জার্মানি উত্তর ইরাকে সৈন্য পাঠানোর কথা ভাবছে, কিন্তু প্রশিক্ষক হিসেবে৷ তারা কুর্দদের আইএস বা আইসিস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করবেন৷ যা প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই নয়, বলে মনে করেন ডয়চে ভেলের নাওমি কনরাড৷
বিজ্ঞাপন
দৃশ্যটি দেখার মতো: জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী, দু'জনে দাঁড়িয়ে আছেন মুখ গম্ভীর করে, চারপাশে সাংবাদিকদের ডজন-ডজন ক্যামেরা৷ দুই রাজনীতিকের আবেগপূর্ণ বিবৃতির মর্ম হলো: জঙ্গি সংগঠন আইএস-এর অকল্পনীয় বর্বরতার অবসান ঘটানো চাই; অবহেলা কোরো না, যারা বর্বরতা, বীভৎসতা আর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে, তাদের সাহায্য করো৷ ইরাকে পেশমার্গা আইসিস বীভৎসতার বিরুদ্ধে লড়ছে এবং জার্মানি তাদের একা ফেলে রাখছে না – বললেন মন্ত্রীদ্বয়, আলোকচিত্রীরা তখন ভিডিও ক্যামেরার দঙ্গলকে পাশে হটিয়ে মন্ত্রীদের মুখের ভাবটি ছবিতে ধরে রাখার চেষ্টা করছে৷
তবে কি জার্মানি তার সর্বাধুনিক জঙ্গিজেটগুলো নিয়ে আইএস-এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিমান হানায় সামিল হবে? না, জার্মানি শুধু উত্তর ইরাকে প্রশিক্ষক পাঠাবে৷ জার্মান সরকার গত বুধবার সকালে ঠিক এই সিদ্ধান্তই নিয়েছেন৷ জার্মান সেনাবাহিনীর একশো জন অবধি প্রশিক্ষক উত্তর ইরাকের এরবিল-এ কুর্দ সেনাবাহিনীকে ট্রেনিং দেবেন৷ তাঁদের সনদ হবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার, যুদ্ধ করার নয়, বলেছেন স্টাইনমায়ার৷ এছাড়া নিরাপত্তা সংক্রান্ত পরিস্থিতি বদলালে যে কোনো সময় এই সিদ্ধান্ত বদলে যেতে পারে – সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে৷ অর্থাৎ জার্মানি যে আইএস-এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জোটের বিমান হানায় অংশ নেবে না, সে'টুকু স্পষ্ট৷
জার্মানি তার ‘যথাসাধ্য' করছে
জার্মান সংসদ প্রশিক্ষক অভিযানের অনুমোদন দেবে আগামী বছরে৷ তবে দুই মন্ত্রী ইতিমধ্যেই বার্লিনের প্রেস ভবনের সুবিশাল ক্রিসমাস ট্রি-র পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের শান্তির বাণী শুনিয়েছেন: সিরিয়া এবং ইরাকে শান্তি আনয়নের জন্য জার্মানি যথাসাধ্য করছে৷ অবশ্য নিজে যুদ্ধ না করে৷ প্রথমে জার্মান অস্ত্রশস্ত্র এবং ত্রাণসাহায্য পাঠানো হয়েছে৷ এবার যাচ্ছেন প্রশিক্ষকরা৷
এটা কি প্রায় ব্যঙ্গ করার মতো নয়? ইরাক আর সিরিয়ায় জিহাদিরা যথেচ্ছ অভিয়ান চালাচ্ছে: অন্য ধর্মের মানুষ এবং বিদেশি সাংবাদিকদের হত্যা করছে; ইয়াজিদি নারীদের ধর্ষণ করছে এবং ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করছে; স্কুলে কি হাসপাতালে তাদের মতাদর্শ প্রচার করছে; অবিশ্বাস্য পাশবিকতার সঙ্গে তাদের বার্তা প্রচার করছে – সবই ইসলামের নামে, যদিও তারা সেই ধর্মমতের ভুল ব্যাখ্যা করে তাকে বিকৃত করছে৷এক কথায়: সিরিয়া এবং ইরাকে একটি অমানুষিক, রক্তাক্ত শাসনব্যবস্থা জন্ম নিচ্ছে, যা শুধু নাইজেরিয়া, পাকিস্তান কিংবা মিশরেই নয়, ইউরোপ তথা অস্ট্রেলিয়াতেও হাজার হাজার সমর্থক পাচ্ছে৷ এবং তা থামানোর জন্য জার্মান সরকার একশো প্রশিক্ষক পাঠাচ্ছেন৷ জার্মান প্রেসিডেন্ট ইওয়াখিম গাউক কয়েক মাস আগে যে নতুন দায়িত্বের কথা বলেছিলেন, সেই দায়িত্ব কি এতেই পালন করা হয়ে যাচ্ছে?
আইএস বিরোধী লড়াইয়ের আঁচ জার্মানিতে
গত জুন মাসে ইরাকের মোসুল দখল করে নেয় ইসলামিক স্টেট (আইএস বা আইসিস)৷ চরমপন্থি ইসলামি সংগঠনটির লক্ষ্য, মধ্যপ্রাচ্যের একটা অংশে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা৷ এদিকে আইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আঁচ লেগেছে জার্মানিতেও৷ দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: Aris Messinis/AFP/Getty Images
জার্মানিতে সংঘর্ষ
সুদূর ইরাক ও সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের তৎপরতার আঁচ জার্মানিতেও দেখা যাচ্ছে৷ উত্তরের হামবুর্গ ও সেলে শহরে মঙ্গলবার (০৭.১০.১৪) কুর্দি ও ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে উগ্রপন্থি মুসলমানদের সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Markus Scholz
গনসচেতনতার উদ্যোগে বাধা
জার্মানিতে বসবাসরত কুর্দি ও ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মানুষ সিরিয়া ও ইরাকে আইএস জঙ্গিদের তৎপরতা সম্পর্কে গণসচেতনতা বাড়াতে গত কয়েক মাস ধরে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও সমাবেশের আয়োজন করেছে৷ কখন উগ্রপন্থিরা তাদের বাধা দিচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/Alexander Koerner
কোবানিতে তীব্র লড়াই
এদিকে সিরিয়ার কোবানি বা আইন আল-আরব শহরে আইএস জঙ্গিদের ব্যাপক হামলা চলছে৷ প্রাণ বাঁচাতে এক লাখেরও বেশি সিরীয় কুর্দি এলাকা ছেড়েছে৷ অধিকাংশই আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী দেশ তুরস্কে৷ আইএস জঙ্গিদের প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কুর্দিদের আধা সামরিক বাহিনী ওয়াইপিজি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/EPA/SEDAT SUNA
আপাতত রক্ষা
কুর্দি এই নারী তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে আইন আল-আরব থেকে পালিয়ে এসেছেন৷ সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় শহরটিতে আইএস-এর হামলা তীব্র হওয়ার পরপরই তাঁরা তুরস্কে আশ্রয় নেন৷
ছবি: DW/Alice Martins
আতঙ্ক
তখনও আইন আল আরব সীমান্তে চলছে তীব্র লড়াই৷ এই কুর্দি পরিবার আইন আল-আরব থেকে এসে তুরস্কের সীমান্তে অপেক্ষা করছে৷ ইরাকে কুর্দি নারীদের আইএস যেভাবে তুলে নিয়ে বিক্রি করেছে, তাড়াতাড়ি পালাতে না পারলে তাঁদেরও একই পরিণতি হতে পারে এই আতঙ্ক গ্রাস করেছে তাঁদের৷
ছবি: DW/Alice Martins
অসহায়ত্ব
তুরস্কেও ভালো নেই আইন আল-আরব ছেড়ে আসা কুর্দিরা৷ খাবারদাবার, এমনকি খাওয়ার পানিও ঠিকমতো জোটে না৷ একটি সংগঠন তাই চাঁদা তুলে পানির বোতল কিনে এনে বিতরণ করছে শরণার্থীদের মাঝে৷
ছবি: DW/Alice Martins
দীর্ঘ অপেক্ষা
প্লাস্টিকের ব্যাগে কিছু খাবার নিয়ে এসেছেন একজন৷ আইন আল-আরব ছেড়ে আসা সিরীয়দের সে খাবারগুলো দিতে চান৷ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে্ তুরস্কের সেনাবাহিনী৷ তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা চলছে৷ ওদিকে খাবারের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে শরণার্থীরা৷
ছবি: DW/Alice Martins
যাত্রী চাই
সিরীয় শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য সীমান্ত খুলে দিয়েছে তুর্কি সরকার৷ এক মিনিবাস চালক তাই যাত্রীর অপেক্ষায়৷ শরণার্থীদের কেউ যদি তাঁর মিনিবাসে ওঠেন, তাতে নিজের তো সামান্য কিছু আয় হবেই, শরণার্থীদেরও উপকার হবে৷ জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত প্রায় ১৩ লাখ সিরীয় তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছে৷
ছবি: DW/Alice Martins
মধ্যপ্রাচ্যে কর্তৃত্ব চায় আইএস
আন্তর্জাতিক ইসলামি জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার সঙ্গে আইএস বা আইসিস-এর একসময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ ২০০৬ থেকে ২০০৭-এর দিকে ইরাকে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াই চলছে তখনই আইএস-এর জন্ম৷ সংগঠনটির লক্ষ্য সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, ফিলিস্তিন এবং জর্ডান মিলিয়ে বেশ বড় একটা অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
আইএস-এর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র
সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ আর ইরাকে নুরি আল-মালিকির সাবেক সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট বিদ্রোহীদেরই পাশে ছিল৷ সিরিয়ায় ন্যাশনাল কোয়ালিশনের মতো কিছু মধ্যপন্থি সংগঠনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন রয়েছে৷ তবে ওবামা সরকার এখন আইএস-এর বিরুদ্ধে৷ জঙ্গি সংগঠনটিকে নিশ্চিহ্ন করার অঙ্গীকার নিয়ে ইরাক ও সিরিয়ায় চলছে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলা৷
ছবি: picture alliance/dpa/Matthew Bruch
এবার আইন আল-আরব?
সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত আইন আল-আরব সাধারণের কাছে ‘কোবানি’ নামেই পরিচিত৷ তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তের এ শহরের একটা অংশ এখন আইএস-এর দখলে৷ এবার কি তবে আইন আল-আরবও দখল করে নেবে আইএস? তারপর?
ছবি: Aris Messinis/AFP/Getty Images
11 ছবি1 | 11
অসহায়তার বহির্প্রকাশ
আইএস বা আইসিস সম্পর্কে কী করা উচিত, এ প্রশ্নের কোনো সহজ জবাব নেই – যেমন সিরিয়া কিংবা ইরাকের জন্যে কোনো সহজ সামরিক কিংবা রাজনৈতিক সমাধান নেই৷ অন্তত আজ আর নেই, আগে যদি কখনও তা থেকে থাকে৷ আসাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে বিরোধীদের সাহায্য করার প্রশ্নে বহির্বিশ্ব বড় বেশি দোনামোনা করেছে৷ তার ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, সন্ত্রাসবাদ এবং ইসলামি জঙ্গিবাদ সেই শূন্যতায় বেড়ে উঠতে পেরেছে৷ বিমান হানা, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র এবং এমন সব প্রশিক্ষক, যারা এই সব অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহারে প্রশিক্ষণ দেবেন৷ সব সত্ত্বেও এই প্রশিক্ষক পাঠানোতে যেন কোথাও এক অসহায়তার ভাব রয়ে গেছে৷