দিল্লির জতুগৃহে আগুনের বলি ৪৩ জন শ্রমিক। পুরনো দিল্লির যে জায়গায় এ ঘটনা ঘটেছে, সেখানে কার্যত আগুনের জন্য যাবতীয় ফাঁদ পাতা আছে। যেভাবে দিল্লিতে বেআইনি কারখানা কাজ করে যাচ্ছে, তাতে এরকম ভয়াবহ আগুন বন্ধ হবে কী করে?
বিজ্ঞাপন
রীতিমতো ছোট গলি। দিনের বেলা কর্মব্যস্ততা শুরু হয়ে গেলে চার-পাঁচজনের বেশি লোক পাশাপাশি চলতে পারবে না। মাথার ওপর, পাশে মাকড়শার জালের মতো সরু, মোটা তার। হাই টেনশন লাইনের পাশাপাশি কেবল টিভি, টেলিফোন থেকে শুরু করে কত যে লাইন গিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কোনও তার ৪৪০ ভোল্টের। কোনওটা ২২০ ভোল্টের। কোনও তার এমন বিপজ্জনকভাবে ঝুলে রয়েছে, দেখলেই ভয় লাগে। অবস্থা এমনই যে, বিদ্যুৎ বিভাগ বা পুরসভাও জানে না কোন তার কী কাজে লাগে। কোনটা আইনি, কোনটা বেআইনি তা উদ্ধার করা অসম্ভব। দুপাশের বাড়িগুলির মধ্যে তিলমাত্র ফাঁক নেই। একটার গায়ে আরেকটা বাড়ি। জায়গাটার নাম ফিল্মিস্তান আনাজ মন্ডি। এরই মধ্যে একটি ছশো গজের বাড়ি, যেখানে ব্যাগ তৈরির কারখানায় আগুন লেগে ৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এমন গলি, এমন জায়গা, এমন পরিবেশ যে দুর্ঘটনা না ঘটাই আশ্চর্যের।
নব ভারত টাইমসের মেট্রো এডিটর গুলশন ক্ষত্রি ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''এই ধরনের আগুন লাগলে কিছুদিন হইচই হয়। সরকার, পুরসভা একটু সক্রিয় হয়। তারপর যে কে সেই। দিল্লির মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী আবাসিক এলাকার মধ্যে কোনও কারখানা থাকতে পারে না। এই ধরনের কারখানা যেখানে আছে, তা নারেলার মতো শিল্পতালুকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা।'' আসলে খাতায় কলমে সবই থাকে, ভয়াবহ ঘটনা ঘটলে কিঞ্চিত নড়াচড়া হয়। তারপর সবকিছুই যে কে সেই চলতে থাকে।
আগুন নেভানোর চমকপ্রদ সব আবিষ্কার
প্রাকৃতিক অগ্নিকাণ্ড সভ্যতার শুরু থেকেই বিপদজনক ঘটনা হলেও শিল্পায়নের এই যুগে মানবসৃষ্ট কারণে এর সংখ্যা বেড়েছে৷ তাই নিত্য গবেষণাও চলে একে মোকাবেলার৷ ছবিঘরে জানুন আগুন নেভানোর কয়েকটি চমকপ্রদ আবিষ্কারের কথা৷
ছবি: Reuters/A. Konstantinidis
ফায়ারফাইটিং ড্রোন
ড্রোনের সুবিধা হলো এটি নীচে দাঁড়িয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়৷ কয়েকটি কোম্পানি এরই মধ্যে ফায়ারফাইটিং ড্রোন বাজারে ছেড়েছে৷ যেখানে এখন পর্যন্ত ক্রেন দিয়ে সর্বোচ্চ ১০০ মিটারের কিছু বেশি উচ্চতায় পৌঁছানো যায়, সেখানে অ্যারোনেস কোম্পানির ড্রোনগুলো ৩শ’ থেকে ৪শ’ মিটার উচ্চতায় যেতে পারে এবং এগুলো মিনিটে ১০০ লিটার গতিতে পানি ছিটাতে পারে৷ শুধু তাই নয় ১৪৫ কিলোগ্রাম পর্যন্ত ওজনের কোনো ব্যক্তিকেও এটি তুলে আনতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/R. Tivony
সাউন্ডওয়েভ ফায়ার এক্সটিনগুইশার
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ মেসন ইউনিভার্সিটির দুই প্রকৌশল ছাত্র ট্র্যান ও রবার্টসন ২০১৭ সালে এই যন্ত্রটি আবিষ্কার করেন৷ যদিও আগুন নেভানোর জন্য শব্দের ব্যবহারের আইডিয়া আগে আলোচিত বা পরীক্ষা করা হয়েছে, একে বাস্তব যন্ত্রে রূপান্তর করেছেন এই দু’জন৷ যন্ত্রটি দিয়ে ১০০ হার্টজ ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ তৈরি করে আগুনে অক্সিজেনের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়৷ আর ম্যাজিকের মতো মুহূর্তেই আগুন নিভে যায়৷
ছবি: Youtube
বম্বার্ডিয়ার সিএল ৪১৫
এয়ারক্রাফট ফায়ারফাইটার হলো বিরাট আগুন (যেমন, ওয়াইল্ড ফায়ার) নেভানোর কাজে ব্যবহারযোগ্য বিমান৷ এর মধ্যে বম্বার্ডিয়ার সিএল ৪১৫ ক্যানাডায় তৈরি একটি বোমারু বিমান, যেটি আগুনের মধ্যে বোমার মতো পানি ফেলে অল্প সময়েই নিভিয়ে ফেলে৷ মাত্র ১২ সেকেন্ডে এটি ৬ হাজার ১শ’ ৪০ লিটার পানি ছড়াতে পারে৷ এটি উভচর৷
ছবি: picture-alliance/CTK/J. Sulc
স্কাইক্রেন
স্কাইক্রেনও এয়ারক্রাফট ফায়ারফাইটার৷ এটি একটি মার্কিন হেলিকপ্টার৷ এটিও অনেক দ্রুতগতিতে আগুনে পানি ছিটাতে পারে৷ মাত্র ৪৫ সেকেন্ডে ১০ হাজার লিটার পানি ছিটাতে পারে এই স্কাইক্রেনটি৷ এটি একটি মিলিটারি মডেলের হেলিকপ্টার৷ বিখ্যাত অ্যানিমেশন মুভি ‘দি ইনক্রেডিবল হাল্ক’-এ এই মডেলটি ব্যবহার করা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
ফায়ারফাইটিং রোবট
ছোট ট্যাঙ্কের মতো এই ফায়ারফাইটিং রোবটগুলো অস্ট্রেলিয়ায় তৈরি৷ এগুলো আগুনের খুব কাছে পৌঁছে যেতে পারে৷ এগুলো ৮৫ মিটার বা একটি ফুটবল মাঠের দূরত্বে পানি ছেটাতে পারে৷ এগুলো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারে, বাধা অতিক্রম করতে পারে৷ ছোট হলেও সামনে ভারী বস্তু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে পারে৷ দুইজনকে বহন করতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/Zuma/Kalashnikov
ফায়ার এক্সটিনগুইশার বল
এটা বেশ মজার একটি যন্ত্র৷ বলটিতে থাকে আগুন নেভানোর রাসায়নিক পদার্থ ও দাহ্য পদার্থ৷ তাই আগুনের সংস্পর্শে আসলে মাত্র তিন সেকেন্ডের মধ্যে এটি বিস্ফোরিত হয় এবং সেই পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে৷ আগুন নিভে যায়৷ এগুলো বাসাবাড়ি ও অফিস আদালতে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে৷
ছবি: Youtube
স্কাই সেভার
ফারুক রূপায়ন টাওয়ার থেকে বাঁচতে অনেকেই অনেক ওপর থেকে লাফ দিয়েছিলেন৷ স্কাই সেভার থাকলে তাঁরা একে একে নিরাপদে নামতে পারতেন৷ এটি শুধু জ্যাকেটের মতো পরে কোনো একটি হুক বা কিছু সঙ্গে ওপরের নবটি আটকে লাফিয়ে পড়তে হয়৷ স্কাই সেভার বডির ওজন অনুযায়ী ব্যক্তিকে অল্পসময়ে আস্তে আস্তে নীচে নামিয়ে নিয়ে আসে৷
ছবি: Youtube
এলইউএফ ৬০
এলইউএফ ৬০ একটি চলনশীল ওয়্যারলেস রিমোট কন্ট্রোল যন্ত্র৷ এটি ১ হাজার ফুট পর্যন্ত সামনের আগুন নিভিয়ে পথ পরিষ্কার করে দেয়৷ এছাড়া মিনিটে ১ হাজার ৮শ’ লিটার পানি ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ছুড়তে পারে৷ বিদ্যুৎ চলে গেলে এতে ম্যানুয়েল কন্ট্রোলও আছে৷ বিশেষ করে ওয়্যারহাউস বা আন্ডারগ্রাউন্ডে আগুন নেভানোর মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ সহজেই এর মাধ্যমে করা যায়৷
ছবি: Imago Images/imagebroker/strussfoto
হাই ফগ
কোনো অফিস ঘর বা হোটেল রুমে যেসব সাধারণ স্প্রিঙ্কলারগুলো রয়েছে, তাতে আগুন নেভাতে নেভাতে অনেক ক্ষতি হয়ে যায়৷ হাই ফগ এর চেয়ে দশগুণ বেশি গতিতে কাজ করে৷ এর বিশেষত্ব হলো এটি প্রচণ্ড বেগে কুয়াশার মতো পানি ছোড়ে, যা শুধু আগুনই নেভায় না, পরিবেশের তাপমাত্রা কমায় ও আগুনে অক্সিজেনের সরবরাহে বাধা দেয়৷ তাতে আগুন খুব দ্রুত নিভে যায়৷
ছবি: Youtube
অটো ফায়ারম্যান
গাড়িতে আগুন লাগার ঘটনা সচরাচর না ঘটলেও এটি খুব বিপদজনক৷ এই বিপদ এড়াবার জন্য রয়েছে অটো ফায়ারম্যান৷ গাড়ির ইঞ্জিনে একজোড়া অটো ফায়ারম্যান লাগিয়ে রাখলে তা তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বা আগুন লেগে গেলে গ্যাসের মতো করে কেমিক্যাল রেজিন ছড়াতে থাকে৷ তাতে আগুন নিভে যায়৷
ছবি: Youtube
স্মার্ট ডিটেকটরস
কোথাও আগুনের সূত্রপাত ঘটলে তা ছড়িয়ে পড়ার আগে জানা গেলে তা নেভানো সহজ৷ স্মার্ট ডিটেকটর বিভিন্ন ধরনের ধোঁয়াকে আলাদা করতে পারে৷ যেমন, কোনটা চুলার রান্নার ধোঁয়া, কোনটা সত্যি আগুনের ধোঁয়া ইত্যাদি৷ এটি আপনার ফোনে নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের ধোঁয়ার রিডিং দিতে থাকে৷ যদি কোনো আগুন বা ধোঁয়া বিপদজনক মাত্রায় পৌঁছাতে শুরু করে তখনই এটি আপনাকে এবং ফায়ার সার্ভিস বিভাগকে জানিয়ে দেবে৷
ছবি: Youtube
11 ছবি1 | 11
যে গলিতে ভয়বাহ আগুন লেগেছে, সেটা নামেই আবাসিক এলাকা। আদতে একের পর এক বাড়ি জুড়ে শুধু কারখানা। পুড়ে যাওয়া কারখানাটি ছিল সবমিলিয়ে পাঁচ তলা। একটু দূরেই আটতলা বাড়িও রয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে ডয়চে ভেলেকে রফিক জানালেন, ''সব মিলিয়ে এই গলিতেই দেড়শোর মতো কারখানা আছে। নানা ধরনের জিনিস সেখানে তৈরি হয়। কেউই ফায়ার লাইসেন্স নেয়নি।'' রফিক নিজেও এরকমই একটি কারখানায় কাজ করেন। দুটো শিফটে কাজ করলে আড়াইশো টাকা পাওয়া যায়। একে তো আবাসিক এলাকায় কারখানা, তার ওপর ফায়ার লাইসেন্স নেওয়া হয়নি। ফলে সম্পূর্ণ বেআইনি। তার ওপর আরেকটি বেআইনি বিষয়ও আছে। সেটা হল, জমা দেওয়া পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে বাড়িতে যথেচ্ছ নির্মাণ, এমনকী এক বা একাধিক তলা যোগ করে নেওয়ার গল্প।
সে কারণেই দিল্লির অত্যন্ত ব্যস্ত ও ঘিঞ্জি বাজারগুলো পুরোপুরি জতুগৃহ। রবিবার ভোর রাতে যে বাড়িতে আগুন লাগে, শনিবার তার কাছেই একটি বাড়িতে আগুন লেগেছিল। দমকল গিয়ে তা দ্রুত নিভিয়ে দেয়। দিল্লির সদরবাজারে এর আগেও আগুন লেগেছে।
কলকাতার অবস্থাও আলাদা কিছু নয়। সেখানে গত কয়েক বছরে একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। বড় বাজারে নন্দরাম মার্কেট, পার্ক স্ট্রিটের স্টিফেন হাউসের পর কয়েক মাস আগে বাগড়ি মার্কেটে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যায় প্রচুর ওষুধ। সেখানেও পুরসভা ও সরকারের তদন্তের পর দেখা গিয়েছে, কারণ একই। ফায়ার লাইসেন্স না নেওয়া, অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা না থাকা ও যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা ইলেকট্রিক তার। বিভিন্ন সময় টাস্ক ফোর্স তৈরি হয়েছে। কিন্তু কোনও কাজ হয়নি। ফলে দিল্লি থেকে কলকাতা, সর্বত্র অসুখ একই। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, সচেতন না হলে এ অসুখ সারবে না।