ইরানকে অস্ত্র বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়াতে ব্যর্থ হয়ে ট্রাম্প প্রশাসন সার্বিক আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা চাপানোর উদ্যোগ নিচ্ছে৷ তবে বাকি দেশগুলি ওয়াশিংটনের যুক্তি মানতে প্রস্তুত নয়৷
বিজ্ঞাপন
আন্তর্জাতিক কূটনীতির মঞ্চে আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কতটা একঘরে হয়ে পড়েছে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তা স্পষ্ট হয়ে উঠল৷ ইরানের উপর জাতিসংঘের যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা নতুন করে চালু করতে মরিয়া ট্রাম্প প্রশাসন কোনো দেশের সহযোগিতা পাচ্ছে না৷ রাশিয়া ও চীন তো বটেই, সেইসঙ্গে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানিও এই উদ্যোগের বিরোধিতা করছে৷ এমনকি ট্রাম্পের অতি ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সরকারও ‘সংহতি’ দেখাতে প্রস্তুত নয়৷
দুই বছর আগে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি থেকে একতরফাভাবে বেরিয়ে আসার পর ট্রাম্প প্রশাসন সেই চুক্তির দোহাই দিয়ে ইরানের উপর অস্ত্র বিক্রিসহ যাবতীয় আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা চাপানোর চেষ্টা চালাচ্ছে৷ স্বাক্ষরকারী বাকি দেশগুলি এ ক্ষেত্রে অ্যামেরিকার এক্তিয়ার মানতেই প্রস্তুত নয়৷ তাছাড়া ইরান সরাসরি চুক্তি লঙ্ঘন করছে, এমন অভিযোগও ধোপে টিকছে না৷ বরং ওয়াশিংটনের বেপরোয়া আচরণের কারণেই ইরান বাকি দেশগুলির উপর চাপ বাড়াতে কিছু প্ররোচনামূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে৷ যেমন মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে ইরান নির্ধারিত মাত্রার তুলনায় বেশি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়া চালিয়েছে৷
এমনই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প প্রশাসন নিরাপত্তা পরিষদে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে৷ গত সপ্তাহে অস্ত্র বিক্রির ক্ষেত্রে ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞার উদ্যোগ বানচাল হয়ে গিয়েছিল৷ এবার সে দেশের বিরুদ্ধে পরমাণু চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগে ‘স্ন্যাপব্যাক’ নিষেধাজ্ঞা চাপানোর প্রচেষ্টাও বাধার মুখে পড়েছে৷
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও সাংবাদিকদের বলেন, ইরানকে অস্ত্র বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ না বাড়ানো এক মারাত্মক ভুল৷ ‘একতরফা ও বোকামিতে ভরা' পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর করার জন্য তিনি প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সমালোচনা করেন৷
ট্রাম্প প্রশাসনের এমন কোণঠাসা অবস্থা সম্পর্কে তীর্যক মন্তব্য করতে ছাড়ে নি ইরান৷ জাতিসংঘে ইরানের রাষ্ট্রদূত মজিদ তখত রাফানচি বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের এক স্থায়ী সদস্য শিশুর মতো আচরণ করছে৷ আন্তর্জাতিক সমাজের অন্যান্য সদস্যরা সে দেশকে উপহাস করছে৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইরানের তিন উচ্চপদস্থ নেতা চলতি সপ্তাহে সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, যে সমস্যা সত্ত্বেও সে দেশ পরমাণু চুক্তি মেনে চলতে চায়৷ অ্যামেরিকায় নভেম্বরের নির্বাচনে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হলে সেই চুক্তি বেঁচে যাবে বলে তাঁরা আশা করছেন৷ উল্লেখ্য, ইরান চুক্তির সব ধারা আবার মানলে বাইডেন আবার পরমাণু চুক্তিতে অংশ নেবার পক্ষে৷ সেইসঙ্গে তিনি অবশ্য ইরানের অন্যান্য ‘আপত্তিকর’ কার্যকলাপ কমাতে চাপ সৃষ্টি করতে চান৷
এসবি/এসিবি (রয়টার্স, ডিপিএ)
২০১৮ সালের ২৮ মের ছবিঘরটি দেখুন...
ইরান পরমাণু চুক্তি কী ও কেন?
অ্যামেরিকা একতরফাভাবে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি বাতিল করলেও বাকি স্বাক্ষরকারী দেশগুলি চুক্তি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর৷ ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন’ নামের এই চুক্তির প্রধান শর্তগুলি কী?
ছবি: picture-alliance/dpa/H. Neubauer
পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ?
২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ইরান শুধু পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালাতে পারবে না৷ তবে আন্তর্জাতিক নজরদারির মধ্যে শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচি চালু রাখার অধিকার সে দেশের রয়েছে৷ অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চিকিৎসার মতো ক্ষেত্রে পরমাণু শক্তি কাজে লাগানো যেতে পারে৷
ছবি: Getty Images/IIPA
ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ
চুক্তির প্রথম আট বছরে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের সীমা মেনে চলতে রাজি হয়েছিল৷ সেইসঙ্গে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত গবেষণাও বন্ধ থাকবে৷ আন্তর্জাতিক পরমাণু জ্বালানি সংস্থা আইএইএ ইরানের কার্যকলাপের উপর নজর রেখে চলেছে৷ জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, চীন ও রাশিয়া এক্ষেত্রে আইএইএ-র মূল্যায়নকেই গুরুত্ব দিয়ে আসছে৷
ছবি: Kazem Ghane/AFP/Getty Images
পরমাণু ভাণ্ডারের ভবিষ্যৎ
চুক্তির আওতায় ইরান ৩,৬৭ শতাংশ সমৃদ্ধকৃত ইউরেনিয়ামের ভাণ্ডার ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত কমানোর অঙ্গীকার করেছিল৷ অর্থাৎ ১৫ বছরের জন্য ৩০০ কিলোগ্রামের বেশি এমন মানের ইউরেনিয়াম ইরানের হাতে থাকার কথা নয়৷ ফলে পরমাণু অস্ত্র তৈরির পথ আপাতত বন্ধ থাকছে৷
ছবি: BEHROUZ MEHRI/AFP/Getty Images
নিষেধাজ্ঞা শিথিল
ইরান শর্ত পূরণ করার পরিবর্তে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সে দেশের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল৷ ফলে ইরান আবার আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়াম বিক্রি ও আন্তর্জাতিক অর্থ বাজারে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছিল৷ অ্যামেরিকার চাপের মুখে সেই সুবিধা হাতছাড়া করতে চায় না ইরান৷
ছবি: FARS
চুক্তিভঙ্গের পরিণতি
পরমাণু কর্মসূচির উপর আন্তর্জাতিক নজরদারির ফলে একটি পরমাণু বোমা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান তৈরি করতে ইরানের কমপক্ষে এক বছর লাগবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন৷ সে রকম প্রচেষ্টা চালালে আবার সে দেশের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা চাপানোর বিধান মেনে নিয়েছে ইরান৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Jenis
চুক্তির মেয়াদ শেষের অবস্থা
সমালোচকরা বার বার চুক্তির ‘সানসেট ক্লজ’ বা মেয়াদ শেষের অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন৷ তাদের অভিযোগ, শান্তিপূর্ণ লক্ষ্যে পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা সত্ত্বেও ইরান চুক্তির মেয়াদ শেষে আবার অস্ত্র তৈরির কাজ শুরু করবে৷ তবে চুক্তির প্রবক্তারা মনে করিয়ে দেন, যে বিভিন্ন ধরনের কার্যকলাপের উপর ১০, ১৫, ২০ বা ২৫ বছর পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকবে৷
ছবি: Fars
ক্ষেপণাস্ত্র ও আঞ্চলিক প্রভাব
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকরা ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির বাড়বাড়ন্ত ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে সে দেশের প্রভাব প্রতিপত্তির কড়া সমালোচনা করেন৷ ইউরোপসহ অন্যান্য অনেক দেশও বিষয়ে একমত৷ তবে ‘সফল’ পরমাণু চুক্তি বাতিল করার বদলে তা কাজে লাগিয়ে ইরানের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চায় তারা৷