জার্মানির দু’হাজারের বেশি মসজিদ সব ধর্মের মানুষকে শুক্রবারের নামাজে যোগ দিয়ে ইসলামিক স্টেট সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপনের ডাক দিয়েছে৷ জার্মানির চারটি মুখ্য মুসলিম গোষ্ঠী মঙ্গলবার এই কর্মসূচি ঘোষণা করে৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানিতে বসবাসকারী মুসলমানদের এই প্রতিক্রিয়া দেরীতে এলো, না সঠিক সময়ে এলো, তা বলা শক্ত৷ কিছুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল যে, জার্মানি থেকে বেশ কিছু তথাকথিত ‘জিহাদি' সিরিয়া এবং ইরাক যাত্রা করেছে এবং সেখানে ইসলামিক স্টেট (আইএস বা আইসিস) ও অপরাপর জিহাদিদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে৷ একাধিক জার্মান জিহাদিকে নাকি আত্মঘাতী বোমারু হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে৷
এই সব জার্মান জিহাদিদের একাংশ যে জার্মানিতে ফিরে এসেছে এবং ভবিষ্যতে আরো অনেকে আসবে, জার্মান সরকার সে বিষয়ে চিন্তিত – কেননা জিহাদিরা ফিরছে যুদ্ধের ও বোমাবাজির অভিজ্ঞতা নিয়ে৷ কাজেই তারা জার্মানিতেও সন্ত্রাসী আক্রমণ ঘটানোর চেষ্টা করতে পারে৷ বলতে কি, জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টোমাস দেমেজিয়ের গত সপ্তাহেই ঘোষণা করেন যে, ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠী, তাদের যাবতীয় নিশান ও প্রতীক, গোষ্ঠীর হয়ে অর্থ কিংবা সদস্য সংগ্রহের প্রচেষ্টা, সব কিছু নিষিদ্ধ করা হচ্ছে জার্মানিতে৷ মাত্র গত সোমবার ফ্রাংকফুর্টের একটি আদালতে এক প্রত্যাবর্তিত জার্মান জিহাদির বিচার শুরু হয়৷
ইরাকে জিহাদিবিরোধী যুদ্ধ
চরমপন্থি ইসলামি সংগঠন আইএস-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে ইরাকে৷ সন্ত্রাসবাদী এ সংগঠনটির সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশেও তৎপরতা রয়েছে৷ দেখুন ইরাকে আইএস-বিরোধী যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট কিছু ছবি৷
ছবি: Reuters
টিকরিট পুনরুদ্ধারের চেষ্টা
সুন্নিদের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া (আইসিস) উত্তর ও দক্ষিণ ইরাকের কিছু অংশ দখল করে নিয়েছে৷ বাগদাদ থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরের শহর টিকরিটও এখন তাদের দখলে৷ সে এলাকায় ইরাক সরকারের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের জন্য আইসিস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়ছে সেনাবাহিনী৷
ছবি: Reuters
মধ্যপ্রাচ্যে কর্তৃত্ব চায় আইসিস
আন্তর্জাতিক ইসলামি জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার সঙ্গে আইসিস-এর একসময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ ২০০৬ থেকে ২০০৭-এর দিকে ইরাকে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াই চলছে তখনই আইসিস-এর জন্ম৷ সংগঠনটির লক্ষ্য সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, ফিলিস্তিন এবং জর্ডান মিলিয়ে বেশ বড় একটা অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা৷ ইরাকে নুসরা ফ্রন্টসহ বেশ কিছু সংগঠন তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
বিদ্রোহীদের পাশে যুক্তরাষ্ট্র
সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ আর ইরাকে নুরি আল মালিকির সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বিদ্রোহীদের মধ্যে মধ্যপন্থি এবং মৌলবাদী সংগঠনের কর্মী রয়েছে৷ সিরিয়ায় ন্যাশনাল কোয়ালিশনের মতো কিছু মধ্যপন্থি সংগঠনকে সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র৷ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামা বিদ্রোহীদের একাংশকে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখছেন৷
ছবি: Reuters
ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি জানিয়েছেন, কংগ্রেস বিদ্রোহীদের জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব অনুমোদন করলে তা সিরিয়া এবং ইরাকে দেয়া হবে৷ এই বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ, কেননা, ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বড় একটা অংশ যে আইসিস-এর কাছে যাবেনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই৷
ছবি: Reuters
কুর্দিরা চায় স্বাধীন কুর্দিস্তান
যুক্তরাষ্ট্র চায় ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকি সুন্নি এবং কুর্দিদের অংশিদারিত্বের সরকার গঠন করুন৷ ইরাকের কিছু অংশে কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসন রয়েছে৷ কুর্দিরা ‘পেশমেরগা’, অর্থাৎ কুর্দিদের স্বাধিকার আন্দোলনের অংশ হিসেবে আইসিসের বিরুদ্ধে লড়ছে৷ কুর্দিদের মূল লক্ষ্য ইরাকে স্বাধীন কুর্দিস্তান প্রতিষ্ঠা করা৷
ছবি: Reuters
ইরানের ভূমিকা
ইরাকে শিয়া-সুন্নি সংঘাতের মধ্যে জড়াতে চায়না ইরান৷ কিন্তু শিয়া প্রধান দেশ ইরানের সরকার ইরাকের মালিকি সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে বলে ধারণা করা হয়৷ নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইসিস-বিরোধী যুদ্ধে মালিকি সরকারকে ড্রোন এবং অন্যান্য সমর উপকরণ দিয়ে সহায়তা করছে ইরান সরকার৷
ছবি: Atta Kanare/AFP/Getty Images
এক হাজারেরও বেশি নিহত
সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের সমর্থন দিচ্ছে সৌদি আরব৷ ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকি মনে করেন, আইসিসকেও মদদ দিচ্ছে সৌদি সরকার৷ ইরাকে চলমান সংঘাতে কমপক্ষে এক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে৷ মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ জন্য ইরাক সরকার এবং আইসিস-এর কঠোর সমালোচনা করেছে৷
ছবি: Reuters
বাড়ছে শরণার্থী
আইসিসের হামলা শুরুর পর থেকে ইরাকের বিভিন্ন স্থান থেকে অন্তত ১২ লাখ মানুষ ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন৷ সিরিয়া সংকট শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত আড়াই লাখ সিরীয় স্বায়ত্তশাসিত কুর্দি রাজ্যগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে৷ এখন আইসিসের দখল করে নেয়া শহরগুলো থেকে পালিয়ে ইরাকিরাও আসছে৷ ছবিতে খাজাইর চেকপয়েন্ট অতিক্রম করে কুর্দিদের নিয়ন্ত্রিত শহর এরবিলের দিকে যেতে দেখা যাচ্ছে মসুল থেকে আসা ইরাকিদের৷
ছবি: Getty Images
স্বেচ্ছাসেবীরাও নেমেছে যুদ্ধে
প্রধানমন্ত্রী মালিকি জানিয়েছেন, রাশিয়া আর বেলারুশের কাছ থেকে পুরোনো যুদ্ধ বিমান কিনেছে ইরাক৷ আইসিসের বিরুদ্ধে সেগুলো ব্যবহার করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি৷ বাড়ছে সমরাস্ত্র৷ বাড়ছে যোদ্ধা৷ স্বেচ্ছাসেবীরাও যোগ দিচ্ছেন আইসিস বিরোধী যুদ্ধে৷
ছবি: Reuters
9 ছবি1 | 9
অপরদিকে সুদূর সিরিয়া কিংবা ইরাকে ইসলামিক স্টেটের কার্যকলাপ ছাড়াও – যার মধ্যে পশ্চিমি পণবন্দীদের শিরশ্ছেদও পড়ে – সেই সব কার্যকলাপের সঙ্গে জার্মান জিহাদিদের সংযোগ জার্মানিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে এবং সে বিরূপতা যে সাধারণভাবে মুসলিম বিদ্বেষের চেহারা নিতে পারে, তার প্রমাণ, সম্প্রতি বার্লিনের ক্রয়েৎসব্যার্গে একটি নির্মীয়মান মসজিদের উপর আক্রমণ ও অগ্নিসংযোগ৷
এই সব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জার্মান মুসলিমদের কেন্দ্রীয় পরিষদের প্রধান আইমান মাজিয়েক মঙ্গলবার যা ঘোষণা করেছেন, তা দ্ব্যর্থহীন৷ মাজিয়েক ঐ সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন: ‘‘আমরা স্পষ্ট করে দিতে চাই যে, সন্ত্রাসী এবং অপরাধীরা ইসলামের নামে কথা বলতে পারে না৷ তারা আমাদের ধর্মের আদেশ ও বিধান পদদলিত করেছে৷ হত্যাকারী ও অপরাধীদের আমাদের মধ্যে, আমাদের ধর্মে কোনো স্থান নেই৷''
শুক্রবার জার্মনির বিভিন্ন শহরে ‘‘শান্তি সভার'' আয়োজন করা হবে – জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেমেজিয়ের ও বার্লিনের লর্ড মেয়র ক্লাউস ভোভেরাইট-ও সে ধরনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন বলে প্রকাশ৷ প্রসঙ্গত, বার্লিনের লর্ড মেয়র যে ক্রয়েৎসব্যার্গের মসজিদে অগ্নিকাণ্ড ঘটার দু'সপ্তাহ পরে অকুস্থল পরিদর্শন করার অবকাশ পান, জার্মান মুসলিম নেতারা সে'ব্যাপারে খুব সুখি নন৷
শুক্রবারের প্রার্থনা দিবসের উদ্যোক্তাদের একজন, আলা কিজিলকায়া, স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, তরুণ মুসলিমদের উগ্রপন্থি হওয়া রোখার জন্য মুসলিম সম্প্রদায়ের বৃহত্তর জার্মান সমাজের সমর্থন ও সাহায্যের প্রয়োজন পড়বে৷ ‘‘ওরা আমাদেরই তরুণ৷ ওদের একজনের যাওয়া মানে শুধু মুসলিমদেরই ক্ষতি নয়, গোটা সমাজের ক্ষতি,'' বলেছেন কিজিলকায়া৷