মধ্য এশিয়ার কয়েকটি দেশ থেকে চার হাজারের মতো মানুষ আইএস-এ যোগ দিয়েছে৷ সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানায়৷ এ সম্পর্কে বিস্তারিত বললেন সংস্থাটির কর্মকর্তা ডিয়ারড্রি টাইনেন৷
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি ‘মধ্য এশিয়ায় মৌলবাদ কায়েমের ডাক দিচ্ছে সিরিয়া' – শিরোনামের এক প্রতিবেদনে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) জানিয়েছে, সাম্প্রতিককালে মধ্য এশিয়ার কাজাখস্তান, কিরঘিজস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান এবং উজবেকিস্তান থেকে অনেক মানুষ ইসলামি জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটস (আইএস)-এ যোগ দিচ্ছে৷ সরকারগুলোর মৌলবাদ প্রতিরোধে প্রচেষ্টার অভাব, অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং ধর্ম সম্পর্কে সাধারণের জ্ঞানের অভাবের কারণেই আইএস ওই অঞ্চলে সফল হচ্ছে বলে মনে করে আইসিজি-র মধ্য এশিয়ার প্রকল্প পরিচালক ডিয়ারড্রি টাইনেন৷
ডিডাব্লিউ: ইসলামিক স্টেটের এই সমর্থকরা কোথা থেকে আসছে?
ডিয়ারড্রি টাইনেন: এ এলাকায় উগ্রপন্থিরা মূলত মসজিদ এবং প্রার্থনার স্থানগুলোতে গিয়েই লোকজনকে দলে টানছে৷ ফলে সমাজের সব শ্রেণির লোকই থাকছে সেখানে৷ মেয়েরাও যাচ্ছে৷
এ অঞ্চলের আইএস সমর্থকদের বৈশিষ্ট্যগুলো একটু বুঝিযে বলবেন?
আইএস সমর্থকদের নির্দিষ্ট কোনো বৈশিষ্ট্যের কথা বলা কঠিন৷ সমাজের সব স্তরের লোকজনই যে আইএস-এর দিকে ঝুঁকছে, সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা বুঝতে পারে না৷ ১৭ বছর বয়সি হেয়ার ড্রেসার, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, স্বামী পরিত্যক্তা নারী, খেলাফত কায়েম হলে তাঁদের সন্তানরা ভালো থাকবে এ কথা বিশ্বাস করা পরিবার, বেকার তরুণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, স্কুল থেকে ঝরে পড়া কিশোর – বলতে গেলে সব কাতার থেকেই মানুষ আজকাল আইএস-এ যাচ্ছে৷ তারা মনে করে, সোভিয়েত পরবর্তী সময়ের চেয়ে আইএস-এর অঙ্গিকার করা খেলাফত ভালো হবে৷ আসলে আইএস-এর জন্য আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের চেয়ে মধ্য এশিয়া থেকে লোক সংগ্রহ করা অনেক সহজ৷
কিন্তু দেশ ছেড়ে তাঁদের আইএস-এ যোগ দিতে যাওয়ার কারণ কী?
প্রধানত প্রান্তিকীকরণ এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণেই এমনটি হচ্ছে৷ আইএস শুধু সম্মুখ সমরে অংশ নিতে সক্ষম লোকদেরই দলে টানছে না, সবাইকেই নিচ্ছে৷ মেয়েরাও যাচ্ছে৷ সবসময় যে ভবিষ্যতে আর্থিকভাবে লাভবান হবে এ আশায় সবাই যাচ্ছে তা-ও নয়৷ অনেকে রোমাঞ্চকর কিছু করা কিংবা অস্ত্র হাতে নেয়ার অভিজ্ঞতা অর্জনের তাড়না থেকেও সেখানে যাচ্ছে৷ তবে মধ্য এশিয়াতে মৌলবাদের দিকে ঝোঁক বাড়ছে৷ ধর্ম সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞানের অভাব এবং ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের প্রতি বিদ্বেষ থাকায় তা আরো দ্রুত হচ্ছে৷
সমর্থকদের কীভাবে সংগ্রহ করে আইএস?
মসজিদ এবং প্রায় সব নামাজখানায় যায় ওরা৷ সমর্থক সংগ্রহে ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমকেও ব্যবহার করছে জঙ্গি গোষ্ঠীটি৷ বাড়িতে বাড়িতে গিয়েও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার আহ্বান জানানো হয়৷ স্থানীয়দের বাড়ি, অভিবাসীদের বাড়িতেও যায় ওরা৷ শুধু মধ্য এশিয়া, রাশিয়া এবং তুরস্কতেই নয়, মিশর, সৌদি আরব বা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও এমন তৎপরতা বাড়ছে৷
এই তৎপরতা মধ্য এশিয়া এবং আশেপাশের দেশগুলোর সরকারগুলোর জন্য কতটা হুমকিস্বরূপ?
মধ্য এশিয়ায় আইএস-এর হয়ে যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য অনেকেই প্রশিক্ষণ নিচ্ছে৷ সংখ্যাটা দিন দিন বাড়ছে৷ ফলে এসব দেশে নিরাপত্তা ঝুঁকিও বাড়ছে৷ বড় কিছু ঘটার আশঙ্কা দেখা দিলে তা প্রতিহত করা মুশকিল, কেননা সরকারগুলোর এ বিষয়ে প্রস্তুতি খুব দুর্বল৷
এ বিষয়ে মধ্য এশিয়ার সরকারগুলো কী করছে?
তাজিকস্তান এবং কাজাখস্তান বিদেশে সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপে অংশ নেয়া রুখতেও আইন করেছে৷ তাজিকস্তানে তা ২০১৪ সালের জুলাই থেকে আর কাজাখস্তানে গত জানুয়ারি থেকে কার্যকর করা হয়েছে৷ উজবেকিস্তানে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ কিরঘিস্তানের সংসদ বিদেশে যুদ্ধে অংশ নেয়া জঙ্গিকে ৮ থেকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়ার সুপারিশ অনুমোদন করেছে৷
গত জুন মাসে ইরাকের মোসুল দখল করে নেয় ইসলামিক স্টেট (আইএস বা আইসিস)৷ চরমপন্থি ইসলামি সংগঠনটির লক্ষ্য, মধ্যপ্রাচ্যের একটা অংশে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা৷ এদিকে আইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আঁচ লেগেছে জার্মানিতেও৷ দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: Aris Messinis/AFP/Getty Images
জার্মানিতে সংঘর্ষ
সুদূর ইরাক ও সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের তৎপরতার আঁচ জার্মানিতেও দেখা যাচ্ছে৷ উত্তরের হামবুর্গ ও সেলে শহরে মঙ্গলবার (০৭.১০.১৪) কুর্দি ও ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে উগ্রপন্থি মুসলমানদের সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Markus Scholz
গনসচেতনতার উদ্যোগে বাধা
জার্মানিতে বসবাসরত কুর্দি ও ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মানুষ সিরিয়া ও ইরাকে আইএস জঙ্গিদের তৎপরতা সম্পর্কে গণসচেতনতা বাড়াতে গত কয়েক মাস ধরে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও সমাবেশের আয়োজন করেছে৷ কখন উগ্রপন্থিরা তাদের বাধা দিচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/Alexander Koerner
কোবানিতে তীব্র লড়াই
এদিকে সিরিয়ার কোবানি বা আইন আল-আরব শহরে আইএস জঙ্গিদের ব্যাপক হামলা চলছে৷ প্রাণ বাঁচাতে এক লাখেরও বেশি সিরীয় কুর্দি এলাকা ছেড়েছে৷ অধিকাংশই আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী দেশ তুরস্কে৷ আইএস জঙ্গিদের প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কুর্দিদের আধা সামরিক বাহিনী ওয়াইপিজি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/EPA/SEDAT SUNA
আপাতত রক্ষা
কুর্দি এই নারী তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে আইন আল-আরব থেকে পালিয়ে এসেছেন৷ সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় শহরটিতে আইএস-এর হামলা তীব্র হওয়ার পরপরই তাঁরা তুরস্কে আশ্রয় নেন৷
ছবি: DW/Alice Martins
আতঙ্ক
তখনও আইন আল আরব সীমান্তে চলছে তীব্র লড়াই৷ এই কুর্দি পরিবার আইন আল-আরব থেকে এসে তুরস্কের সীমান্তে অপেক্ষা করছে৷ ইরাকে কুর্দি নারীদের আইএস যেভাবে তুলে নিয়ে বিক্রি করেছে, তাড়াতাড়ি পালাতে না পারলে তাঁদেরও একই পরিণতি হতে পারে এই আতঙ্ক গ্রাস করেছে তাঁদের৷
ছবি: DW/Alice Martins
অসহায়ত্ব
তুরস্কেও ভালো নেই আইন আল-আরব ছেড়ে আসা কুর্দিরা৷ খাবারদাবার, এমনকি খাওয়ার পানিও ঠিকমতো জোটে না৷ একটি সংগঠন তাই চাঁদা তুলে পানির বোতল কিনে এনে বিতরণ করছে শরণার্থীদের মাঝে৷
ছবি: DW/Alice Martins
দীর্ঘ অপেক্ষা
প্লাস্টিকের ব্যাগে কিছু খাবার নিয়ে এসেছেন একজন৷ আইন আল-আরব ছেড়ে আসা সিরীয়দের সে খাবারগুলো দিতে চান৷ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে্ তুরস্কের সেনাবাহিনী৷ তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা চলছে৷ ওদিকে খাবারের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে শরণার্থীরা৷
ছবি: DW/Alice Martins
যাত্রী চাই
সিরীয় শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য সীমান্ত খুলে দিয়েছে তুর্কি সরকার৷ এক মিনিবাস চালক তাই যাত্রীর অপেক্ষায়৷ শরণার্থীদের কেউ যদি তাঁর মিনিবাসে ওঠেন, তাতে নিজের তো সামান্য কিছু আয় হবেই, শরণার্থীদেরও উপকার হবে৷ জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত প্রায় ১৩ লাখ সিরীয় তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছে৷
ছবি: DW/Alice Martins
মধ্যপ্রাচ্যে কর্তৃত্ব চায় আইএস
আন্তর্জাতিক ইসলামি জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার সঙ্গে আইএস বা আইসিস-এর একসময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ ২০০৬ থেকে ২০০৭-এর দিকে ইরাকে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াই চলছে তখনই আইএস-এর জন্ম৷ সংগঠনটির লক্ষ্য সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, ফিলিস্তিন এবং জর্ডান মিলিয়ে বেশ বড় একটা অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
আইএস-এর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র
সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ আর ইরাকে নুরি আল-মালিকির সাবেক সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট বিদ্রোহীদেরই পাশে ছিল৷ সিরিয়ায় ন্যাশনাল কোয়ালিশনের মতো কিছু মধ্যপন্থি সংগঠনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন রয়েছে৷ তবে ওবামা সরকার এখন আইএস-এর বিরুদ্ধে৷ জঙ্গি সংগঠনটিকে নিশ্চিহ্ন করার অঙ্গীকার নিয়ে ইরাক ও সিরিয়ায় চলছে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলা৷
ছবি: picture alliance/dpa/Matthew Bruch
এবার আইন আল-আরব?
সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত আইন আল-আরব সাধারণের কাছে ‘কোবানি’ নামেই পরিচিত৷ তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তের এ শহরের একটা অংশ এখন আইএস-এর দখলে৷ এবার কি তবে আইন আল-আরবও দখল করে নেবে আইএস? তারপর?