ইলিশ এখন বাংলাদেশের ‘ভৌগলিক নির্দেশক' বা জিআই পণ্য হিসেবে পৌঁছাবে নানা দেশে৷ মৎস্য অধিদপ্তরের আবেদনে দেশের ঐতিহ্যের ধারক-বাহক জাতীয় মাছ ইলিশ জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধন পাচ্ছে৷ এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে চলছে আলোচনা৷
বিজ্ঞাপন
গত দু'মাসে ইলিশ মাছ নিয়ে কারো আপত্তি না থাকায় ‘জিআই' পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর৷ শিগগিরই মৎস্য অধিদপ্তরের কাছে এ সংক্রান্ত সনদ হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছে তারা৷
জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের আবেদনে মৎস্য অধিদপ্তর জানায়, ১৮২২ সাল থেকে ইলিশ বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও কৃষ্টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে৷ অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও আমিষ জাতীয় খাদ্যে এ মাছের ভূমিকা রয়েছে৷
এই খবরে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ইতিবাচক ও নেতিবাচক মন্তব্য উঠে এসেছে৷ কেউ বলছেন, এর ফলে ইলিশের দাম বেড়ে যাবে, আবার কেউ বলছেন এই স্বীকৃতিতে আদৌ কোন লাভ আছে কি? তবে বেশিরভাগ মানুষই খুশি হয়েছেন এতে৷ তাই এ সংক্রান্ত সংবাদও শেয়ার করেছেন ফেসবুক পাতায়৷
পলাশ মাহবুব ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, ‘‘ইলিশ এখন শুধুই বাংলাদেশের৷ সারা বিশ্বে আমাদের (জিআই) পণ্য হিসেবে পরিচিতি পাবে ইলিশ৷''
খায়রুল ইসলাম লিখেছেন, ‘‘জামদানির পর এবার বাংলাদেশের ইলিশ মাছ ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে৷ এর ফলে ইলিশ বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে সারা বিশ্বে স্বীকৃতি পেল৷''
মুজাহিদুল ইসলাম অবশ্য ইলিশ ধরার উপর কঠোর আইন আরোপের দাবি জানিয়েছেন৷ তিনি লিখেছেন,‘‘ইলিশ মাছ এক বছর ধরা যাবে, আরেক বছর ধরা নিষেধ – এই ধরনের কঠোর আইন করা দরকার৷ যে বছর ধরা হবে – তা হিমায়িত করে পরের বছর বাজারে ছাড়া উচিত৷ এতে বড় সাইজের ইলিশ পাওয়া যাবে এবং উৎপাদন বহুগুণ বাড়বে৷ দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা যাবে৷ শুধু প্রথম যে বছর ধরা হবে না – সেই বছর ইলিশ না হয় না খেলাম৷ পরবর্তী বছর থেকে ইলিশের অভাব হবে না৷''
সাংবাদিক সুমন মাহবুব লিখেছেন,‘‘ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম৷ বাংলাদেশে বিশ্বের মোট ৭৫ শতাংশ ইলিশ আহরিত হয়৷ এছাড়া ১৫ শতাংশ মিয়ানমার, ৫ শতাংশ ভারত ও ৫ শতাংশ অন্যান্য দেশের৷''
শাহিন লিখেছেন, ‘‘ইলিশ আমার বাপ, দাদার, ১৪ গোষ্ঠীর সম্পত্তি! তাই জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই৷ কিন্তু আফসোস একটাই, বিশ্বের শতকরা ৭৫ শতাংশ ইলিশ এদেশে উৎপাদন হলেও এদেশের শতকরা ১৫% মানুষ ইলিশ চোখেই দেখে না, খাওয়া তো দূরের কথা!''
সাবু শাহাবুদ্দীন লিখেছেন, ‘‘ইলিশ মাছের জি.আই. পাওয়া ভালো কথা৷ তবে কারেন্ট জাল বানানোর কারখানা বন্ধ করা না গেলে এই খুশি বেশিদিন থাকবে না৷''
ফরহাদ সবুজ অনেক নেতিবাচক খবরের মধ্যে এই খবরটিকে সুসংবাদ হিসেবেই দেখছেন৷ তিনি লিখেছেন, ‘‘এই খুন খারাপির মধ্যে একটা সুসংবাদ, বাংলাদেশের ইলিশ মাছ জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে৷''
অন্যদিকে, শরিফুল ইসলাম লিখেছেন, এই সুযোগে এখন দেশের বাজারে ইলিশের দাম আরও বেড়ে যাবে৷
সংকলন: অমৃতা পারভেজ
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ
ইলিশ রক্ষায় বিশ্বের কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ
ইলিশকে বাংলাদেশে ‘মাছের রাজা’ হিসেবেই মানেন সবাই৷ দেশের বাইরেও পদ্মার ইলিশের অনেক কদর৷ সেই ইলিশ হারাতে বসেছিল বাংলাদেশ৷ তবে সুদিন আবার ফিরছে৷ উৎপাদন বাড়ছে৷ ইলিশ উৎপাদনে সারা বিশ্বের জন্যই দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ৷
ঈদ, পুজো, পহেলা বৈশাখ- উৎসব ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক যে ধরণেরই হোক না কেন, ইলিশ ছাড়া কিন্তু বাঙালির ভোজন জমে না৷
ছবি: Imago/Z.H. Chowdhury
ইলিশে বসতি বাণিজ্য
সরকারি হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে ইলিশের অবদান ১ শতাংশ৷ আর দেশের মোট মাছের ১১ শতাংশই ইলিশ৷ বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখ জেলে আছেন৷ এছাড়াও প্রায় ২০ লাখ মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস ইলিশ৷ মাছ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের ৬৫ শতাংশই উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে৷
ছবি: Imago/UIG
ইলিশ থেকে ওষুধ
ইলিশ খুব তেলতেলে মাছ৷ সম্প্রতি সেই তেলেরও বিশেষ এক গুণের কথা জানা গেছে৷ জানা গেছে, ইলিশ মাছে যে ‘ওমেগা-৩’ ধরনের তেল আছে, তা দিয়ে ওষুধ তৈরি করা যায়৷ হৃদরোগসহ বেশ কিছু রোগ সারানোয় ভূমিকা রাখতে পারে এই ওষুধ৷ ইতিমধ্যে ইলিশের তেল থেকে ওষুধ তৈরি করা শুরু করেছে বেশ কিছু দেশ৷
ছবি: Imago/Z.H. Chowdhury
দুঃসময়ের পদধ্বনি...
ইলিশের দুর্দিন মানে ভোজনরসিকদের দুর্ভাবনা৷ ইলিশ কমতে শুরু করায় বাংলাদেশও পড়েছিল দুর্ভাবনায়৷ তার প্রভাব এমন কিছু দেশে পড়েছিল যেসব দেশের মানুষ পদ্মার ইলিশের জন্য মুখিয়ে থাকে৷ বাংলাদেশ, ভারত বা শুধু এশিয়ার হাতে গোনা কয়েকটি দেশ নয়, ইউরোপ-অ্যামেরিকাতেও ইলিশ আজকাল পাতে উঠছে৷ যুক্তরাষ্ট্র, নিউজিল্যান্ড ও ইউরোপের কিছু দেশে ইলিশের স্যুপের জনপ্রিয়তা দিনদিন বাড়ছে৷
ছবি: Imago/UIG
সংকটের কারণ...
ইলিশ কমতে শুরু করেছিল মূলত দুটি কারণে৷ এক, অতিরিক্ত মাত্রায় মা ও জাটকা ইলিশ ধরা; দুই, ব্যাপক পরিবেশ দূষণ৷ শুধু বাংলাদেশ নয়, অনেক দেশেই ইলিশ কমতে শুরু করেছিল৷ তবে খুশির কথা, ইলিশ রক্ষায় বাংলাদেশ বিশ্বের অন্য সব দেশকে ছাড়িয়ে গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Chowdhury
ইলিশ রক্ষায় পদক্ষেপ
২০০২ সালের পর থেকে ইলিশ রক্ষায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ৷ ডিম পাড়া ও বিচরণের স্থান চিহ্নিত করা, বছরের আট মাস জাটকা ধরা এবং ডিম পাড়ার ১৫ দিন সব ধরনের ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করার সুফল এখন পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ৷ জেলেদের প্রতিও দেয়া হয়েছে বিশেষ মনযোগ৷ ইলিশ ধরেন এমন জেলেদের মধ্যে এ পর্যন্ত ২ লাখ ২৪ হাজার জনকে পরিচয়পত্র দেয়া হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বাড়ছে ইলিশ, আসছে সুফল
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ইলিশের দুর্দিন অনেকটাই কেটে গেছে৷ ইলিশ ধরা বেড়েছে, পাশাপাশি ইলিশও বাড়ছে৷ মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও বঙ্গোপসাগর থেকে ২০০৯-১০ মৌসুমে দুই লাখ টন ইলিশ ধরা হয়, ২০১৪ সালে তা বেড়ে হয়ে যায় ৩ লাখ ৮৫ হাজার টন, ২০১৫, অর্থাৎ চলতি বছর চার লাখ টন ইলিশ ধরা পড়বে বলে আশা করছে মৎস্য অধিদপ্তর৷
ছবি: Imago/UIG
বাংলাদেশ সবার কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
ওয়ার্ল্ড ফিশ-এর পর্যবেক্ষণ বলছে, সারা বিশ্বে মূলত যে ১১টি দেশে ইলিশ হয় সেগুলোর মধ্যে ১০টিতেই ইলিশ কমছে, শুধু বাংলাদেশেই লক্ষণীয় মাত্রায় উৎপাদন বাড়ছে৷ বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির হার বছরে শতকরা ৮ থেকে ১০ শতাংশের মতো৷ ফলে ইলিশ রক্ষায় অনেক দেশের কাছেই বাংলাদেশ এখন ‘রোল মডেল’৷