তথাকথিত ‘ইসলামিক স্টেট’ অনলাইনে বেশ তৎপর৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে জিহাদি নিয়োগে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীটি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করছে৷ আর এ কাজে তারা সফল যেমন হয়েছে, তেমনি ধরাও পড়েছে৷
বিজ্ঞাপন
অনলাইন তৎপরতার দিক থেকে অতীতের সব জঙ্গি গোষ্ঠীকেই হার মানিয়েছে ‘ইসলামিক স্টেট (আইএস)'৷ আগে যেমন আল-কায়েদা বা তালেবানের মতো জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো অফলাইনে জিহাদি নিয়োগের দিকে বেশি গুরুত্ব দিত, আইএস-এর গুরুত্ব বেশি অনলাইনের দিকে৷ যদিও অফলাইনে জঙ্গি গোষ্ঠীটির কার্যক্রম চালু রয়েছে, কিন্তু পশ্চিমা বিভিন্ন দেশের তরুণ প্রজন্ম থেকে জিহাদি বাছাইয়ে তাদের প্রথম পছন্দ অনলাইন সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলো বলেই মনে হচ্ছে৷
জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো মূলত দু'ভাবে অনলাইন থেকে জিহাদি নিয়োগ করে থাকে৷ প্রথম উপায় হচ্ছে, সম্ভাব্য জিহাদিকে খুঁজে বের করা এবং দিনের পর দিন তার পেছনে লেগে থাকা৷ এক্ষেত্রে শুরুর দিকে জঙ্গি তৎপরতায় অংশ নেওয়ার বদলে বিশ্বে তাদের চোখে মুসলমানদের ওপর আক্রমণের বিষয়গুলো নানাভাবে সামনে নিয়ে আসে জঙ্গি গোষ্ঠীর অনলাইন সদস্যরা৷ এভাবে ধীরে ধীরে সম্ভাব্য জিহাদির মনে মুসলমান হিসেবে বঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি জাগ্রত করা হয়৷ তাদের বিবেচনায় বিধর্মী কর্মকাণ্ডগুলো তুলে ধরা হয়৷ এরপর উগ্রপন্থার দিকে নিয়ে যেতে চায় তাদের৷ বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এই কাজে প্রথাগত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়াও নারী জিহাদি খুঁজে পেতে বিভিন্ন ডেটিং সাইটও ব্যবহার করে নিয়োগদাতা জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্যরা৷
‘ইসলামিক স্টেট’ আসলে কী?
আল-কায়েদার অখ্যাত এক উপদল থেকে প্রভাবশালী ‘মিলিট্যান্ট মুভমেন্টে’ পরিণত হয়েছে তথাকথিত ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএস৷ জিহাদি এই গোষ্ঠীটির দখলে থাকা অঞ্চল থেকে আক্রমণের কৌশল – আইএস-এর এমন নানা দিক তুলে দেয়া হলো এই ছবিঘরে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Souleiman
আইএস কোথা থেকে এসেছে?
ইসলামিক স্টেট (আইএস) সুন্নী ইসলামিস্ট আদর্শে বিশ্বাসী আল-কায়েদার একটি উপদল, যেটি আইএসআইএল, আইসিস এবং দায়েশ নামেও পরিচিত৷ ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আক্রমণের পর এটির বহিঃপ্রকাশ ঘটে৷ এই গোষ্ঠীর নেতৃত্বে রয়েছেন আবু বকর আল-বাগদাদি৷ জঙ্গি গোষ্ঠীটির লক্ষ্য হচ্ছে ইরাক, সিরিয়া এবং অন্যান্যা অঞ্চল নিয়ে একটি ইসলামিক স্টেট বা খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
আইএস কোথায় কাজ করে?
বিশ্বের ১৮টি দেশে আইএস সক্রিয় রয়েছে বলে ধারণা করা হয়৷ ইরাক এবং সিরিয়ার কিছু অংশ এই গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং এটি সিরিয়ার রাকা শহরকে রাজধানী হিসেবে বিবেচনা করে৷ তবে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে এখন অবধি নিজেদের দখলে থেকে এক চতুর্থাংশ এলাকা তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে৷
কারা তাদের বিরুদ্ধে লড়ছে?
আইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বেশ কয়েকটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে৷ বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশের সমন্বয়ে তৈরি মার্কিন নেতৃত্বাধীন একটি ‘কোয়ালিশন’ আইএস অধ্যুষিত এলাকায় বিমান হামলা চালাচ্ছে৷ এই কোয়ালিশনে কয়েকটি আরব দেশও রয়েছে৷ অন্যদিকে সিরিয়া সরকারের পক্ষে সেদেশে বিমান হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া৷ তবে ভূমিতে তাদের বিরুদ্ধে লড়ছে কুর্দিশ পেশমার্গার মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলো৷
ছবি: picture-alliance/abaca/H. Huseyin
আইএস-এর অর্থের উৎস কী?
জঙ্গি গোষ্ঠীটির অর্থ আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে তেল এবং গ্যাস৷ এটি এখনো সিরিয়ার তেল উৎপাদনের এক তৃতীয়াংশ দখলে রেখেছে৷ আর মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিমান হামলার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে জঙ্গি গোষ্ঠীর এই মূল্যবান সম্পদ৷ এছাড়া কর, মুক্তিপন এবং লুট করা পুরাকীর্তি বিক্রি করেও অর্থ আয় করে এই জঙ্গি গোষ্ঠীটি৷
ছবি: Getty Images/J. Moore
আইএস কোথায় কোথায় জঙ্গি হামলা চালিয়েছে?
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অসংখ্য জঙ্গি হামলার দায় স্বীকার করেছে আইএস৷ চলত বছর সবচেয়ে ভয়াবহ আত্মঘাতী হামলাটি চালানো হয়েছে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে, যেখানে দু’শোর বেশি মানুষ নিহত ও অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছে৷ আইএস-এর নেতারা জঙ্গি গোষ্ঠীটির আদর্শে বিশ্বাসীদের এককভাবে বিভিন্নস্থানে আঘাত হানতে উৎসাহ প্রদান করে৷
অন্যান্য আর কী কৌশল ব্যবহার করে আইএস?
নিজেদের ক্ষমতার পরিধি বাড়াতে অনেক কৌশল ব্যবহার করে আইএস৷ জঙ্গি গোষ্ঠীটি ‘কালচারাল ক্লিনজিংয়ের’ নামে সিরিয়া এবং ইরাকের অনেক ঐতিহাসিক শিল্পকর্ম লুট ও ধ্বংস করেছে৷ এছাড়া সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর কয়েকহাজার মেয়েকে ক্রীতদাসী বানিয়েছে৷ গোষ্ঠীটি নিজেদের ‘প্রোপোগান্ডা’ এবং নিয়োগের কাজে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে থাকে৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eid
শরণার্থী হয়েছেন কতজন?
সিরিয়ায় চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে সেদেশের প্রায় ৬০ লাখ মানুষ প্রতিবেশী লেবানন, জর্ডান এবং তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছেন৷ অনেক সিরীয় ইউরোপেও পাড়ি জমিয়েছেন৷ এছাড়া প্রায় ৩০ লাখ ইরাকে ইরাকের মধ্যেই অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন বলে খবর৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Souleiman
7 ছবি1 | 7
দ্বিতীয় পন্থাটি জিহাদিদের জন্য খানিকটা সহজ৷ জিহাদিদের অনলাইন প্রচারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেক সময় অনেক তরুণ স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজেই বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর ফোরামে যোগ দেয় এবং জঙ্গি তৎপরতায় অংশ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করে৷ এরকম প্রার্থীদের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো সঙ্গে সঙ্গে যে নিয়ে নেয় তা নিয়৷ বরং বিভিন্নভাবে যাচাইবাছাই করে সম্ভাব্য জিহাদি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়৷
আইএস কোনো জিহাদিকে দলে ভেড়ানোর আগে তার একটি ফাইল তৈরি করে যেখানে সেই ব্যক্তির বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের অ্যাকাউন্টের ঠিকানা, অনলাইন কার্যক্রম, পারিবারিক এবং আর্থিক অবস্থা, সক্ষমতা, আচরণ – সব কিছুই লিপিবদ্ধ করা হয়৷ আর খানিকটা যোগাযোগ তৈরি হয়ে গেলে স্কাইপের মাধ্যমে সরাসরি ভিডিও চ্যাটে সাক্ষাৎকার নেয় জঙ্গি গোষ্ঠীটি৷ ভিডিও চ্যাটের পর প্রথাগত ব্যবস্থার বাইরে এনক্রিপ্টেড বিভিন্ন ম্যাসেজিং সার্ভিস বা ই-মেল ব্যবস্থার মাধ্যমে নতুন জিহাদির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হয়৷
এখানে বলে রাখা ভালো, আইএসকে প্রযুক্তি জ্ঞানে যতটা দক্ষ মনে করা হয়, ততটা আসলে তারা নয়৷ পশ্চিমা গোয়েন্দারা এবং এই বিষয়ের সাংবাদিকরা তাদের অনলাইন তৎপরতার দিকে ভালোই নজর রাখেন৷ অনেক সময় তাদের নেটওয়ার্কে গোয়েন্দারা প্রবেশ করে ঘাপটি মেরে থাকে তথ্য সংগ্রহের জন্য৷ প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়ার পর কিংবা কোনো নেটওয়ার্ক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হলে সেই নেটওয়ার্কে সাইবার হামলা চালায় পশ্চিমা দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো, যাকে বলা হয় ‘সাইবারবম্ব'৷ গোয়েন্দারা যে সবক্ষেত্রে সফল হন, তাও না৷ সেটা হলে প্যারিস, ব্রাসেলস বা বার্লিনে হামলা রোখা যেত৷ তবে এ রকম অসংখ্য হামলার পরিকল্পনা রোখার সাফল্য গোয়েন্দাদের রয়েছে৷
উদ্বেগের কথা হচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও আইএস-এর তৎপরতা রয়েছে৷ বাংলাদেশি কিছু জিহাদি সিরিয়া এবং ইরাকে আইএস-এর হয়ে লড়াই করছে৷ আর বাংলাদেশের মধ্যেও অনেকে একই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তৎপরতা চালাচ্ছে যাদেরকে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী আখ্যা দিচ্ছে ‘নব্য জেএমবি' হিসেবে৷ এই জিহাদিদের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে পশ্চিমা গোয়েন্দাদের মতো বাংলাদেশের গোয়েন্দা বাহিনীরও ইন্টারনেট জ্ঞান বাড়াতে হবে, বিশেষ করে জিহাদিদের ‘ব্রেনওয়াশের' জন্য ব্যবহৃত অনলাইন নেটওয়ার্ক ধ্বংস করতে হবে৷ সেটা করা গেলে, কারো দরজায় দাঁড়িয়ে তিনি ‘জঙ্গি' কিনা জিজ্ঞাসা করার চেয়ে আরো নিশ্চিত হয়ে অভিযান চালানো সম্ভব হবে৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷
কোথা থেকে অর্থ পাচ্ছে আইএস?
পেট্রোলিয়াম বিক্রি থেকে শুরু করে ব্যাংক ডাকাতি, অধিকৃত এলাকায় কর চাপানো এবং প্রাচীন সামগ্রী বিক্রি করে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট প্রায় ২০০ কোটি ডলার একত্র করেছে৷ তাতে তাদের আরও ২ বছর চলে যাবার কথা৷
ছবি: picture alliance/abaca
বেআইনি তেল বিক্রি
বেআইনি ভাবে পেট্রোলিয়াম বিক্রি আইএস-এর আয়ের প্রধান উৎস৷ সিরিয়া ও ইরাকে বেশ কিছু বড় তৈলকূপ আপাতত তাদের দখলে৷ মূলত তুরস্কের মধ্য দিয়েই তারা চোরাচালানের কাজ চালিয়ে থাকে৷ মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতে, কালোবাজারে তেল বিক্রি করে আইএস-এর মাসে প্রায় ৪ কোটি ডলার আয় হয়৷
ছবি: Getty Images/J. Moore
ব্যাংক ডাকাতি
সিরিয়া ও ইরাকে কোনো এলাকা দখলের পর আইএস সবার আগে ব্যাংকগুলি কবজা করে ফেলে৷ মার্কিন প্রশাসনের ধারণা, এভাবে তারা ৫০ থেকে ১০০ কোটি ডলার আত্মসাৎ করেছে৷ শুধু মোসুল শহর দখল করেই তারা নাকি ৬২ কোটি ডলার লুট করেছিল৷ বছরে প্রায় ৫০,০০০ জিহাদি কর্মীর বেতন দিতে এই অর্থ যথেষ্ট৷
ছবি: Getty Images/S. Platt
কর আদায় ও চাঁদাবাজি
আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকার প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষকে ৫ থেকে ১৩ শতাংশ আয়কর দিতে হয়৷ জার্মান সরকারের সূত্র অনুযায়ী, আইএস অ-মুসলিমদের কাছ থেকে জিজিয়া করও আদায় করে৷ তাছাড়া চাঁদাবাজিও তাদের আয়ের আরেকটি উৎস৷
ছবি: DW/Andreas Stahl
প্রাচীন সামগ্রী বিক্রি
‘জিহাদিরা’ আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ ধ্বংস করতে অভ্যস্ত৷ তবে বেশি দামি অ্যান্টিক সম্পদ সযত্নে সরিয়ে ফেলে কালোবাজারে বিক্রি করে তারা৷ প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছ থেকেও অমূল্য সম্পদ কেড়ে নিয়ে বিক্রি করতে পিছপা হয় না এই গোষ্ঠী৷ তবে বিক্রিমূল্যের সঠিক অঙ্ক জানা নেই৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eid
মুক্তিপণ ও প্রচারণা
মানুষজনকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় আইএস-এর দু-মুখী চাল৷ একদিকে এটা আয়ের একটা উৎস, অন্যদিকে এর মাধ্যমে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রচারণার কাজও হয়ে যায়৷ কিছু ‘মূল্যবান’ জিম্মির শিরশ্ছেদ করে সেই ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়ে প্রচারণার ক্ষেত্রে বিপুল সাফল্য পায় আইএস৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
সহানুভূতি দেখাতে চাঁদা
আইএস-এর প্রতি সহানুভূতিপ্রবণ মানুষ গোটা বিশ্বেই ছড়িয়ে রয়েছে৷ তারা এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তহবিলে আর্থিক অবদান রাখে৷ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সূত্র অনুযায়ী সৌদি আরবে ২০১০ সাল থেকে ৮৬০ জন ব্যক্তিকে সন্ত্রাসের কাজে আর্থিক সাহায্য দেবার অভিযোগে শাস্তি দেওয়া হয়েছে৷ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ সেখানে ১০০ জনের শাস্তি হয়েছে৷