বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে একটি ঘটনায় ধর্ম ও বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব সামনে এসেছে৷ পাশাপাশি ধর্ম নিয়ে বাড়ছে অসহিষ্ণুতা৷ এ বিষয়ে কী ভাবছেন ইসলামি চিন্তাবিদরা? বিজ্ঞানীরাই বা কী বলছেন?
বিজ্ঞাপন
আসলেই ধর্ম আর বিজ্ঞান কি সাংঘর্ষিক? এ বিষয়ে জানতে ডয়চে ভেলের কথা বলেছে দুই জন ইসলামি চিন্তাবিদ এবং দুই বিজ্ঞানীর সঙ্গে৷
বিজ্ঞান চর্চা করতে গিয়ে বা পড়াতে গিয়ে কখনও কি মনে হয়েছে ধর্ম আর বিজ্ঞান সাংঘর্ষিক? জবাবে ইউজিসি অধ্যাপক ড. হাসিনা খান বলেন, ‘‘আমি কোন দিনই সে সমস্যা পাইনি, একেবারেই না৷ কোন রকম বিরোধ আমি দেখিনি এবং সে কথাটাই আমি প্রচার করি আমার ক্লাসে৷ আমি যে বিষয়টা পড়াই তার মধ্যে এ বিষয়টা টেনে আমি এটাই বোঝানোর চেষ্টা করি যে, এর মধ্যে কোন বিরোধ নেই৷
‘ধর্ম কখনও বিজ্ঞানের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা করেনি’
এই যে বিজ্ঞানকে ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হয় এটা কেনো? এর জবাবে ড. খান বলেন, ‘‘এটা কারও স্বার্থে করা হয়৷ নিজের কোন এজেন্ডা বা কিছু পাওয়ার জন্য এটা করে বলে আমার আগাগোড়া মনে হয়েছে৷ ধর্মকে এর মধ্যে নিয়ে আসার কোন কারণ নেই৷ ধর্ম কখনও বিজ্ঞানের মধ্যে প্রতিবন্ধকতা করেনি৷ বিজ্ঞান প্রমাণিত৷ আমি অনেক অনেক প্রমাণ দিয়ে ক্লাসে পড়াই ৷''
ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে কোন সম্পর্ক বা দ্বন্দ্ব আছে কি-না? জানতে চাইলে ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমীর পরিচালক মাওলানা আনিসুজ্জামান সিকদার বলেন, ‘‘না, প্রশ্নই আসে না৷ কোন দ্বন্দ্ব নেই৷ যদি কোন দ্বন্দ্ব থাকে সেটা হল আমাদের অজ্ঞানতা৷ আমাদের বুঝতে না পারার কারণে দ্বন্দ্ব৷ এটা আমাদের বোঝার ভুল৷ আল্লাহ কোরআনকে বলেছেন বিজ্ঞানময় কোরআন৷ পরতে পরতে আল্লাহ বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করেছেন৷ দিন থেকে রাত আর আসমান থেকে জমিন এর মধ্যে আল্লাহ জ্ঞানী লোকের জন্য অনেক উপকরণ রেখেছেন৷ আপনি যদি সৃষ্টিজগৎকে না চেনেন তাহলে তো আপনি স্রষ্টাকে তো চিনবেন না৷''
’আল্লাহ কোরআনকে বলেছেন বিজ্ঞানময় কোরআন’
ধর্ম ও বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. আ. ব. ম. ফারুক বলেন, ‘‘ ধর্ম হল মানুষের নিজস্ব বিশ্বাসের বিষয়৷ বিজ্ঞানে অভিরুচির কোন বিষয় না৷ এখানে যেটা সত্য সেটাই বলতে হবে৷ একজন একটা ওষুধ আবিষ্কার করেছেন এটা সত্য কথা৷ সৃষ্টিকর্তা মানুষকে অসুখ যেমন দেন, অসুখের চিকিৎসাও দেন৷ আমার দায়িত্ব হল চিকিৎসা খুঁজে বের করা৷ এই বের করতে গেলে তো বিজ্ঞানকে লাগবে৷ সব ধর্মই বলছে, জ্ঞান অন্বেষণ করো৷ ইসলাম তো বলছে, জ্ঞান অন্বেষণ করতে সুদূর চীন দেশেও যাও৷ তখনকার সময়ে আরব দেশ থেকে চীনে যাওয়া খুবই কষ্টকর ছিল৷ সুতারাং জ্ঞান অন্বেষণ হল এতটাই জরুরি৷'‘
ধর্ম আর বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ বি এম সিদ্দিকুর রহমান নিজামী বলেন, ‘‘আরও আলোচনা করে, পড়াশোনা করে আগাতে হবে৷ তাহলে সব বিরোধ থেকে আমরা একটা গ্রহণযোগ্য অবস্থানে পৌঁছতে পারবো৷''
‘ইসলাম তো বলছে, জ্ঞান অন্বেষণ করতে সুদূর চীন দেশেও যাও’
এই যে এক একটি ঘটনায় ইসলাম অবমাননা হয়েছে বলে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়, শাস্তি চাওয়া হয় এ ব্যাপারে আপনার মত কি? এ প্রসঙ্গে মাওলানা সিকদার বলেন, ‘‘অভিযোগগুলো নিয়ে যদি আপনি বিচার করেন তাহলে দেখবেন কিছু স্বার্থান্বেষী লোক তাদের স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য এটা করেন৷ ভারতবর্ষে এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে বসবাস করে৷ এর মধ্যে আগের ৭০০ বছরে তো কোন বিরোধ ছিল না৷ বৃটিশরা যখন এখানে এল তখন হিন্দু-মুসলমান দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করে দিল৷ তখনই শুরু হল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা৷ নিজেদের কর্তৃত্ব রাখার জন্য তারা এটা করেছে৷ বাংলাদেশের মতো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ পৃথিবীতে বিরল৷ এখানে যে দু'একটা ঘটনা ঘটছে, সেটা একটা স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের হীন স্বার্থে ভাইতে ভাইতে গোলমাল লাগিয়ে দিচ্ছে৷''
কুমিল্লার ঘটনার উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে তো প্রমাণ হলো, একটা স্বার্থান্বেষী মহল তাদের স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য এই কারবার করেছে৷
মাওলানা সিকদার আরও বলেন, ‘‘আপনি যদি কাউকে জাহান্নামী বলেন, এটা বলা যাবে না৷ কে জান্নাতে যাবে আর কে জাহান্নামে যাবে এটা আল্লাহ'র ইচ্ছা৷ তিনি যাকে চান তাকে জান্নাতে নেবেন৷''
পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইন ও একজন আসিয়া বিবি
আসিয়া বিবি পাকিস্তানের এক খ্রিষ্টান নারী৷৷ ২০১০ সালে তাঁকে পাকিস্তানের এক আদালত ব্লাসফেমির দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়৷ কে এই আসিয়া, কেনই বা তাঁর এই মামলা কেড়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর?
ছবি: picture alliance/dpa
পানি নিয়ে বিরোধ
২০০৯ সালে পাঞ্জাবের শেখুপুরা জেলায় এক মাঠে কাজ করার সময় মহানবি হযরত মোহাম্মদকে অপমান করার অভিযোগ ওঠে আসিয়া বিবির বিরুদ্ধে৷ মাঠে মুসলিম ধর্মাবলম্বী কিছু নারী কাজ করছিলেন৷ আসিয়া বিবি পানি নিতে গেলে ‘অমুসলিম’ বলে তাঁকে পানির পাত্র ধরতে দেননি তাঁরা৷ তারপর তাঁরা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আসিয়া বেগমের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
স্পর্শকাতর বিষয়
মাঠের বাকবিতণ্ডার পর আসিয়ার বাসায় কিছু ‘ক্ষুব্ধ জনতা’ হামলা চালায় বলে জানায় স্থানীয় সংবাদমাধ্যম৷ পরে পুলিশ আসিয়াকে তাদের হেফাজতে নিয়ে যায় এবং তাঁর বিরুদ্ধে আনা ব্লাসফেমির অভিযোগের তদন্ত শুরু করে৷ ৯৭ শতাংশ মুসলিমের দেশ পাকিস্তানে ধর্ম অবমাননাকে বেশ স্পর্শকাতর বিবেচনা করা হয়৷
ছবি: Arif Ali/AFP/Getty Images
বিতর্কিত আইন
১৯৮০ সালে সেনা শাসক জেনারেল জিয়াউল হক ব্লাসফেমি আইন চালু করেন৷ অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, অনেকক্ষেত্রেই এই আইনকে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা মেটানোর কাজে ব্যবহার করা হয়৷ খ্রিস্টান, হিন্দু, এমনকি ইসলামের সংখ্যালঘু গোত্র আহমাদিয়াদের বিরুদ্ধেও এই আইনের অপপ্রয়োগ করা হয়৷
ছবি: Noman Michael
রাষ্ট্র বনাম আসিয়া
২০১০ সালে এক আদালত আসিয়াকে ধর্ম অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে৷ বাদীর আইনজীবী অভিযোগ করেন, ব্যক্তিগত বিরোধ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে ব্লাসফেমির অভিযোগ আনা হয়েছে৷ কিন্তু আদালত আসিয়ার ফাঁসির রায় দেন৷ ২০১০ সাল থেকেই আসিয়ার পরিবার ভয়ের মধ্যে বাস করছে৷ তখন থেকে আসিয়ার মুক্তির জন্য তাঁর স্বামী আশিক মাসিহ আইনি-যুদ্ধ করে চলেছেন৷
ছবি: picture alliance/dpa
গুপ্তহত্যার শিকার সমালোচকরা
২০১০ সালে পাঞ্জাবের তৎকালীন গভর্নর সালমান তাসির আসিয়ার পক্ষে দাঁড়ান৷ ব্লাসফেমি আইনের সংস্কারেরও দাবি তুলে তিনি৷ তাঁর এই অবস্থানে ক্ষুব্ধ হয় চরমপন্থিরা৷ ২০১১ সালে ইসলামাবাদে নিজের দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন তাসির৷ একই বছর ব্লাসফেমি আইনের আরেক সমালোচক তৎকালীন সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টিও বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন৷
ছবি: AP
হত্যাকারীকে সংবর্ধনা
তাসিরের হত্যার পর চরমপন্থি নেতা কাদরি রীতিমতো নায়কে পরিণত হন৷ তাকে কারাগারে নেয়ার সময় লাল গোলাপ ছিটিয়ে সংবর্ধনা দেয়া হয়৷ ২০১৬ সালে কাদরিকে ফাঁসি দেয়া হয়৷ কাদরির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় হাজার হাজার ইসলামপন্থি জড়ো হয়েছিলেন৷ এমনকি কাদরির নামে তার স্মরণে একটি মাজারও প্রতিষ্ঠা করে তার সমর্থকরা৷
ছবি: AP
বিচার বিভাগে ভীতি
ব্লাসফেমি আইনের সমালোচকদের হত্যাকাণ্ডে ভয় ঢুকেছে আইনজীবীদের মধ্যেও৷ আসিয়ার পক্ষে হাই কোর্টে লড়তে কোনো আইনজীবীই সম্মতি জানাননি৷ ২০১৪ সালে লাহোর হাই কোর্ট আসিয়ার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে৷ ২০১৬ সালে এই মামলা সুপ্রিম কোর্টে গেলেও এক বিচারক ‘ব্যক্তিগত’ কারণ দেখিয়ে তাতে অংশ নিতে রাজি হননি৷
ছবি: Reuters/F. Mahmood
আইনের খাড়া
অ্যামেরিকান সেন্টার ফর ল অ্যান্ড জাস্টিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে পাকিস্তানে অন্তত ৪০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও সেক্যুলার মুসলিমদের এই আইনের লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়৷ এখনো এই আইনের আওতায় কারো বিরুদ্ধে রায় কার্যকর করা না হলেও ক্ষুব্ধ জনতার হাতে মৃত্যুর উদাহরণ রয়েছে অনেক৷
ছবি: APMA
ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর নিপীড়ন
পাকিস্তানে খ্রিষ্টান ও অন্যান্য অমুসলিম ধর্মাবলম্বীরা প্রায়ই আইনি ও সামাজিক বৈষম্যের অভিযোগ করেন৷ গত কয়েক বছরে প্রমাণ ছাড়াই শুধুমাত্র সন্দেহের বশে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে অনেক খ্রিষ্টান ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে৷
ছবি: RIZWAN TABASSUM/AFP/Getty Images
ইসলামপন্থিদের হুমকি
আসিয়ার মৃত্যুদণ্ডের রায় পালটে গেলে ‘ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির’ হুমকি দিয়ে রেখেছে পাকিস্তানে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা, বিশেষ করে তেহরিক-ই-লাবাইক পাকিস্তান- টিএলপি৷ দেশটির খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের আশংকা, বিচারকরা রায় পালটানোর সিদ্ধান্ত জানালে পুরো দেশজুড়ে তাঁদের ওপর নৃশংসতা শুরু হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/B. K. Bangash
আন্তর্জাতিক সমর্থন
বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের সরকার ও মানবাধিকার সংগঠন আসিয়ার মামলার সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানিয়েছে৷ আসিয়ার মেয়ে ভ্যাটিকান সিটিতে গিয়ে পোপ ফ্রান্সিসের সাথে দেখা করে এসেছেন৷২০১৪ সালে লাহোর হাই কোর্টের রায়কে ‘ভয়াবহ অবিচার’ আখ্যা দেয় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷ অ্যামেরিকান সেন্টার ফর ল অ্যান্ড জাস্টিস আসিয়ার মৃত্যুদণ্ডের রায়ের নিন্দা জানিয়েছে৷