ইরানে মার্কিন বাংকার বাস্টার ফেলতে চায় কেন ইসরায়েল?
২২ জুন ২০২৫
১৩ জুন থেকে ইরানে হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। অন্য নানা লক্ষ্যের পাশাপাশি কিছু গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাতেও আঘাত হেনেছে ইসরায়েল।
পরমাণু ইস্যুতে ইরান এবং ইসরায়েলের সবশেষ অবস্থান কী? একটু জেনে নেয়া যাক।
ইরান ৬০ শতাংশ বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে। পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজন ৯০ শতাংশের কাছাকাছি বিশুদ্ধতা।
আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা ইরানের ইউরেনিয়ামের উচ্চ মাত্রা নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, কোনো দেশই পরমাণু অস্ত্র অর্জন না করে এত ব্যাপক মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেনি। তবে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে। পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির অধীনে শান্তিপূর্ণ পরমাণু প্রযুক্তির অধিকারও রয়েছে দেশটির।
এবার আসা যাক ইসরায়েলের প্রসঙ্গে।
ইসরায়েল অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র এই দেশটিরই পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। তবে ইসরায়েল কখনোই পরমাণু অস্ত্র থাকার কথা স্বীকার বা অস্বীকার করেনি।
কিন্তু ইরানের ইউরেনিয়াম নিয়ে এত আলোচনা তাহলে কেন?
মারিয়ন মেসমার চ্যাথাম হাউজের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো।
তিনি বলেন, "পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য যে ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হয়, সেটা প্রায় ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করা হয়। শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য চেষ্টা করা হলে আপনি কখনোই এতদূর যাবেন না। ফলে ইরানের যে মজুদ ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করেছে, সেটা পারমাণবিক জ্বালানির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু এর মানে এ-ও দাঁড়ায় যে, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতার জন্য প্রয়োজনীয় ৯০ শতাংশ আপনি তুলনামূলকভাবে অনেক দ্রুত করতে পারবেন।"
নাতাঞ্জ পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রে বিশাল ভূগর্ভস্থ স্থাপনাতে ৫০ হাজার পর্যন্ত সেন্ট্রিফিউজ জমা রাখা সম্ভব। এখন সেখানে প্রায় ১৭ হাজার সেন্ট্রিফিউজ রয়েছে। এর মধ্যে ১৩ হাজার ৫০০টি ৫ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে কাজ করছে। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সবশেষ তথ্য অনুসারে, এই স্থাপনাটি সরাসরি ইসরায়েলি হামলার শিকার হয়েছে। জানা গেছে, বিদ্যুৎ সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় নাতাঞ্জের ভূগর্ভস্থ সমৃদ্ধকরণ প্ল্যান্টটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কেবল স্থাপনার ক্ষতি নয়, ইসরায়েলের হামলায় ইরানের পরমাণু কর্মসূচির প্রধানসহ অন্তত ১০ জন বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। ইরানের আসলে কতটা ক্ষতি হয়েছে?
মারিয়ন বলেন, "আমি মনে করি, এর ফলে ইরানের ক্ষমতার উপর তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়বে। যে ব্যক্তিরা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির কর্তৃত্বে ছিলেন, তারা এখন আর সেই কাজ করতে পারবেন না। কিন্তু ইরান প্রযুক্তি খাতে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে এবং সম্ভবত তাদের নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞানীদের প্রশিক্ষণের জন্য অভ্যন্তরীণ অবকাঠামো রয়েছে এবং আমি নিশ্চিত যে, পরবর্তী প্রজন্মের বিজ্ঞানীরা সেই কাজটি এগিয়ে নিতে সক্ষম হবেন।"
তবে ইরানের অন্যসব পারমাণবিক স্থাপনার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ফোর্দো। পাহাড় খনন করে মাটির অনেক গভীরে তৈরি করা হয়েছে এই কেন্দ্রটি। ফোর্দোতে সাম্প্রতিক তিন মাসে ১৬৬ দশমিক ৬ কেজি ইউরেনিয়াম ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ করা হয়েছে। আণবিক শক্তি সংস্থার মাপকাঠি অনুসারে, আর সমৃদ্ধ করা হলে এই পরিমাণ ইউরেনিয়াম দিয়ে চারটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি সম্ভব।
মাটির এত গভীরে থাকায় ইসরায়েলের হামলায় ফোর্দোর দৃশ্যমান কোনো ক্ষতি হয়নি। এটিই ইসরায়েলের বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কেবল যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই মাটির এত গভীরে হামলা চালানোর মতো একটি অস্ত্র আছে, যার পোশাকি নাম জিবিইউ-৫৭। সাধারণভাবে এটিকে ‘বাংকার বাস্টার' নামে ডাকা হয়। ইসরায়েল চায় তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিক এবং ফোর্দো পরমাণুকেন্দ্রে বাংকার বাস্টার নিক্ষেপ করুক।
সেন্টার ফর নিউ অ্যামেরিকান সিকিউরিটি এর ডিফেন্স প্রোগ্রামের ফেলো কার্লটন হেইলিগ এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন।
তিনি বলেন, "বিশ্বে যে কোনো দেশের অস্ত্রাগারে থাকা একমাত্র অস্ত্র এই ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর, যা ফোর্দোর মতো স্থাপনাগুলোতেও সফলভাবে হামলা, এমনকি ধ্বংস করতেও সক্ষম। এটি মূলত পাহাড়ের ভেতরে নির্মিত স্থাপনাতে আক্রমণ এবং ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই তৈরি করা হয়েছিল। শুরুতে উত্তর কোরিয়াকে লক্ষ্য রেখে এটি তৈরি করা হয়েছিল, পরে ইরানের মতো লক্ষ্যবস্তুগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে তারপরেও এর কোনো নিশ্চয়তা নেই যে, এই অস্ত্রের একটি বা দুটি ফোর্দোকে সফলভাবে অকার্যকর বা ধ্বংস করতে সক্ষম হবে।”
তিনি আরো বলেন, "মার্কিন বিমান বাহিনীর বি-টু স্টিলথ বোমারু বিমানই একমাত্র বিমান, যা এই অস্ত্র বহন এবং নিক্ষেপে সক্ষম। কিন্তু এটি একবারে কেবল দুটি অস্ত্র বহন করতে পারে। সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, ফোর্দোর মতো লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ করার জন্য বিমান বাহিনী একাধিক বিমানের মাধ্যমে এই ধরনের বেশ কয়েকটি অস্ত্র ব্যবহারের পরিকল্পনা করেছে। সুতরাং এটি কেবল একটি বিমান থেকে ফেলে দেওয়া অস্ত্র হবে না। বরং অনেকটা ড্রিল চালানোর মতো করে নির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুতে একাধিকবার টানা আক্রমণ চালানো হবে।"
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাতে জড়াবে কিনা, এ নিয়ে খোদ ট্রাম্প শিবিরের মধ্যেই দ্বন্দ্ব রয়েছে। শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প কী সিদ্ধান্ত নিবেন, তা জানতে আরো অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু যদি তার সিদ্ধান্ত নেতিবাচক হয়, সেক্ষেত্রে ইসরায়েল কী করতে পারে?
মারিয়ন বলেন, "ইসরায়েল কখনোই তাদের নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র থাকার কথা স্বীকার করেনি। কিন্তু ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয় যে, তাদের পারমাণবিক অস্ত্র আছে। আমার উদ্বেগের একটি বিষয় হচ্ছে, ইসরায়েল যদি সত্যিই চায় ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি বন্ধ হোক এবং তারা যদি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বাড়তি সহায়তা না পায়, এবং যদি তারা বিবেচনা করে যে, তাদের নিজস্ব প্রচলিত ক্ষমতাই এই স্থাপনাগুলো ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট, সেক্ষেত্রে তারা কি কম মাত্রার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করার কথা বিবেচনা করবে, যেটা ভূগর্ভের গভীরে খুব শক্ত লক্ষ্যবস্তুতেও পৌঁছাতে পারবে? অবশ্যই, এর ফলে আন্তর্জাতিক আইন এবং পারমাণবিক নিষেধাজ্ঞার একটি বিশাল লঙ্ঘন হবে এবং এই সংঘাতকে এটি আরো উসকে দেবে।"
ইরান অবশ্য এরই মধ্যে পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করার হুমকি দিয়েছে। এই পরিস্থিতি অনেককেই উত্তর কোরিয়ার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। ২০০৩ সালে উত্তর কোরিয়া অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি থেকে নাম প্রত্যাহার করে নেয় এবং ২০০৬ সালে পরমাণু বোমার সফল পরীক্ষার মাধ্যমে পরমাণু শক্তিধর দেশের তালিকায় নাম লেখায়।
এডিকে/এসিবি (রয়টার্স)