ইউরোপীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের উদ্দেশ্যে উত্তেজনা এড়িয়ে সংযমের ডাক দিয়েছে৷ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁদের কাছে ইরানের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ পেশ করেছেন৷ পারস্য উপসাগর অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়ছে৷
বিজ্ঞাপন
ট্রাম্প প্রশাসন ও ইরানের মধ্যে বেড়ে চলা উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের উদ্দেশ্যে সংযমের আহ্বান জানিয়েছেন৷ তাঁদের আশঙ্কা, বর্তমান পরিস্থিতিতে সামান্য কারণেই দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়ে যেতে পারে৷ বিশেষ করে রবিবার সৌদি আরব পারস্য উপসাগরে সে দেশের দুটি পেট্রোলিয়ামবাহী ট্যাংকারে ‘অন্তর্ঘাত'-এর অভিযোগ করায় এমন সম্ভাবনা আর উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না৷ তাই পরিস্থিতি শান্ত রাখা অত্যন্ত জরুরি বলে তারা মনে করে৷ এমনই প্রেক্ষাপটে জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ইইউ পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান একযোগে দুই দেশের উদ্দেশ্যে এই বার্তা পাঠিয়েছেন৷ উল্লেখ্য, এই তিন দেশ ইরানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরমাণু চুক্তির অংশীদার৷ ইইউ সেই চুক্তি কার্যকর করার প্রক্রিয়া তত্ত্বাবধান করে এসেছে৷ ওয়াশিংটন একতরফাভাবে এই চুক্তি ত্যাগ করলেও ইউরোপ তা আঁকড়ে ধরে রয়েছে৷
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও সোমবার ব্রাসেলসে ইউরোপীয় নেতাদের কাছে ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান তুলে ধরেন৷ ইরানের কার্যকলাপ সম্পর্কে তিনি গোপন তথ্যও দেখিয়েছেন বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রশাসনের ইরান সংক্রান্ত দূত ব্রায়ান হুক৷ তাঁর মতে, পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল তথা মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতার বিষয়ে ইউরোপও অ্যামেরিকার মতো উদ্বিগ্ন৷ হুক বলেন, হুমকির বদলে ইরানের সংলাপের পথে আসা উচিত৷
ইইউ পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান ফেডেরিকা মোগেরিনি বলেন, ইরানের বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্পষ্টভাবে ইউরোপের অবস্থান জানানো হয়েছে৷ তাঁর মতে, এই মুহূর্তে যতটা সম্ভব সংযম দেখানো এবং সামরিক তৎপরতা এড়িয়ে চলা উচিত৷
জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাস এ প্রসঙ্গে পম্পেও-র কাছে পরমাণু চুক্তির গুরুত্ব তুলে ধরেন৷ তাঁর মতে, এর থেকে ভালো কোনো চুক্তির প্রস্তাব দেখা যাচ্ছে না৷ সে কারণে হাতে যে চুক্তি রয়েছে, সেটাই ধরে রাখা উচিত বলে তিনি মনে করেন৷ তার ভিত্তিতে পরিস্থিতির অবনতি এড়ানোর চেষ্টা চালাতে হবে, বলেন মাস৷
এদিকে সৌদি আরবের জ্বালানী মন্ত্রী খালিদ আল ফালিহ সোমবার বলেছেন যে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের উপকূলে ‘অন্তর্ঘাতমূলক হামলা'-র ফলে সে দেশের দুটি পেট্রোলিয়ামবাহী জাহাজের বড় ক্ষতি হয়েছে৷ উল্লেখ্য, ফুজেইরাহ উপকূলে মোট ৪টি জাহাজের উপর হামলার বিষয়ে জানিয়েছিল আমিরাত৷ এই ঘটনার পেছনে ইরানের হাত আছে কিনা, সে বিষয়ে জল্পনাকল্পনা চলছে৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ইরান কিছু করলে সে দেশকে তার ফল ভোগ করতে হবে৷ ইরান এই হামলার তীব্র নিন্দা করে ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি জানিয়েছে৷ সে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে সে অঞ্চলের দেশগুলির উদ্দেশ্যে বিদেশি শক্তির বেপরোয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে৷
ইরান পরমাণু চুক্তি কী ও কেন?
অ্যামেরিকা একতরফাভাবে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি বাতিল করলেও বাকি স্বাক্ষরকারী দেশগুলি চুক্তি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর৷ ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন’ নামের এই চুক্তির প্রধান শর্তগুলি কী?
ছবি: picture-alliance/dpa/H. Neubauer
পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ?
২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ইরান শুধু পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালাতে পারবে না৷ তবে আন্তর্জাতিক নজরদারির মধ্যে শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচি চালু রাখার অধিকার সে দেশের রয়েছে৷ অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চিকিৎসার মতো ক্ষেত্রে পরমাণু শক্তি কাজে লাগানো যেতে পারে৷
ছবি: Getty Images/IIPA
ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ
চুক্তির প্রথম আট বছরে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের সীমা মেনে চলতে রাজি হয়েছিল৷ সেইসঙ্গে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত গবেষণাও বন্ধ থাকবে৷ আন্তর্জাতিক পরমাণু জ্বালানি সংস্থা আইএইএ ইরানের কার্যকলাপের উপর নজর রেখে চলেছে৷ জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, চীন ও রাশিয়া এক্ষেত্রে আইএইএ-র মূল্যায়নকেই গুরুত্ব দিয়ে আসছে৷
ছবি: Kazem Ghane/AFP/Getty Images
পরমাণু ভাণ্ডারের ভবিষ্যৎ
চুক্তির আওতায় ইরান ৩,৬৭ শতাংশ সমৃদ্ধকৃত ইউরেনিয়ামের ভাণ্ডার ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর অঙ্গীকার করেছিল৷ অর্থাৎ ১৫ বছরের জন্য ৩০০ কিলোগ্রামের বেশি এমন মানের ইউরেনিয়াম ইরানের হাতে থাকার কথা নয়৷ ফলে পরমাণু অস্ত্র তৈরির পথ আপাতত বন্ধ থাকছে৷
ছবি: BEHROUZ MEHRI/AFP/Getty Images
নিষেধাজ্ঞা শিথিল
ইরান শর্ত পূরণ করার পরিবর্তে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সে দেশের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ ফলে ইরান আবার আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়াম বিক্রি ও আন্তর্জাতিক অর্থ বাজারে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিল৷ অ্যামেরিকার চাপের মুখে সেই সুবিধা হাতছাড়া করতে চায় না ইরান৷
ছবি: FARS
চুক্তিভঙ্গের পরিণতি
পরমাণু কর্মসূচির উপর আন্তর্জাতিক নজরদারির ফলে একটি পরমাণু বোমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান তৈরি করতে ইরানের কমপক্ষে এক বছর লাগবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন৷ সে রকম প্রচেষ্টা চালালে আবার সে দেশের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা চাপানোর বিধান মেনে নিয়েছে ইরান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Jenis
চুক্তির মেয়াদ শেষের অবস্থা
সমালোচকরা বার বার চুক্তির ‘সানসেট ক্লজ’ বা মেয়াদ শেষের অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন৷ তাদের অভিযোগ, শান্তিপূর্ণ লক্ষ্যে পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা সত্ত্বেও ইরান চুক্তির মেয়াদ শেষে আবার অস্ত্র তৈরির কাজ শুরু করবে৷ তবে চুক্তির প্রবক্তারা মনে করিয়ে দেন, যে বিভিন্ন ধরনের কার্যকলাপের উপর ১০, ১৫, ২০ বা ২৫ বছর পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকবে৷
ছবি: Fars
ক্ষেপণাস্ত্র ও আঞ্চলিক প্রভাব
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকরা ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির বাড়বাড়ন্ত ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে সে দেশের প্রভাব প্রতিপত্তির কড়া সমালোচনা করেন৷ ইউরোপসহ অন্যান্য অনেক দেশও বিষয়ে একমত৷ তবে ‘সফল’ পরমাণু চুক্তি বাতিল করার বদলে তা কাজে লাগিয়ে ইরানের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চায় তারা৷