শিয়া আর সুন্নি প্রশ্নে গোটা মুসলিম বিশ্বই দুইভাগে বিভক্ত৷ তবে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ৷ মোটা দাগে এই দেশের মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুন্নি সংঘাতের কোনো উদাহরণ নেই৷
বিজ্ঞাপন
ইরানের জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যার পর গোটা মধ্যপ্রাচ্য এখন ভয়াবহ এক সঙ্কটের মুখোমুখি৷ বাজছে যুদ্ধের দামামা৷ প্রতিনিয়তই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটছে৷ এর মধ্যে ইসরায়েল, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিজেদের মতো করে এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে৷ শুধু চুপ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোই৷ হামলাটি ইরাকে হয়েছে, স্বভাবতই সেই দেশটি নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছে৷ কিন্তু বাকিরা?
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বরাবরই শিয়া-সুন্নি ইস্যুতে বিভক্ত থেকেছে, এ নিয়ে প্রতিনিয়ত তাদের রক্তাক্ত সংঘাতের ঘটনা ঘটে৷ বিশ্বের দেড়শো কোটি মুসলমানের মধ্যে ৮৫-৯০ ভাগ সুন্নি সম্প্রদায়ের বলে ধরে নেয়া হয়৷ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে মিশর, জডার্ন আর সৌদি আরবে সুন্নিদের হার নব্বইভাগের মতো৷ অন্যদিকে ইরান, ইরাক, বাহরাইন, আজারবাইজান আর ইয়েমেনে শিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ৷ সোলেইমানির হত্যাকাণ্ড এইসব দেশের শিয়া-সুন্নি বিভেদকে আরেকদফা উসকে দেয়ার সম্ভাবনা আছে৷ কেননা কাসেম সোলেইমানি মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে শিয়াদের নতুন প্রভাববলয় তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন৷ বিভিন্ন দেশের শিয়াগোষ্ঠীকে সামরিক সহায়তা দেয়া থেকে শুরু করে সিরিয়ায় আইএস এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইরানের পক্ষ থেকে তিনিই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন৷
সোলেইমানির জানাযায় জনতার এক আওয়াজ, ‘প্রতিশোধ, প্রতিশোধ’
কাসিম সোলেইমানির জানাযায় লাখো মানুষের ঢল নামে৷ সেখানে কান্নায় ভেঙে পড়েন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা৷ সোলেইমানির কন্যা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কালো দিন অপেক্ষা করছে৷ জনতার ঢলে ওঠে, ‘‘প্রতিশোধ, প্রতিশোধ’’ আওয়াজ৷
ছবি: picture-alliance/AP/Tasnim/M. Hossein Thaghi
জানাযায় জনস্রোত
শুক্রবার এক ড্রোন হামলায় ইরানের কুদস বাহিনীর প্রধান কাসিম সোলেইমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী৷ হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে ইরান সরকার৷ ইরাক থেকে সোলেইমানির মৃতদেহ আনার পর সোমবার রাজধানী তেহরানে প্রথম জানাযা হয়৷ ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানাযায় ১০ লাখেরও বেশি মানুষের অংশ নেয়ার কথা বলেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP/ISNA/A. Mohammadi
ডুকরে কেঁদে ওঠেন খামেনি
তিনদিনের শোক শেষে অনুষ্ঠিত জেনারেল সোলেইমানির প্রথম জানাযা পড়ান ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লাহ আলী খামেনি৷সোলেইমানির কফিনের ওপর তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন৷ এ সময় প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি, কুদস বাহিনীর নতুন প্রধান এসমাইল কা’নিসহ ইরানের অন্য অনেক শীর্ষ নেতাও খামেনির পাশে ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Iran Press TV
সোলেইমানির কন্যার হুমকি
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সোলেইমানির কন্যা জয়নাব সোলেইমানি বলেন, ‘‘এখন থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যে সেনাসদস্যরা আছেন তাদের পরিবার সন্তানের মৃত্যুর খবরের অপেক্ষায় থাকবেন৷’’ তার বাবাকে হত্যার নির্দেশ দেয়া ডনাল্ড ট্রাম্পের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘‘উন্মাদ ট্রাম্প, ভেবো না আমার বাবা শহিদ হওয়ায় সব শেষ হয়ে গেছে৷’’ তিনি আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আর তার মিত্র ইসরায়েলের জন্য ‘কালো দিন’ অপেক্ষা করছে৷
ছবি: AFP/Office of Iran's Supreme Leader Ayatollah Ali Khamenei
‘যুক্তরাষ্ট্রকে তাড়াবো’
তেহরানে জানাযা শুরুর আগে রাষ্ট্রীয় বেতারকে সোলেইমানির মৃত্যুর পর কুর্দস বাহিনীর দায়িত্ব নেয়া কা’নিও প্রতিশোধের ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘‘আমরা আমাদের বাহিনী নিয়ে শহিদ সোলেইমানির দেখানো পথেই এগিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করছি৷ এ অঞ্চল থেকে আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে তাড়াবো, কারণ, এটাই উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ৷’’
জানাযায় দশ লাখেরও বেশি মানুষ অংশ নিয়েছে বলে দাবি করেছে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন৷ জনস্রোত থেকে বারবার ‘‘প্রতিশোধ, প্রতিশোধ’’ ওঠে৷
ছবি: Reuters/WANA/N. Tabatabaee
সোলেইমানির স্মৃতি
জানাযায় উপস্থিত জনতার হাতে আয়াতোল্লাহ আলী খামেনির হাত থেকে সোলেইমানির জোলফাঘর, অর্থাৎ সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ স্বীকৃতি নেয়ার ছবি৷
ছবি: AFP/A. Kenare
সেনাপ্রধানের কান্না
সোলেইমানির কফিনের ওপর নুয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ইরানের রেভোল্যুশনারি গার্ডের কমান্ডার ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি৷
ছবি: AFPAFP/Office of Iran's Supreme Leader Ayatollah Ali Khamenei
সেনাসদস্যদের হাতেও সোলেইমানির ছবি
আর্মি ক্যাডেটদের হাতেও দেখা যায় সোলেইমানির ছবি৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/E. Noroozi
‘আমরা সবাই সোলেইমানি’
জানাযায় উপস্থিত অনেকের হাতেই দেখা যায়, ‘আমরা সবাই সোলেইমানি’ লেখা পোস্টার৷
ছবি: Reuters/WANA/N. Tabatabaee
পরের জানাযা কেরমানে
মঙ্গলবার জেনারেল সোলেইমানির দ্বিতীয় জানাযা হবে তার নিজের শহর কেরমান-এ৷
ছবি: Reuters/WANA/N. Tabatabaee
10 ছবি1 | 10
সাবেক সিআইএ অ্যানালিস্ট কেনেথ পোলাক টাইম ম্যাগাজিনে সোলেইমানি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘‘মধ্যপ্রাচ্যের শিয়াদের কাছে কাসিম সোলেইমানি একাধারে জেমস বন্ড, আরউইন রোমেল এবং লেডি গাগার সম্মিলিত এক চরিত্র৷'' ঠিক একই কারণে তিনি সুন্নিদের কাছে অপ্রিয়৷ তার হত্যাকাণ্ড নিয়ে তৈরি হওয়া সঙ্কট মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমদের দুই সম্প্রদায়ের বিভেদকে তাই আরো নাজুক করে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে৷ এই প্রভাব কি বাংলাদেশে পড়বে?
বাংলাপিডিয়ার তথ্য বলছে, এই অঞ্চলে শিয়া মতবাদ প্রচারিত হয় সতেরো শতকের প্রথম ভাগে পারস্যের বনিক ও পর্যটকদের মাধ্যমে৷ গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে শিয়াদের সংখ্যা দশ লাখের মতো৷ এরমধ্যে ঢাকায় বাস করেন দুই লাখ৷ আপাতদৃষ্টিতে দেশে শিয়া আর সুন্নিদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই৷
আশুরায় ঢাকার বিভিন্ন স্থানে শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষে তাদের ঐতিহ্যবাহী তাজিয়া মিছিল করে আসছে বছরে পর বছর ধরে৷ যা নিয়ে উৎসাহ থাকে অনেক সুন্নির মধ্যেও৷ ২০১৫ সালে অবশ্য একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে৷ সেবার বোমা হামলায় নিহত হয়েছিলেন একজন৷ কিন্তু দেশের শিয়া-সুন্নির সম্প্রীতির সম্পর্কে তার কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি৷
পাকিস্তান, আফগানিস্তান এমনকি ইন্দোনেশিয়াতেও শিয়ারা সুন্নিদের দমন পীড়নের শিকার হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে৷ বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে এসব সংঘাতের তিক্ততায় বাংলাদেশের মানুষ আগে যখন জড়ায়নি, সামনেও জড়াবে না এমনটাই প্রত্যাশা৷