এক সপ্তাহের বিক্ষোভের ঘটনার পরপরই এই নিষিদ্ধের ঘোষণাটি এলো, যে বিক্ষোভের জন্য ‘পশ্চিমা ইন্ধনকেই' দুষছে ইরান৷ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ইংরেজি শিক্ষাকে পশ্চিমা বিশ্বের ‘সাংস্কৃতিক আগ্রাসন' বলে উল্লেখ করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
রোববার দেশটির শিক্ষা বিষয়ক একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সাক্ষাৎকারে ইংরেজি শিক্ষা নিষিদ্ধের বিষয়টি জানান৷
রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম আইআরআইবি-কে দেয়া সাক্ষাৎকারে হাই এডুকেশন কাউন্সিলের কর্মকর্তা মেহদি নাভিদ-আদহাম বলেন, ইংরেজি শিক্ষা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ছাড়া আর কিছু নয়৷
‘‘এর কারণ, ইংরেজি থাকলেপ্রাথমিক শিক্ষায় ইরানের সংস্কৃতি চাপা পড়ে যায়৷ তাই সরকারি ও বেসরকারি স্কুল দু'টোর জন্যই প্রাথমিক পর্যায়ে ইংরেজি নিষিদ্ধ,'' রয়টার্সকে বলছিলেন মেহদি৷
ইরান: সভ্যতার এক সূতিকাগার
ইরানের ইতিহাস অনেক পুরনো৷ সেই সময়কার বিভিন্ন নিদর্শন ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে জার্মানির বন শহরে হয়েছিল একটি প্রদর্শনী৷
ছবি: Bundeskunsthalle Bonn
চার মাসব্যাপী প্রদর্শনী
প্রায় আট হাজার বছর আগে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ সহস্রাব্দে এই এক ঘরের ভবনটি তৈরি করা হয়েছিল৷ জার্মানির বন শহরের এক মিউজিয়ামে প্রাচীন ইরানের বিভিন্ন নিদর্শনের প্রদর্শনী চলছে৷ খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ সহস্রাব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৫২২ সাল পর্যন্ত ঐ অঞ্চলের মানুষজন কীভাবে বসবাস করতেন, তা প্রদর্শনীতে তুলে ধরা হচ্ছে৷
ছবি: National Museum of Iran/Bundeskunsthalle Bonn
দ্য টাওয়ার অফ বাবেল
বিশেষজ্ঞরা এই টাওয়ারকে ইতেমেনানকি নামের একটি ‘জিগুরাত’ বা প্রাসাদ-কমপ্লেক্সের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মনে করেন৷ আলেকজান্ডার দি গ্রেট এটি ধ্বংস করেন৷ ‘ইহুদিদের বাইবেল’ বলে পরিচিত ‘তানাখ’-এর প্রথম গ্রন্থ ‘জেনেসিস’-এ এই টাওয়ারের কথা উল্লেখ আছে৷ খ্রিষ্টানদের বাইবেলের প্রথম অংশ ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’-এও আছে এই টাওয়ারের কথা৷
ছবি: Bundeskunsthalle Bonn
দ্য রয়েল গেম অফ উর
অন্যতম প্রাচীন বোর্ড গেম হচ্ছে ‘ব্যাকগ্যামন’৷ বন শহরের প্রদর্শনীতে সোপস্টোন দিয়ে তৈরি কয়েকটি ব্যাকগ্যামন বোর্ডও দেখানো হচ্ছে৷ এগুলোতে সাপ আর পাখির নকশা রয়েছে৷ খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে পশ্চিম এশিয়ায় ‘দ্য রয়েল গেম অফ উর’ খেলা হতো৷ ‘গেম অফ ২০ স্কয়্যার’ নামে পরিচিত খেলাটি আজও জনপ্রিয়৷
ছবি: National Museum of Iran/Bundeskunsthalle Bonn
পাঁচ হাজার বছর আগের
ক্লোরাইট দিয়ে তৈরি এই পাত্রটি খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের৷ ইরানের জিরফট শহরের সমতল ভূমি থেকে এটি উদ্ধার করা হয়েছে৷
ছবি: National Museum of Iran/Bundeskunsthalle Bonn
দক্ষতার পরিচয়
সেই সময়কার ধনি ব্যক্তিরা স্বর্ণখচিত এই ধরণের (ছবি) পাত্রে ওয়াইন পান করতেন৷ এসব পাত্রের নকশা ও কারুকাজ দেখলে তখনকার মানুষদের ব্যবহারিক ও প্রযুক্তি বিষয়ক দক্ষতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়৷
ছবি: National Museum of Iran/Bundeskunsthalle Bonn
রাজকন্যাদের সমাধিতে
এসব স্বর্ণালংকার পাওয়া গেছে দুজন এলামাইট রাজকন্যার সমাধিতে৷ পারস্য উপসাগরের কাছে অবস্থিত ইরানের জুবাজি গ্রামে ২০০৭ সালে এগুলো পাওয়া যায়৷ সমাধিতে স্বর্ণালংকার ছাড়াও খাবার ও ধর্মীয় বিষয়াদিও দিয়ে দেয়া হতো বলে জানা যায়৷
ছবি: Bundeskunsthalle Bonn/D. Ertl
রাজার প্রাসাদ
খ্রিষ্টপূর্ব ১২৭৫ থেকে ১২৪০ পর্যন্ত রাজত্ব করা রাজা উনতাশ-নাপিরিশা শোঘা জানবিল শহরে বাস করতেন৷ তিনটি উঁচু দেয়াল দিয়ে শহরটি ঘেরা ছিল৷ ঐ স্থানে হাজার হাজার ইট পাওয়া যাওয়ায় বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শহরের আকার বাড়ানোর হয়ত পরিকল্পনা ছিল৷
ছবি: Bundeskunsthalle Bonn
পৃথিবীতেই যেন স্বর্গ
প্রদর্শনীর একটি জায়গায় ছোট আকারে ‘পার্সিয়ান গার্ডেন’ তৈরি করা হয়েছে৷ ইউনেস্কোর ঐতিহ্যের একটি অংশ হচ্ছে এই বাগান৷ পার্সিয়ান গার্ডেন মানেই হচ্ছে মাঝখানে থাকবে পানির ফোয়ারা আর পাশে ফুলের বাগান৷ সঙ্গে থাকবে বসার জায়গা, যেখান থেকে দর্শকরা সৌন্দর্য্য উপভোগ করবেন৷
ছবি: Bundeskunsthalle Bonn
8 ছবি1 | 8
ইরানের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা নতুন নয়৷ তাদের সরকারিভাবে তৈরি করা পাঠ্যসূচিতে সপ্তম গ্রেড পর্যন্ত ইংরেজি শিক্ষা নেই৷
কিন্তু বেসরকারিভাবে কোনো কোনো স্কুল বা ডে কেয়ার সেন্টার বাচ্চাদের ইংরেজি শেখাতো৷ ২০১৬ সালে বিষয়টি জানাজানি হবার পর দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন৷
মেহদির মতো তিনিও বলেছিলেন যে, এটি ‘পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন'৷
নতুন ঘোষণাটি আসার পর তা বেসরকারি স্কুলগুলোকেও মানতে হবে৷
গেল সপ্তাহজুড়ে ইরানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ হয়৷ সেই বিক্ষোভের জন্য পশ্চিমা বিশ্বকে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রকে ইন্ধন যোগানোর জন্য কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে ইরান৷
সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজি নিষিদ্ধের বিষয়টি সেই ঘটনার জেরেই একটি ‘পাল্টা জবাব' কিনা তা অনেকেরই প্রশ্ন৷
ইরানেও গ্রাম আছে, আছে পাঠশালা
ইরানের মানুষজন তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য আরো ভালো স্কুল চান৷ শহরে ভালো স্কুলের অভাব না থাকলেও, গ্রামাঞ্চলে সে ঘাটতি আছে৷ দূর গাঁয়ের কচিকাঁচারা অনেক সময় স্কুলেই যায় না অথবা যেতে পারে না৷
ছবি: yavari.ir
কাত করা ব্ল্যাকবোর্ড
সবুজ রঙের ব্ল্যাকবোর্ডটি টেবিলের ওপর কাত করে, দেয়ালে ঠেস দিয়ে খাড়া করা আছে৷ এক শিক্ষার্থী টেবিলের ওপর চড়ে চক দিয়ে তাতে কি যেন লিখছে৷ শিক্ষার্থীর অভাব নেই৷ ইরানের জনগণের গড় বয়স ৩০, তাদের এক-তৃতীয়াংশের বয়স ১৮-র নীচে৷
ছবি: yavari.ir
‘যত বেশি শিশু, ততই মঙ্গল’
তবুও ইরান সরকার আরো বেশি সন্তান চায়৷ ‘পনেরো কোটি নাগরিকের দেশ হবে ইরান’ অথবা ‘যত বেশি শিশু, ততই মঙ্গল’, এ ধরনের স্লোগান দিয়ে সরকার দম্পতিদের আরো বেশি সন্তানের জন্ম দিতে উদ্বুদ্ধ করতে চাইছেন৷ কিন্তু এখনই সারা দেশে ৫২,০০০ শিশুর স্কুলে স্থান অকুলান৷ শিক্ষাক্ষেত্রে জিডিপির তিন শতাংশের বেশি ব্যয় করে না ইরান৷
ছবি: khanetarrahan.ir
ছেলে-মেয়ের আলাদা শ্রেণিকক্ষ
ইরানে ছেলে আর মেয়েদের আলাদা আলাদা শ্রেণিকক্ষে পড়ানো হয়৷ রাজধানী তেহরানে স্কুলঘর বা ক্লাসের চেয়ারটেবিলের অবস্থা স্বভাবতই মফস্বলের চেয়ে অনেক ভালো৷ শিক্ষকরাও রাজধানীর স্কুলে চাকরি পেতে চান৷
ছবি: Mehr
নীল আকাশের নীচে
শিক্ষার্থীরা রোজ তাদের ব্ল্যাকবোর্ড আর অঙ্কের হোমওয়ার্ক বাড়িতে নিয়ে যায়৷ পরের দিন আবার ঘাড়ে করে ব্ল্যাকবোর্ড আনতে হয় এই জঙ্গলে, শিক্ষকও যেখানে আসেন৷ স্কুলঘর তৈরির টাকার অর্ধেক আসে সরকারি বাজেট থেকে, বাকি অর্ধেক বিভিন্ন নিধি থেকে৷
ছবি: yavari.ir
গরুর গোয়াল...
গরুর গোয়াল বলে পড়ুয়াদের অপমান করা হচ্ছে না৷ স্কুলবাড়িটা আসলে একটা মুরগির খাঁচা৷ কচিকাঁচাদের পড়াশুনার জন্য এর চাইতে ভালো কিছু জোটেনি এই প্রত্যন্ত প্রদেশে৷
ছবি: yavari.ir
বরফে কিছু আসে যায় না
বরফ পড়লে স্কুলে যাওয়াটাই একটা অ্যাডভেঞ্চার হয়ে দাঁড়াতে পারে৷ বহু ছাত্রছাত্রীর পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতে আর ফিরতে বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় লেগে যায়৷ তারপর আবার অনেককে ক্ষেতে বা বাড়ির কাজে হাত লাগাতে হয়৷
ছবি: yavari.ir
শিক্ষকই ফেরি
আলোকচিত্রী মোহাম্মদ গোলচিন তাঁর ছবিতে এসব অসমসাহসী ছাত্র আর শিক্ষকদের কাহিনী শুনিয়েছেন৷ দরকার হলে শিক্ষক নিজে গিয়ে ছাত্রদের ঝর্না পার করে দিয়ে আসেন৷
ছবি: yavari.ir
মরুভূমি পার হয়ে...
মরুভূমি পার হয়ে স্কুলের পথে৷ দক্ষিণ-পূর্ব ইরানের যে অংশটি পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্তের কাছে, সেই হতদরিদ্র সিস্তান ও বেলুচিস্তানে শুধু যে নতুন স্কুল নেই, তা-ই নয়, অন্তত ৬,০০০ ক্লাসঘর ভেঙে নতুন করে তৈরি করতে হবে৷ এছাড়া আরো ৮,০০০ শিক্ষকের প্রয়োজন পড়বে৷
ছবি: yavari.ir
শিক্ষা ও অন্ন দুইয়েরই অভাব
সিস্তান ও বেলুচিস্তানের বহু পরিবার এতই গরীব যে, তারা তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠান না৷ ওদিকে এই অঞ্চলে একটানা খরা চলেছে৷ বিশ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে৷
ছবি: yavari.ir
‘পড়িয়ে কী হবে? বিয়ে দাও!’
আইন অনুযায়ী ইরানে স্কুলের পড়া নিখর্চায়৷ তা সত্ত্বেও প্রায় সব স্কুলই ‘স্বেচ্ছাপ্রদত্ত’ ফি দাবি করে থাকে৷ ফি দিতে না পারলে শিক্ষার সেখানেই ইতি - বিশেষ করে মেয়েদের৷
ছবি: yavari.ir
মেয়েরা এগিয়ে আসছে
অথচ ইরানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরীক্ষায় কিন্তু মেয়েরাই বেশি ভালো ফল করে থাকে৷ বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর সংখ্যা ৫০ শতাংশের চেয়ে বেশি৷ তবে বহু স্নাতকই শেষমেষ বিদেশে চলে যান৷