1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত থেমেছে, যুদ্ধ নয়!

২৭ জুন ২০২৫

‘‘কার দিকে তুমি গুলি ছুঁড়ছো হে, এখানে সবাই মানুষ! তুমি কে, তুমি কি গ্রহান্তরের দলছুট?’’ কবিতার লাইনগুলো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। তাঁর ‘আর যুদ্ধ নয়' কবিতার শুরুর দুটো লাইন। কবির কথা এখন আর কে শোনে?

নিউ ইয়র্কের টাইম স্কোয়ারে যুদ্ধবিরোধী সমাবেশ
নিউ ইয়র্কের টাইম স্কোয়ারে যুদ্ধবিরোধী সমাবেশছবি: Caitlin Ochs/REUTERS

কবিতার লাইন কোন বিশ্ব মোড়ল পড়ে? গাজায় একের পর এক হামলা চলছিল। হামলায় সেখানকার মানুষজন যখন দিশেহারা, মানবেতর জীবন ক্ষুধায় যখন মারা যাচ্ছিল শিশুরা; তারই মাঝে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ বেধে গেল। ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের তেহরানের আকাশে গর্জন শুরু হলো। জবাব দিতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলি শহরে আঘাত হানলো। এই দৃশ্যপট মধ্যপ্রাচ্যকে এক নতুন ও বিপজ্জনক অধ্যায়ের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এই সংঘাতের আগুনে ঘি ঢাললো বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ, যা পরিস্থিতিকে আরো জটিল ও বিস্ফোরক করে তুলেছিল।

তবে সাময়িক স্বস্তি মিলেছে। আপাতত ইরান-ইসরায়েল সংঘাত বিরতিতে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পসহ অনেকেই একে বলছেন যুদ্ধবিরতি। কিন্তু কোনো চুক্তি নেই, আনুষ্ঠানিক বৈঠক নেই। এমন পরিস্থিতিতে মুখে মুখে যুদ্ধবিরতির কথা শুনলে বিশ্বাস করা দায় হয়ে যায়। কারণ, আনুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতির চুক্তি ডিঙিয়ে বিশ্বে বহু যুদ্ধ নতুন করে শুরু হওয়ার নজির আছে। তার চেয়ে চিন্তার বিষয় হলো, যখন ট্রাম্প নিজেই বলছেন, এ যুদ্ধে সবাই জিতেছে। যে যুদ্ধে কেউ হারে না, সেই যুদ্ধের সমাপ্তি হয় না। বরং সেটি নতুন করে যুদ্ধের উপলক্ষ তৈরি করে। কারণ, যুদ্ধবাজ ‘রাজনীতিবিদদের ধমনী শিরায় সুবিধাবাদের পাপ' থাকে। এজন্য আমাদের হাঁফ ছেড়ে বাঁচার আপাত দম কতদিন-ক্ষণ স্থায়ী হয়, তা বলা মুশকিল। কারণ, বহু বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্য ঘিরে সংকট চলছিল। সাম্প্রতিক যুদ্ধ সেই সংকটের বহুমাত্রিকতা বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে, যেটি আর মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এর ঢেউ এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। ১২ দিনের তীব্র সংঘাতের পর একটি আপাত যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও, এটি কোনো স্থায়ী শান্তির নিশ্চয়তা দেয় না। বরং এটি একটি গভীর ও দীর্ঘমেয়াদী সংকটের সাময়িক বিরতি মাত্র। কারণ, যুদ্ধ শেষ হলে শুরু হয় সাইলেন্ট আফটারম্যাথ। তার প্রভাব কতটা গভীর ও তীক্ষ্ম হবে, তার ওপরই নির্ভর করছে সামনের দিনগুলোতে এই যুদ্ধের প্রভাব।

পৃথিবীর মতো সম্পর্কও মনে হয় ঘুরে। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে এক সময় উষ্ণ  কূটনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। সেই সম্পর্কের চাকা ঘুরে গেল ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের পর। ওই বিপ্লব দুই দেশকে আদর্শিক এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এই ঐতিহাসিক রূপান্তর বর্তমান সংঘাতের মূল কারণ অনুধাবনের জন্য অপরিহার্য। ১৯৭৯ সালের আগে, শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভীর শাসনামলে ইরান ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের অন্যতম কৌশলগত অংশীদার। তখন দুটি দেশই আরব জাতীয়তাবাদ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবকে সাধারণ হুমকি হিসেবে দেখতো। কিন্তু আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামি বিপ্লব এই সমীকরণ পুরোপুরি পাল্টে দেয়। নতুন প্রতিষ্ঠিত ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ‘বড় শয়তান' এবং ইসরায়েলকে ‘ছোট শয়তান' ও একটি ‘অবৈধ রাষ্ট্র' হিসেবে আখ্যায়িত করে। এই আদর্শিক অবস্থান ইরানের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়, যা ইসরায়েলের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে। অন্যদিকে, ১৯৯০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং ইরাকের দুর্বল হয়ে পড়া মধ্যপ্রাচ্যে একটি ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি করে। এই শূন্যস্থান পূরণের জন্য ইরান ও ইসরায়েল উভয়েই নিজ নিজ প্রভাববলয় বিস্তারের প্রতিযোগিতায় নামে। সেই সময় থেকেই দুই দেশের মধ্যে ছায়াযুদ্ধ তীব্র হতে শুরু করে, যা মূলত লেবানন, সিরিয়া এবং ফিলিস্তিনি অঞ্চলকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। ইরান ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থনকে তার ইসলামি ও বিপ্লবী আদর্শের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ব্যবহার করে, হামাস ও ইসলামি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে অর্থ, অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে ইসরায়েলের সীমান্তে একটি ধারাবাহিক চাপের বলয় তৈরি করে। বহুদিন ধরে চলতে থাকে ছায়াযুদ্ধ। লেবাননে হিজবুল্লাহর উত্থান এবং সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে ইরানের হস্তক্ষেপ এই ছায়াযুদ্ধকে আরো বিস্তৃত করে, যা ইসরায়েলের জন্য একটি বড় নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি করে। তবে ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনার কেন্দ্রে রয়েছে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি। ইরান বরাবরই দাবি করে আসছে, তাদের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত। কিন্তু ইসরায়েল এবং পশ্চিমা বিশ্ব মনে করে, এই কর্মসূচির আড়ালে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে। এই আশঙ্কা থেকেই ইসরায়েল বছরের পর বছর ধরে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করতে বিভিন্ন গোপন অভিযান চালিয়েছে। যেমন, সাইবার হামলা, বিজ্ঞানী গুপ্তহত্যা এবং স্থাপনায় অন্তর্ঘাতমূলক হামলা। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা যখন ঘোষণা করে যে ইরান তার পারমাণবিক অ-প্রচার বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করেছে, তখন ইসরায়েল এটিকে চূড়ান্ত সীমা লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য করে এবং সরাসরি সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই পারমাণবিক ইস্যুটিই দীর্ঘদিনের ছায়াযুদ্ধকে ২০২৫ সালের জুনে একটি পূর্ণাঙ্গ সম্মুখ সমরে রূপান্তরিত করার মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।

সাম্প্রতিক সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে গত বছরের ১লা এপ্রিলে। ওইদিন সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেট ভবনে ইসরায়েলি হামলায় বেশ কয়েকজন সিনিয়র ইরানি সামরিক কর্মকর্তা নিহত হন। ইরানের জন্য এটি ছিল দেশটির সার্বভৌমত্বের উপর সরাসরি আঘাত। এর জবাবে ইরান ১৩ এপ্রিল ইসরায়েলের দিকে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যা ইসরায়েলের ইতিহাসে ইরানের পক্ষ থেকে প্রথম সরাসরি হামলা। ইসরায়েল এরপর ১৯শে এপ্রিল ইরানের অভ্যন্তরে, বিশেষ করে তাদের পারমাণবিক স্থাপনার আশেপাশে পাল্টা হামলা চালায়। এই হামলার পরপরই পরিস্থিতির চরম অবনতির আশঙ্কা দেখা দেয়, যা ২০২৫ সালের জুনের ভয়াবহ যুদ্ধের সূচনা করে। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা ইরানকে পারমাণবিক অ-প্রচার চুক্তি লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করার ঠিক পরের দিনই ইসরায়েল এক আকস্মিক ও বিধ্বংসী বিমান হামলা চালায়। এই হামলায় ইরানের সর্বোচ্চ সামরিক নেতৃত্বসহ অন্তত ৩০ জন ঊর্ধ্বতন সামরিক কমান্ডার এবং ১৪ জন প্রবীণ পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিহত হন। ইসরায়েলি হামলার জবাবে ইরানও বসে থাকেনি। তারা দ্রুত প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেয় এবং ইসরায়েলের বিভিন্ন শহর ও সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে শত শত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়। যুদ্ধ দ্রুত তীব্র হতে থাকে এবং উভয় পক্ষই ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হয়। তবে এরই মধ্যে শান্তি আলোচনাও কিছু শুরু হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের দশম দিনে, ২২ জুন, সংঘাত একটি নাটকীয় মোড় নেয়। ইসরায়েলের অনুরোধে এবং দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। ‘অপারেশন মিডনাইট হ্যামার' নামে পরিচিত এই অভিযানে মার্কিন বিমান বাহিনী ইরানের ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনা, বিশেষ করে ফর্দো, নাতাঞ্জ ও ইস্পাহানে, শক্তিশালী বাংকার-বিধ্বংসী বোমা নিক্ষেপ করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেন, এই হামলায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বসে ‘অভাবনীয় সাফল্য' এসেছে। যদিও দেশটির গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন বলছে ভিন্ন কথা। মার্কিন হামলার জবাবে ইরান কাতারের আল উদেইদ বিমানঘাঁটিতে আমেরিকান সামরিক স্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। তবে এই হামলা ছিল সীমিত এবং পরিকল্পনামাফিক। কাতারের আল উদেইদ বিমানঘাঁটিকে বেছে নেওয়ার কারণ ছিল, এটি এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মার্কিন ঘাঁটি। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের খবর থেকে যা জানা গেল, তার সারমর্ম হলো, যুক্তরাষ্ট্র আর ইরান পরস্পরের স্থাপনায় যে হামলা চালিয়েছে সেগুলো এক ধরনের যুদ্ধ-যুদ্ধ বা হামলা-হামলা খেলা ছিল। কারণ, দুপক্ষই হামলার হওয়ার আগে বার্তা পেয়ে গিয়েছিল এবং সরঞ্জামাদি সরিয়ে নিয়েছিল।

শেষমেষ মার্কিন হস্তক্ষেপের পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে, এমনটাই খবর আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো প্রকাশিত হয়েছে। যদিও জাতিসংঘ বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা স্বীকৃত যুদ্ধবিরতির কোনো একক ও সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞা নেই, তারপরও যুদ্ধবিরতি এবং সংঘর্ষ বন্ধ করার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। ইরান-ইসরায়েলের বর্তমান পরিস্থিতিকে সংঘর্ষ আপাতত বন্ধ বলাটাই শ্রেয়। কারণ, সংঘর্ষ বন্ধ হয় অনানুষ্ঠানিক চুক্তির মাধ্যমে, আর যুদ্ধবিরতি হলে সেখানে একটা আনুষ্ঠানিকতা থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুই পক্ষের মধ্যে চুক্তি হয়, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থাকে। চুক্তিবদ্ধ পক্ষগুলো কোন কোন সামরিক কার্যকলাপ চালাতে পারবে, আর কোনটি পারবে না এবং যুদ্ধবিরতি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে, তা-ও স্পষ্ট উল্লেখ থাকে। ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে তেমন কিছুই হয়নি, যেটা হয়েছে সেটি হলো ট্রাম্প বলেছে তাই আপাতত সংঘর্ষ বন্ধ আছে। সে কারণে এই যুদ্ধ বিরতির খবর বিশ্বকে স্বস্তি দিলেও এটি অত্যন্ত ভঙ্গুর। কারণ, যুদ্ধবিরতি ঘোষণার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই দেশ দুটিকে পাল্টাপাল্টি হামলা চালাতে আমরা দেখেছি। শান্তির জন্য নোবেলের আবদারকারী ট্রাম্পকে এ নিয়ে ক্ষুব্ধ হতেও আমরা দেখেছি।

আপাতত বড় আকারের সংঘাত থেমেছে। কিন্তু যুদ্ধ কি সত্যিই শেষ হয়েছে? উত্তরটি হলো, সম্ভবত না। প্রত্যক্ষ ও সর্বাত্মক যুদ্ধ আপাতত থেমেছে, কিন্তু যে মৌলিক কারণগুলো থেকে এই সংঘাতের উৎপত্তি—পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, আদর্শিক শত্রুতা এবং আঞ্চলিক আধিপত্যের লড়াই—তার কোনো সমাধান হয়নি। তাই বর্তমান অবস্থাকে একটি যুদ্ধবিরতি না বলে একটি দীর্ঘমেয়াদী সংঘাতের সাময়িক বিরতি বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত। যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া তিনটি পক্ষেই নিজেদের জিত হয়েছে বলে দাবি করছে। এখানেই পরবর্তী সংঘাতের বীজ লুকিয়ে আছে। আর সংঘাতের পেছনে আরো বড় ভয়ের কারণ হলো গত টার্মের তুলনায় ডনাল্ড ট্রাম্পের বৈশ্বিক রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার পরিবর্তন। জানুয়ারিতে ডনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর অনেকের মধ্যে ধারণা ছিল সামনের কয়েকটি বছরে বিশ্ব হানাহানি থেকে রক্ষা পাবে। কারণ, তিনি নির্বাচনপূর্ব ঘোষণায় বলেছিলেন, বন্ধ করবেন মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত, আটকাবেন রাশিয়া-ইউক্রেন হামলা। কিন্তু বাস্তবতা বলছে একেবারেই ভিন্ন কথা। মধ্যপ্রাচ্য কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন – দুটোতেই বরঞ্চ সংঘাত নতুন রূপে ছড়িয়েছে। এবারের ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ ছিল একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এর আগে ১৯৬৭ বা ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করলেও, সরাসরি অভিযানে অংশ নেয়নি।

২০২৫ সালের এই হস্তক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার সমীকরণকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। এই সংজ্ঞায়নের ঢেউ বিষয়টিকে মধ্যপ্রাচ্যের সীমানার মধ্যে আবদ্ধ রাখছে না। এর ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে, যা বৈশ্বিক অর্থনীতি, ভূ-রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় সামনের দিনগুলো কমপক্ষে চারটি বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেল বিশ্ব রাজনীতি। প্রথমত, যে পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংসের জন্যে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র ইরানে হামলা চালালো, মধ্যপ্রাচ্যসহ আর্থিক ও সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী দেশগুলো সামনে নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সে পারমাণবিক সক্ষমতা গড়ে তুলতে চাইবে। এই যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, বিশেষ করে যেসব দেশে মার্কিন স্থাপনা আছে সেসব দেশকে নিজেদের নিরপত্তা কথা নতুন করে ভাবতে শেখাবে। ইতিমধ্যে তার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশ তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়াচ্ছে, যা বৈশ্বিক অস্ত্র নির্মাতাদের জন্য লাভজনক হলেও বিশ্ব শান্তির জন্য একটি অশনি সংকেত। প্রতিরক্ষা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এবং জ্বালানি খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর বেশ বেড়েছে। আবার যুদ্ধ পরবর্তী সাইলেন্ট আফটার ম্যাথ হিসেবে লেবানন, সিরিয়া, ইরাক এবং ইয়েমেনের মতো দেশগুলোতে, যেখানে ইরানের প্রভাব রয়েছে, সেখানে অস্থিতিশীলতা আরো বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। শিয়া-সুন্নি বিভাজন আরও গভীর হতে পারে এবং নতুন করে প্রক্সি যুদ্ধ শুরু হতে পারে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে, যা একটি নতুন শরণার্থী সংকট তৈরি করবে। ইরান ইতিমধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী গ্রহণকারী দেশ, যেখানে ৩.৫ মিলিয়ন শরণার্থী বসবাস করে।

মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী, শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।ছবি: DW

দ্বিতীয় ঝুঁকি হলো এই যুদ্ধ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্পষ্ট বিভাজন তৈরি করেছে এবং বিভিন্ন দেশের প্রতিক্রিয়া ছিল ভিন্ন ভিন্ন। যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতিতে এই বিভাজিত গ্রুপগুলোতে নিজেদের মধ্যে জোটবদ্ধ হতে পারে। রাশিয়া ও চীন উভয়ই ইরানে মার্কিন ও ইসরায়েলি হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। জাতিসংঘে রাশিয়ার দূত ভাসিলি নেবেনজিয়া এই হামলাকে 'জাতিসংঘ সনদ লঙ্ঘন' এবং 'আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী' বলে মন্তব্য করেছেন। চীনও এই হামলাকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছে। আবার এই সংঘাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছে। জার্মানি ইসরায়েলের নিরাপত্তার প্রতি তার অটল সমর্থন জানিয়েছে, অন্যদিকে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য কিছুটা নরম ও সমঝোতামূলক মনোভাব দেখিয়েছে, যা ইউরোপের প্রধান শক্তিগুলোর মধ্যে বিভাজন স্পষ্ট করে তুলেছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এই সংকট সমাধানে কার্যত অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ইরান ও ইসরায়েল উভয়ই একে অপরের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে। কিন্তু পরাশক্তিগুলোর ভেটো এবং মতবিরোধের কারণে নিরাপত্তা পরিষদ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি।

তৃতীয় ঝুঁকিটা হলো অর্থনৈতিক। মধ্যপ্রাচ্য বিশ্বের তেল ও গ্যাসের অন্যতম প্রধান উৎপাদনকেন্দ্র। এই অঞ্চলে যেকোনো ধরনের বড় সংঘাত বিশ্ব অর্থনীতিতে তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলে। যুদ্ধের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক ঝুঁকি ছিল হরমুজ প্রণালী নিয়ে উদ্বেগ। বিশ্বের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ তেল এই সংকীর্ণ জলপথ দিয়ে পরিবাহিত হয়। সামনের দিনে ইরান যে তার এই অস্ত্র ব্যবহার করবে না তার নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়েই ব্রেন্ট অপরিশোধিত তেলের দাম লাফিয়ে বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ৭৪.৬০ ডলারে পৌঁছেছিল। গোল্ডম্যান স্যাকসের বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন যে হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১৫০ ডলার বা তার বেশি হতে পারে। ক্যাপিটাল ইকোনমিক্সের পূর্বাভাস অনুযায়ী, একটি বিস্তৃত আঞ্চলিক যুদ্ধ বিশ্বকে ১৯৭০-এর দশকের মতো "স্ট্যাগফ্লেশনের" দিকে ঠেলে দিতে পারে।

চতুর্থ ঝুঁকিটা আমেরিকার জন্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। খামেনিকে উৎখাত করতে চায় আমেরিকা ও ইসরায়েল। কিন্তু এই যুদ্ধে যেভাবে উইন-উইন পর্যায়ে আছে তাতে ইরানীদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত হয়েছে, তারা আপাতত অভ্যন্তরীণ দমন-পীড়নকে ভুলে গেছে। নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, মার্কিন হামলার পর তেহরান ও অন্যান্য শহরে হাজার হাজার ইরানি রাস্তায় নেমে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিল। তারা এটিকে সরাসরি দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন বলে আখ্যা দিচ্ছেন। একটি শ্লোগান ছিল, "দেশের জন্য দেওয়া রক্ত মধুর চেয়েও মিষ্টি।” জেরুজালেম পোস্টের খবরে বলা হয়েছে, এতদিনের হামলা সত্ত্বেও ইরানি শাসকদের মধ্যে কোনো ভাঙন দেখা যায়নি। বরং তারা আরও একতাবদ্ধ হয়েছেন। ১৯৭৯ সালে পতিত রেজা শাহ পাহলভির পুত্র যুবরাজ রেজা পাহলভির আশা ছিল, ইসলামিক প্রজাতন্ত্র পরবর্তী ইরানে তিনি নেতৃত্ব দিতে পারবেন। ইসরায়েলি হামলার সুযোগে তিনি বিক্ষোভ, ধর্মঘট ও সরকার পতনের ডাক দিয়েছিলেন। তবে বাস্তবতা হলো, মার্কিন সমর্থকের ডাক তেহরানের মানুষ শুনেনি। ফলে খামেনির শাসনকে উৎখাত করতে গিয়ে নেতানিয়াহু এবং ট্রাম্প উল্টো আরো পাকাপোক্তই করে দিলো, যার খেসারত হয়তো পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে আরো অনেকদিন দিতে হবে।

ভঙ্গুর সংঘাত বিরতি টিকিয়ে রাখা এবং একটি স্থায়ী সমাধানে পৌঁছানো এখন আন্তর্জাতিক কূটনীতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই সংকটের ভবিষ্যৎ গতিপথ কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে: ইরান কি তার ক্ষতিগ্রস্ত পারমাণবিক অবকাঠামো পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করবে? ইসরায়েল কি প্রতিরোধমূলক হামলা চালিয়ে যাবে? এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মতো বিশ্বশক্তিগুলো কি উত্তেজনা প্রশমনে একটি সমন্বিত ভূমিকা পালন করতে পারবে, নাকি তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এই আগুনকে আরও উসকে দেবে? দীর্ঘমেয়াদী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন কূটনৈতিক সমাধান, যেমন ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে নতুন আন্তর্জাতিক চুক্তি বা ২০১৫ সালের জেসিপিওএ চুক্তির মতো একটি বহুপক্ষীয় চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করা। মধ্যপ্রাচ্যে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে যেখানে সব দেশের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে। আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়িয়ে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা তৈরি করতে হবে।

জুন ২০২৫-এর ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ নিছক একটি আঞ্চলিক সংঘাত ছিল না; এটি ছিল বিশ্ব ব্যবস্থার জন্য একটি সতর্কবার্তা। এই যুদ্ধ প্রমাণ করেছে, কয়েক দশক ধরে চলা ছায়া যুদ্ধ যেকোনো মুহূর্তে সরাসরি ও বিধ্বংসী সংঘাতে রূপ নিতে পারে, যার পরিণতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। পারমাণবিক স্থাপনার ওপর সরাসরি হামলা একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক উদাহরণ তৈরি করেছে, যা পারমাণবিক অ-প্রচার চুক্তির ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতের জন্য এক অশনি সংকেত দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপ এই সংঘাতের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এটি একদিকে যেমন মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে, তেমনই বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে এক নতুন প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। এই যুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রভাব, বিশেষ করে জ্বালানি তেলের বাজারে অস্থিরতা, প্রমাণ করে যে মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা কতটা ভঙ্গুর এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। যদিও একটি ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি আপাতত রক্তপাত থামিয়েছে, কিন্তু শান্তি এখনো বহু দূরে। সংঘাতের মূল কারণগুলো—ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং ইসরায়েলের অস্তিত্বের সংকট—এখনও অমীমাংসিত। উভয় পক্ষের অনড় অবস্থান, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ একটি স্থায়ী কূটনৈতিক সমাধানকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে।

শেষ পর্যন্ত, এই যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশ্বকে এক নতুন ও অনিশ্চিত বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে। এই বাস্তবতা হলো—পারমাণবিক ঝুঁকি এখন আর তাত্ত্বিক আলোচনার বিষয় নয়, বরং একটি বাস্তব হুমকি। মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ এখন নির্ভর করছে প্রধান শক্তিগুলোর প্রজ্ঞা, কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং এই অঞ্চলের দেশগুলোর সর্বোচ্চ সংযমের ওপর। অন্যথায়, এই ভঙ্গুর শান্তি ভেঙে গিয়ে যে সংঘাতের সূচনা হবে, তা হয়তো ২০২৫ সালের জুন মাসের চেয়েও ভয়াবহ হবে। তখন শত বছর শান্তি ভেঙে গিয়ে যে সংঘাতের সূচনা হবে, তা হয়তো ২০২৫ সালের জুন মাসের চেয়েও ভয়াবহ হবে। তখন শত বছর আগে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সভ্যতার সংকট' প্রবন্ধটি আবার আমাদের পড়তে হবে, আর চিন্তা করতে হবে যুদ্ধবাজদের রূপ কেমন করে শত বছর আগে তিনি ঠিক ঠাক ধরতে পেরেছিলেন।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ