১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ইরানে মার্কিন সমর্থিত একনায়ক শাহ সরকারের পতন ঘটে৷ এ বছর তাই ইসলামি বিপ্লবের ৩৫ বর্ষপূর্তি উদযাপন করছেন ইরানের মানুষ৷ সেইসঙ্গে চলছে যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী বিক্ষোভও৷
বিজ্ঞাপন
বিপ্লবের ৩৫তম বর্ষপূর্তিতে মঙ্গলবার রাস্তায় নেমে আসেন ইরানের হাজারো মানুষ৷ আজাদি স্কয়ারে দিবসটি উপলক্ষ্যে ভাষণ দেন প্রেসিডেন্ট হাসান রোহানি৷ অনেকেই এ সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী স্লোগান দেন৷ সংবাদ সংস্থা এএফপিকে ২০ বছর বয়সি এক বিক্ষোভকারী বলেন, ‘‘আমরা অ্যামেরিকাকে বিশ্বাস করি না৷ তারা আমাদের সম্পদ কুক্ষিগত করতে চায়৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক অবরোধ বরং আমাদের অধিকার রক্ষায় আরো সুবিধা করেছে৷ আর এতে আমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না৷''
ইরানে নারীর ভোটাধিকারের পঞ্চাশ বছর
১৯৬৩ সালে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলাভি’র আমলে তৎকালীন ‘সাদা বিপ্লব’ এর আওতায় আনুষ্ঠানিকভাবে ইরানের নারীদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়৷
ছবি: AP
‘সাদা বিপ্লব’
গত পঞ্চাশ বছর ধরে ভোটদানের ক্ষমতা রয়েছে ইরানের নারীদের৷ ১৯৬৩ সালে শাহ মোহাম্মদ পাহলাভির মেয়াদকালে এই অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়৷ সেবছরের ২৬ জানুয়ারি গণভোটের মাধ্যমে এটি অনুমোদন করা হয়৷ প্রথমদিকে এই ‘সাদা বিপ্লবের’ প্রতি জনগণের সমর্থন ছিল৷
ছবি: Kayhan
ধর্মীয় নেতাদের তরফ থেকে বাধা
১৯৬৩ সালের মাঝামাঝি নারীর ভোটাধিকারসহ বিভিন্ন সংস্কার বাধার মুখে পড়ে৷ ইরানের ধর্মীয় নেতারা সাদা বিপ্লবের বিরোধিতা করেন৷ সেসময় রাজনীতির ময়দানে আয়াতোল্লা খোমায়েনির উত্থান ঘটে৷ তবে সরকার বিরোধীদেরকে কঠোর হাতে দমন করা শুরু করলে নির্বাসনে চলে যান তিনি৷
ছবি: IRNA
কয়েক দশকের সংস্কার
শাহ পাহলাভির চার দশকের শাসনকাল, মানে ১৯৪১ থেকে ১৯৭৯ সাল অবধি ইরানের নারীরা অনেক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন৷ এগুলোর মধ্যে সন্তানের দায়িত্ব গ্রহণের অধিকার এবং বিয়ের জন্য মেয়েদের নূন্যতম বয়সসীমা, ১৮ বছর৷ তারা সেসময় বিবাহবিচ্ছেদ এবং গর্ভপাতের অধিকারও পায়৷ অন্যদিকে, পুরুষের বহুবিবাহের প্রথা সীমিত করা হয়৷
ছবি: footballitarin
ইসলামি বিপ্লবের ফলাফল
১৯৭৯ সালে শাহকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা হয়৷ সেসময় ইরানের নারীরা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন৷ শাহ’র পতনের পর পরই প্রগতিশীল নারী অধিকার বিষয়ক আইনগুলো বাতিল করা হয়৷ নারীদের বিবাহবিচ্ছেদ এবং সন্তানের দায়িত্ব নেওয়ার অধিকার সঙ্কুচিত করা হয়৷ মেয়েদের বিয়ের নূন্যতম বয়স আবারো নয় বছর করে দেওয়া হয়৷ পুরুষকে ইচ্ছেমত বহুবিবাহের সুযোগ দেওয়া হয়৷
চাপ সত্ত্বেও এগনোর চেষ্টা
আইনিভাবে কম অধিকার থাকা সত্ত্বেও অনেক ইরানি নারী তাদের স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার চেষ্টা করেছেন, বিশেষ করে চাকুরির ক্ষেত্রে৷ যেসব কাজে সাধারণত পুরুষদের আধিপত্য থাকে, সেসব কাজও করছেন ইরানের মেয়েরা৷ আজকাল ইরানের নারীরা ট্যাক্সি এমনকি দূরপাল্লার ট্রাকও চালাচ্ছেন৷ তারা এখন শিক্ষক, চিকিৎসক, পুলিশ, সাংসদ এমনকি রাষ্ট্রপতির পরামর্শকও হচ্ছেন৷
ছবি: AP
মোহাম্মদ খাতামিকে সমর্থন
১৯৯৭ এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন নারী এবং তরুণ সমাজ৷ তারাই সংস্কারপন্থী মোহাম্মদ খাতামিকে ক্ষমতায় আনেন৷ প্রথমবার জয়ের পর নারীদের সংগঠন ও ক্লাব তৈরির ক্ষেত্রে যে আইনি বাধা ছিল, তা শিথিল করেন খাতামি৷
ছবি: AP
নারী অধিকারের প্রতীক
ইরানে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে শিরিন এবাদির নাম৷ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি ২০০৩ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার জয় করেন৷ ২০০৯ সালের শেষ অবধি ইংল্যান্ডে নির্বাসিত জীবন কাটান এবাদি৷ ইরান এবং ইরানের বাইরে অনেকে ‘আইকন’ হিসেবে বিবেচনা করেন এই আইনজীবী তথা অ্যাক্টিভিস্টকে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সবুজ আন্দোলনের দোসর
ইরানে নারীর সমানাধিকারের দাবিতে ২০০৬ সালে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, যেখানে দশ লাখ মানুষের স্বাক্ষর আহ্বান করা হয়৷ সেই উদ্যোগের সূত্র ধরে ২০০৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় সবুজ আন্দোলন গড়ে তোলা হয়৷ তখন নারীর সমানাধিকারের দাবিতে রাস্তায় নামে পুরুষরাও৷
ছবি: AP
‘আমার কণ্ঠ কোথায়?’
সবুজ আন্দোলনের সমর্থকরা ইরানের সংস্কারপন্থী প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মির-হোসেন মুসাভিকে সমর্থন জানায়৷ কিন্তু অত্যন্ত বিতর্কিত নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় পুর্ননির্বাচিত হয়েছেন মাহমুদ আহমেদিনেজাদ৷ সেসময় নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে কয়েক সপ্তাহ ধরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে হতাশ নারী-পুরুষরা৷ তারা ‘হোয়্যার ইজ মাই ভয়েস?’ শীর্ষক ব্যানার এবং শ্লোগানে তেহরানের রাজপথ ভরিয়ে ফেলে৷
ছবি: AP
আশা আছে?
চলতি বছরের জুন মাসে ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে৷ এই নির্বাচনকে সামনে রেখে আশাবাদী হয়ে উঠছেন ইরানের নারী অধিকার বিষয়ক অ্যাক্টিভিস্টরা৷ আগামী নির্বাচনকে তারা আবারো নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজে লাগাতে চান৷ এই লক্ষ্যে তৈরি হচ্ছে সুনির্দিষ্ট দাবি৷ সেসব দাবির ভবিষ্যত অবশ্য সময়ই বলে দেবে৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
ক্ষমতাচ্যুত ইরানের সাবেক শাহকে সমর্থন করায় ১৯৮০ সালে তেহরানে মার্কিন দূতাবাসের ৫২ জন কূটনীতিককে বন্দি করে ইরানি ছাত্ররা৷ এর পর থেকে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো দাপ্তরিক সম্পর্ক নেই৷
গত বছরের নভেম্বরে ইরান এবং পি (৫+১) দেশগুলোর মধ্যে পারমাণবিক যে আলোচনা হয়, তাতে ছয় মাসের মধ্যে ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি কমানোর ব্যাপারে একমত হয়৷ ইরানের আশা, এর ফলে আর্ন্তজাতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল হবে৷ ঐ চুক্তির ফলে এটাই বোঝা যায়, রোহানি পররাষ্ট্রনীতিতে সফল হয়েছেন৷ কেননা গত ৮ বছর ধরে শক্তিধর দেশগুলোর সাথে ইরানের আলোচনা বন্ধ ছিল৷ বরং কট্টরপন্থী নেতা মাহমুদ আহমাদিনেজাদের কারণে আরো বেশি নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছিল ইরান৷
সোমবার বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে তেহরানভিত্তিক বিদেশি কূটনীতিকদের রোহানি জানান, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও জার্মানির সাথে চূড়ান্ত চুক্তির ব্যাপারে আলোচনা করতে ইরান প্রস্তুত৷
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সমর্থন রয়েছে রোহানির উপর৷ খামেনি গত সপ্তাহে বলেছেন, রোহানির উপর তাঁর আস্থা রয়েছে এবং সবার ধৈর্য্য ধরা উচিত৷
এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ জানিয়েছেন, পরমাণু ইস্যুতে পরবর্তী দফায় আলোচনা বেশ কঠিন হবে, কেননা যুক্তরাষ্ট্রের উপর ইরানিদের কোনো আস্থা নেই৷ ১৮ ফেব্রুয়ারি আবার শুরু হবে এই আলোচনা৷
এর আগে, শনিবার আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা বা আইএইএ-র সাথে ইরানের আলোচনা শুরু হয়৷ দুই দিনের আলোচনার ফল কি হয়েছে সে ব্যাপারে দুপক্ষ মিলে যৌথ বিবৃতি দিলেও সেখানে কি কি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে তার বিস্তারিত জানানো হয়নি৷ আইএইএ-র ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, সাতটি নতুন পদক্ষেপের ব্যাপারে তারা একমত হয়েছে, যা আগামী ১৫ মে থেকে বাস্তবায়ন করা হবে৷
এদিকে সোমবার নতুন আরো দুটি ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে ইরান৷ যেখানে শনিবার তেহরান ঘোষণা করেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের দিকে জাহাজ পাঠাবে তারা৷
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আহমাদিনেজাদের চেয়ে কিছুটা মধ্যপন্থি ইরানের চেহারা বিশ্ব নেতাদের কাছে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন রোহানি৷ তবে এর মানে এই নয় যে, ইরানের আদর্শ ও নীতিতে আসলেই যে পরিবর্তন হয়েছে তা তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন তিনি৷