷ ওদিকে প্রবৃদ্ধি ছাড়া চাকুরি সৃষ্টি সম্ভব নয়৷ কাজেই আহমদিনেজাদের ঘোষিত বছরে বিশ লাখের পরিবর্তে মাত্র ১৪ হাজার নতুন চাকরি সৃষ্টি হয়েছে৷
আন্তর্জাতিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কার্যকরি হবার আগে, অর্থাৎ ২০১২ সাল অবধি ইরান ভালোমতোই তেল রপ্তানি করেছে৷ সেই অর্থের একটা বড় অংশ গেছে পণ্য আমদানিতে৷ এছাড়া আহমদিনেজাদের প্রশাসনকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করা হয়েছে৷ বিদেশনীতি ও নিরাপত্তা নীতিরও মূল্য দিতে হয়েছে: যেমন লেবাননে হিজবুল্লাকে সমর্থন কিংবা গাজা স্ট্রিপে হামাসকে সাহায্য৷
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দল
রাজনৈতিক বিচারে আহমদিনেজাদের শাসনকাল অভ্যন্তরীণ কাজিয়া-কোন্দলে পরিপূর্ণ ছিল - যার মাধ্যমে ইরানের সংবিধান ও শাসনব্যবস্থার ভঙ্গুরতা সকলের সামনে দৃষ্টিগোচর হয়ে উঠেছে৷ আয়াতোল্লার মনোনীত এক রাষ্ট্রপ্রধানও যে নিজের মর্জি মতো দেশ চালাতে পারেন না, সেই সত্যটাই যেন উপলব্ধি করা গেছে৷
ক্ষমতার এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বই দেশকে অগ্রসর হবার কোনো একটি পথ বেছে নিতে দিচ্ছে না৷ এবং আহমদিনেজাদের পরেও যে সে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটবে, এমনও নয়৷ যার প্রতিফলন ঘটবে ইরানের বিতর্কিত পারমাণবিক কর্মসূচির ক্ষেত্রে৷ আহমদিনেজাদের উত্তরসূরির আমলেও তা নিয়ে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রসমাজের সঙ্গে বিরোধের কোনো হেরফের হবে না বলেই মনে হয়৷