মিশরের এক ইসলামি সংগীত শিল্পী বিশ্বের দরবারে ইসলামি সংগীতের কদর বাড়াতে এতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংগীতের সংমিশ্রণ ঘটাচ্ছেন৷
বিজ্ঞাপন
মিশরের মোহাম্মদ আল-তোহামি ইসলামি সংগীত ‘ইনশাদ' পরিবেশনে দারুণ পারদর্শী৷ ১৪শ' বছরের পুরোনো ইসলামি সংগীতের একটি রূপ এটি, যেখানে আল্লাহ ও মহানবীর গুণগান করা হয় কথা ও সুরের মাধ্যমে৷
আল তোহামি ইনশাদ গাইতে যতটা পছন্দ করেন, গেম অফ থর্নসের থিম সং গাইতেও ততটা ভালোবাসেন৷
৪১ বছর বয়সি তোহামি সুফি ইসলাম দ্বারা অনুপ্রাণিত৷ এ কারণে প্রাচীন ইসলামি পদ্য এবং কাব্য সুরের সাথে পরিবেশন করে তিনি আত্মতৃপ্তি পান৷
তবে ইনশাদকে তোহামি এমনভাবে উপস্থাপন করছেন, যা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হচ্ছে৷ ইসলামি সংগীতের এই ধারা নিয়ে তিনি নানা পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেছেন৷
নিজামউদ্দিন দরগা
৭০০ বছরের পুরনো নিজামউদ্দিন দরগা। দিল্লির এই দরগা তৈরি করেছিলেন সুফি সাধক হযরত নিজামউদ্দিন। এই সাধনস্থল সব ধর্মের মানুষেরই তীর্থস্থান।
ছবি: DW/S. Gosh
দিল্লিতে নিজামউদ্দিন আউলিয়া
ভারতীয় উপমহাদেশে সুফি সংস্কৃতি নিয়ে আসার ক্ষেত্রে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাম হযরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া। দিল্লিতে তাঁর দরগায় এখনও সুফি সাধনা এবং সঙ্গীতের চর্চা হয়।
১২৩৮ সালে উত্তরপ্রদেশে জন্ম হয়েছিল হযরত নিজামউদ্দিনের। খুব ছোট বয়সেই বাবাকে হারান তিনি। পরে মায়ের সঙ্গে চলে আসেন দিল্লি। অল্প বয়সেই সুফি সাধানার প্রতি আকৃষ্ট হন নিজামউদ্দিন।
ছবি: DW/S. Gosh
ভালবাসাই ধর্ম
নিজামউদ্দিন বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর বাস করেন প্রতিটি মানুষের ভিতরে। ভালবাসা দিয়েই সেই ঈশ্বরকে জয় করা যায়। তাঁর দরগায় সব ধর্মের মানুষেরই ছিল আনাগোনা। সকলকে নিয়েই চলার কথা বলতেন নিজামউদ্দিন।
ছবি: DW/S. Gosh
সর্বধর্ম সমন্বয়
যে সময় দরগা তৈরি করছেন নিজামউদ্দিন, উপমহাদেশে তখন সদ্য পৌঁছেছে ইসলাম। শুরু হয়েছে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে নিজামউদ্দিন গোটা দেশ জুড়ে প্রচার করেছিলেন সম্প্রীতির বার্তা।
ছবি: DW/S. Gosh
এলেন আমির খসরু
সুফি সঙ্গীতকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিলেন কবি আমির খসরু। তিনিও ছিলেন নিজামউদ্দিনের শিষ্য। নিজামউদ্দিন দরগায় হজরত আউলিয়ার কবরের পাশেই রয়েছে তাঁর কবর।
ছবি: DW/S. Gosh
বিশ্ব সংস্কৃতি
৭০০ বছরের পুরনো এই দরগায় এক সময় গোটা পৃথিবী থেকে এসেছেন সুফি সাধকরা। ধর্ম এবং সংস্কৃতির চর্চা করেছেন। এখনও বছরের বিভিন্ন সময়ে দেশ বিদেশের সুফিরা আসেন এখানে।
ছবি: DW/S. Gosh
সেই সংস্কৃতি চলছে
নিজামউদ্দিন আউলিয়ার বংশধররাই এখনও দরগার রক্ষণাবেক্ষণ করেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় হয় সুফি গান। পালিত হয় নানা উৎসব। উৎসবেও থাকে না ধর্মের ভেদাভেদ।
ছবি: DW/S. Gosh
বসন্ত পঞ্চমী
বসন্ত পঞ্চমীতে বাংলার ঘরে ঘরে যখন সরস্বতী পুজো হয়, খাজা নিজামউদ্দিনের দরগায় তখন হয় বসন্ত আবাহনের অনুষ্ঠান। হাতে সর্ষে ফুল নিয়ে হলুদ কাপড়ে সেজে বিকেল থেকে শুরু হয় গান।
ছবি: DW/S. Gosh
বসন্ত ভালবাসার কাল
বসন্তের আবাহনে ভালবাসার গান গাওয়া হয় দরগায়। সমস্ত ধর্মের মানুষ আসেন সেখানে। সকলের গলায় পরিয়ে দেওয়া হলুদ চাদর। হাতে দেওয়া হয় ফুল।
ছবি: DW/S. Gosh
নিজামুদ্দিনকে হলুদ চাদর
নিজামউদ্দিনের কবরের উপরেও দেওয়া হয় হলুদ চাদর। সঙ্গে ঢোল বাজিয়ে চলতে থাকে গান। সেটাই প্রার্থনা।
ছবি: DW/S. Gosh
আমির খসরুর গান
আমির খসরুর কবরের সামনে বসেও গাওয়া হয় তাঁরই লেখা বসন্তের গান। গোটা এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে তালে বাদ্যে।
ছবি: DW/S. Gosh
আকবরের কথা
নিজামউদ্দিন আউলিয়ার এই প্রেম ধর্মে আকৃষ্ট হয়েছিলেন সম্রাট আকবরও। আইন-ই-আকবরীতেও সুফি সাধকের কথা বলা হয়েছে। লেখা হয়েছে আমির খসরুর কথাও।
ছবি: DW/S. Gosh
পাশেই মসজিদ
দরগার গায়েই রয়েছে মসজিদ। নামাজের সময় বন্ধ হয় গান। নিস্তব্ধ পরিবেশে ভেসে আসে আজানের সুর।
ছবি: DW/S. Gosh
দরগার চাতালেই নামাজ
দরগার চাতালে বসেই নামাজ সেরে নিচ্ছেন এই ভদ্রমহিলা।
ছবি: DW/S. Gosh
সুফির প্রার্থনা
অনেকেই দরগার বারান্দায় বসে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সামনে রাখা পছন্দের সুফি কবিতার বই নামিয়ে পাঠ করেন। সেটাই প্রার্থনা।
ছবি: DW/S. Gosh
সুফি সাধক
দরগায় এখনও বাস করেন বহু কাওয়ালি গায়ক এবং সাধক। তাঁদের ঘিরে বসে থাকেন সাধারণ মানুষ। কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন সুখ-দুঃখের কথা। সাধকরা শোনেন, উপদেশ দেন।
ছবি: DW/S. Gosh
এ এক অন্য জগৎ
সরু গলি বেয়ে জাফরির দেওয়াল ধরে যেতে হয় দরগায়। এ যেন এক অন্য জগৎ। শহর থেকে অনেক দূরের কোনও পৃথিবী।
ছবি: DW/S. Gosh
মনের ইচ্ছা সুতোয়
দরগা ছেড়ে যাওয়ার আগে অনেকেই জাফরি দেওয়ালে মনের ইচ্ছে সুতোয় বেঁধে ঝুলিয়ে দেন। বলা হয়, নিজামউদ্দিন সকলের ইচ্ছা পূরণ করেন।
ছবি: DW/S. Gosh
19 ছবি1 | 19
যেখানে ইসলামি গানে যেকোন বাদ্যযন্ত্র বাজানো নিষেধ, সেখানে তিনি ওয়েস্টার্ন ঘরানার রক মিউজিক এবং অর্কেস্ট্রার সাথে এসব গান পরিবেশন করেন৷
সংবাদ সংস্থা এএফপিকে তোহামি জানান, তাঁর নতুন প্রকল্প শাস্ত্রীয় আরবি সংগীতের সাথে জনপ্রিয় সংগীতের ‘মিক্সিং'৷ অর্থাৎ রক, পপ সবধরনের সংগীতের সাথে এসব মিউজিকের মিশ্রন ঘটাতে চান তিনি৷ কেবল পাশ্চাত্য নয়, প্রাচ্যের সংগীতের সঙ্গেও ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় সংগীতের সংমিশ্রন করতে চান এই শিল্পী ৷ এর মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বের তরুণ প্রজন্মের কাছে শাস্ত্রীয় আরবি সংগীতের কদর বাড়বে বলে মনে করেন তিনি৷ বলেন, ‘‘সংগীতের কথার চেয়ে সুর মানুষকে বেশি আকর্ষণ করে, আর ইনশাদের সুর বিদেশিদের মনকে ছুঁয়ে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই৷''
তোহামির বাবাও ইসলামি সংগীত শিল্পী৷ ইয়াসিন আল-তোহামি মিশরের জনপ্রিয় ধর্মীয় শিল্পী৷ ২০১৪ সাল থেকে তোহামি কায়রোতে একটি গানের স্কুল চালাচ্ছেন, উদ্দেশ্য নতুন প্রজন্মের কাছে ধর্মীয় সংগীত ও সাহিত্যকে তুলে ধরা৷
এখন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের নয়টি দল স্নাতক হয়েছে এই স্কুল থেকে৷ তোহামি জানান, তাঁর স্কুলে বয়স, ধর্ম ও জাতীয়তার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, যে কেউ এখানে এসে ইসলামি সংগীতে তালিম নিতে পারে৷
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগীত উৎসবে অংশ নিয়ে থাকেন তোহামি৷ ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের হওয়া অ্যালবাম ‘অরিজিন'-এর তিনটি গানের সাথে সঙ্গত করেন তিনি৷ এই অ্যালবামটি গ্লোবাল মিউজিক অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয়৷ ফরাসি টিভিতে শিশুদের প্রতিভা বিকাশের অনুষ্ঠান ‘দ্য ভয়েস কিডস'-এ পারফর্ম করেছে তাঁর স্কুলের শিক্ষার্থীরা৷
গ্র্যামিজয়ী মিশরীয় সংগীত শিল্পী ফাতি সালামার সঙ্গে সম্প্রতি একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছেন তিনি ‘সুফিজম ভার্সাস মর্ডানিটি'৷
ইটালি ও নরওয়েতে তাদের যৌথ পরিবেশনার কথা থাকলেও করোনার কারণে তা বিলম্বিত হচ্ছে৷
তোহামি নিজেকে সুফি দর্শনপ্রেমী হিসেবে বর্ণনা করতে ভালোবাসেন৷ কারণ, ইসলামের এই ধারায় আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা জানানো হয় সংগীত, নৃত্য এবং কবিতার মাধ্যমে৷
তাঁর মতে, সুফি ইসলাম দর্শনকে কেউ যদি মনেপ্রাণে গ্রহণ করে, তবে সন্ত্রাসবাদের চিন্তা কখনো তার মনে স্থান পাবে না৷