ইসলামি ছাত্র শিবিরের ‘ফুলের মালা’ কার গলায়?
২৬ জুন ২০২৫
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এর মধ্য দিয়ে অপরাধীরাই উৎসাহিত হয়। আর এসবের পেছনে আছে রাজনৈতিক ইন্ধন।
নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার চরকৌল গ্রামে গত ৬ জুন জান্নাতুল ফেরদৌস নামে এক গৃহবধু নির্যাতনের শিকার হন। নির্যাতিতার দাবি, তার স্বামী হাসানুর রহমান হাসান ও তার ভাই বড়ইগ্রাম ইউনিয়ন ছাত্র শিবিরের সভাপতি মোহাম্মদ হারুন খান তাকে নির্যাতন ও শ্লীলতা হানি করে। চিৎকার শুনে স্থানীয় লোকজন গিয়ে ওই নারীকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। সেখানে চিকিৎসা চলার সময়ই জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় কয়েকজন নেতা ওই নারীকে হাসানুর রহমানের বাড়িতে নিয়ে রেখে আসেন। এরপর ১৪ জুন বাড়ির সামনে বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে রশি দিয়ে বেঁধে নির্যাতন করে তালাকনামায় স্বাক্ষর করানো হয় বলে অভিযোগ। সেখানেই শেষ নয়৷ এরপর জোর করে বাসে তুলে গাজীপুরে পাঠিয়ে দেয়া হয় জান্নাতুল ফেরদৌসকে। গাজীপুরে আহসান উল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে বড়াইগ্রাম ফিরে গিয়ে বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করে তালাকনামায় স্বাক্ষর করানোর অভিযোগে হাসানুর রহমান ও তার ভাই বড়ইগ্রাম ইউনিয়ন ছাত্র শিবিরের সভাপতি মোহাম্মদ হারুন খান খানের বিরুদ্ধে মামলা করেন গত ২৫ জুন।
মামলার পর আবার তিনি গাজীপুরে ফিরে যান। সেখানে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন জান্নাতুল। তার বাড়ি দিনাজপুরে। একই পোশাক কারখানায় চাকরি করতে গিয়েই হাসানুর রহমান হাসানের সঙ্গে তার পরিচয়।গত ৪ ফেব্রুয়ারি তারা বিয়ে করেন। একটি ভাড়া বাসায় কিছুদিন সংসার করার পর সেখান থেকে একদিন বাড়িতে চলে যান হাসানুর রহমান হাসান। ৬ জুন স্ত্রীর দাবি নিয়ে হাসানুর রহমান হাসানের গ্রামের বাড়িতে গেলে ভয়ানক নির্যাতনের শিকার হন জান্নাতুল।
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, “কোনো আসামিকে পুলিশ এখনো গ্রেপ্তার করেনি। উল্টো আমাকে আসামিরা হুমকি দিচ্ছে। তারা বলছে, ‘আমাদের ক্ষমতা সম্পর্কে তোমার ধারণা নাই। হয় মামলা তুলে নাও, নয়তো শেষ করে দেবো।’ আমার স্বামীর ভাই ছাত্রশিবিরের নেতা হওয়ায় সেই প্রভাব কাজে লাগানো হচ্ছে। আমি যে মামলার খোঁজ নিতে বড়াইগ্রামে যাবো তারও সাহস পাচ্ছি না।”
জামায়াতের স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ
জান্নাতুল ফেরদৌস ডয়চে ভেলেকে আরো বলেন, “প্রথম দফা নির্যাতনের পর হাসাপতাল থেকে স্থানীয় জামায়াত নেতারা যখন আমাকে বুঝিয়ে আমার স্বামীর বাড়িতে নিয়ে যায়, তখন আমি ভেবেছিলাম আর কোনো ঝামেলা হবে না। আমিও সংসার করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওটা ছিল আমাকে তালাকের কাগজে সই করানোর একটা ষড়যন্ত্র। ফলে বাড়ি নিয়ে যখন গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করা হয়, তখন ওই নেতারা আর আসেননি।”
কিন্তু আসামিরা এখন কোথায়? এখনো তাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি কেন? মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বড়ইগ্রাম থানার সাব-ইন্সপেক্টর সিরাজুল ইসলাম বলেন, “আসামিরা পলাতক আছেন, তাই তাদের আটক করতে পারছি না। তাদের বাড়িতে কয়েকবার অভিযান চালিয়েছি। ”
তার কথা, “তদন্তে জান্নাতুলকে নির্যাতনে তার স্বামী ও তার ভাইয়ের সম্পৃক্ততা পেয়েছি। আর বিয়ের কাবিন, চিকিৎসকের সার্টিফিকেটসহ আরো প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করেছি। আরো কেউ নির্যাতনে জড়িত কিনা তা-ও তদন্ত করে দেখছি৷”
তবে তার দাবি, “জামায়াত নেতা বা কোনো পক্ষের চাপ নেই। কোনো চাপ দিয়ে মামলার তদন্তে বাধা দেয়া যাবে না।”
বড়ইগ্রাম জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি আবুবকর সিদ্দিকর দাবি,“ ওই মেয়েটির ব্যাপারে একটি সুন্দর সমাধানের চেষ্টা করেছিলাম ওসি সাহেবের মাধ্যমে। কিন্তু পরে মেয়েটি নানা জনের পরামর্শে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে।”
“তাকে নির্যাতন করেছেন তার স্বামী হাসানুর রহমান হাসান। সে কখনো শিবির করতো না। তার বড় ভাই মোহাম্মদ হারুন খান বড়ইগ্রাম ইউনিয়ন ছাত্র শিবিরের সভাপতি। সে নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত না। তার আলাদা সংসার আছে। তাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মামলায় জড়ানো হয়েছে। তবে আমরা নারী নির্যাতনের ঘটনা সমর্থন করি না। আমরা এর বিরুদ্ধে।”
চট্টগ্রামে নারীর জন্য লাথি ও ‘ফুলের কাঁটা’
মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের মামলায় জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে খালাস ও কারামুক্তির প্রতিবাদে গত ২৮শে মে বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব এলাকায় গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের ডাকা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি দেয় গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট। ওই কর্মসূচি পালনের সময় হামলা চালানো হয় শাহবাগবিরোধী ঐক্যের ব্যানার নিয়ে আসা কিছু মানুষ৷
হামলায় বেশ কয়েজন আহত হন। হামলাকালে নারীসহ দুজনকে লাথি মারার ১৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। হামলার পর প্রেসক্লাবের পাশে একটি ভবনের নীচে আশ্রয় নিয়েছিলেন গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের নেতা-কর্মীরা। সেখানে এক পুলিশ সদস্য সদস্যকেও দেখা যায়।
লাথি মারা ওই যুবকের নাম আকাশ চৌধুরী। তিনি ছাত্রশিবিরের চট্টগ্রাম মহানগরের ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা। প্রথমে তাকে নেতা হিসেবে অস্বীকার করলেও পরে সমালোচনার মুখে ৩০ মে তাকে ইসলামী ছাত্র শিবির থেকে বহিষ্কার করে জামায়াতে ইসলামী। একদিন পরই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে ৪ঠা জুন আকাশ চৌধুরীকে জামিন দেয় আদালত। জামিনে মুক্তির পর আকাশ চৌধুরীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়। তার ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন ব্যক্তি এক নারীসহ দুজনকে লাথি মারা আকাশ চৌধুরীকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন এবং তার সঙ্গে ছবি তুলছেন।
গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের চট্টগ্রামের সভাপতি রিপা মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, “পুলিশ মামলাই তো করেছে দুর্বল। মামলায় নারীকে লাথি মারার কথা নেই। আমি নিজেও হামলার শিকার হয়েছি। বলা হয়েছে, দখল ও চাঁদাজি নিয়ে সংঘর্ষ হয়েছে। আমরা বিবৃতি দিয়ে ওই মামলা প্রত্যাখ্যান করেছি।”
“পুলিশের ভ্রান্ত মামলার কারণেই শিবিরের আকাশ চৌধুরী জামিন পেয়েছেন,” বলেন তিনি।
তার কথা, “আকাশ চৌধুরীকে কিন্তু প্রথমে গ্রেপ্তার করা হয়নি। জামায়াতও তাকে প্রথমে বহিস্কার করেনি। তাকে সবাই চেনে, তারপরও না। ঘটনার সময় দুইজনকে পুলিশ আটক করেছিল। তাদের কিন্তু কোতোয়ালী থানা ঘেরাও করে তৌহিদী জনতা ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। আর আকাশ চৌধুরী জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর তাকেও ফুলের মালা দেয়া হয় তৌহিদী জনতার নামে। আসলে তার বিরুদ্ধে মামলা, আটক, জামিন সবই সজানো নাটক বলে মনে হয়েছে।”
তিনি আরো বলেন,“ নারীর অবমাননাকারীদের শুধু এখানে নয়, ঢাকাসহ আরো কয়েকটি এলাকায় একইভাবে ফুলের মালা দেয়া হয়েছে। আমরা মৌলবাদী গোষ্ঠীর উত্থান দেখতে পাচ্ছি। আগের মতো এখনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে হামলা হচ্ছে।”
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালী থানার সাব-ইন্সপেক্টর ইমাম হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, “ মামলা তো করেছি আমরা। ওই নারী তো মামলা করেননি। দ্রুত বিচার আইনের মামলায় আমরা দখল ও মারামারির কথা বলেছি। তখন জানতাম না যে নারীকে লাথি মারা হয়েছে। পরে ওই ছবি ভাইরাল হলে আমরা জানতে পারি।”
“তবে আমরা তদন্ত শেষে চার্জশিট দেয়ার সময় নারীকে অবমাননার বিষয়টি রাখবো। ধারারও পরিবর্তন হতে পারে,”।
চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের নায়েবে আমীর মোহাম্মদ উল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন,“ আমরা আকাশ চৌধুরীকে বহিষ্কার করেছি। প্রথমে তার পরিচয় নিশ্চিত না হওয়ায় বহিষ্কার করতে একটু সময় লেগেছে।”
“তাকে জামিন দিয়েছে আদালত। সে ব্যাপারে তো আমরা কিছু বলতে পারবো না। কিন্তু সে মুক্তি পাওয়ার পর আমাদের পক্ষ থেকে তাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জনানো হয়নি। কারা দিয়েছি জানি না। তাকে আমরা আর শিবিরে ফেরত নেবো না বলে এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত আছে। সে যা করেছে, তা জামায়াত কখনোই সমর্থন করে না। ভবিষ্যতেও করবে না।”
গত মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক নারীকে তার পোশাকের কারণে হেনস্তা করার পর ভুক্তভোগী নারী শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী মোস্তফা আসিফ অর্ণবকে ওই মামলায় আটকের পর পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করলেও তৌহিদী জনতা থানা ঘেরাও করে। থানা থেকে আদালতে পাঠানোর পর তিনি জামিন পান। তার মুক্তির পরও পাগড়ি, ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হয়। ওই নারী মামলা প্রত্যাহারেও বাধ্য হন।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন,“নাটোরের ঘটনা আমার জানা নাই। তবে চট্টগ্রামের ঘটনায় যে জড়িত সে শিবিরের কোনো পর্যায়ের নেতা না। পরবর্তীতে তাকে দল থেকে বস্কিার করা হয়েছে। আমরা যখন তার উচ্ছৃঙ্খল কাজ সম্পর্কে জেনেছি, ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা কোনো অন্যায়কে সমর্থন দিই না। প্রশ্রয় দিই না। আমরা এটাকে ঘৃণাও করি৷’’
’’সে গ্রেপ্তার হয়েছে। মামলা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আইনে যা আছে তাই হবে,” বলেন তিনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাক ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, “নারীকে একটি গোষ্ঠী ঘরে রাখতে চায়। সেটা আগেও ছিলো। তবে এখন পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। সেটা হলো এখন যারা অবমাননা করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়না। আটক করা হলেও থানা ঘেরাও করে তাদের ছাড়িয়ে নেয়া হয়। ছাড়ার পর ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হয়। উদযাপন করা হয়। ফলে অবমানাকারীরা আরো উৎসাহিত হয়।”
“নারীকে এখন বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়া চলছে। এখানে রাজনীতি আছে। তাদের চিন্তার বাইরে কোনো নারী গেলে কথা বললে তাকে টার্গেট করা হচ্ছে,” বলেন তিনি।
আর মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, “এই যে নারীকে হেনস্তা করা হচ্ছে। মামলা হচ্ছে। গ্রেপ্তার হচ্ছে। আবার ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। মুক্তি পাওয়ার পর ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হচ্ছে। এটা হলো একটা সার্কেল। এটা দিয়ে বলা হচ্ছে নারীকে হেনস্তা করলে কোনো শাস্তি হবেনা। এর মধ্য দিয়ে আসলে অপরাধীদের আরো উৎসাহিত করা হয়।”
তার কথা, “দেশকে অস্থিতিশীল করা এবং ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়া এর উদ্দেশ্য।”