ইসলাম ধর্মে অঙ্গদান
১৭ অক্টোবর ২০১১ চিকিত্সার প্রয়োজনে অঙ্গদান করা মুসলিম-প্রধান দেশগুলিতে একটি সংবেদনশীল বিষয়৷ অথচ কারো ব্রেইন ডেথ বা মস্তিষ্কের মৃত্যু হলে তার সুস্থ হার্ট, লিভার বা কিডনি দিয়ে অন্য কোনো মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর জীবন রক্ষা করা যেতে পারে৷ আধুনিক চিকিত্সার এই বিষয়টি নিয়ে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যাও নেই৷ এ বিষয়ে আলেমদের দেয়া ফতোয়াতেও একটির সঙ্গে আরেকটির মিল খুঁজে পাওয়া যায়না৷ যারা অঙ্গদানকে প্রত্যাখ্যান করেন, তাঁরা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টির ব্যাখ্যা দিতে চান৷ নেদারল্যান্ডস'এর লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামবিদ মোহাম্মদ ঘালি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘তাঁরা মনে করেন মানব দেহকে মৃত্যুর পরেও রক্ষা করা উচিত৷ পবিত্র কোরান ও নবীদের বক্তব্যে খুঁজে পাওয়া যাবে এই ধরনের নীতিকথা৷ একারণে কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে বের করা জায়েজ নয়৷ বিশেষ করে মৃত্যুর পর, যখন কারো পক্ষে বাধা দেয়া আর সম্ভব নয়৷''
মানব দেহের মালিক কে?
মানুষের শরীরের আসল অধিকারী কে, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে এখানে৷ ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের আসল মালিক ও রক্ষাকর্তা হলেন আল্লাহ৷ অঙ্গদানের সমালোচকরা এইরকম যুক্তিই তুলে ধরেন৷ ধর্মতাত্ত্বিক ঘালি বলেন, ‘‘অঙ্গদানের সমালোচকদের মতে, মানুষ শুধু সেটাই দান করতে পারে, যার মালিকত্ব তার আছে৷ কিন্তু মানুষ নিজের শরীরের মালিক নয়, বরং এর মালিক তার সৃষ্টিকর্তা৷''
তবে মৃতদেহ নিয়ে কী করা হবে, তা নিয়ে ধর্মের কোথাও সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়নি৷ জানিয়েছেন ইসলাম ধর্মতত্ত্বের প্রফেসর সাইম ইয়েপ্রেম৷ ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী কোথাও পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা না থাকলে তা অনুমোদনযোগ্য৷ এই নীতি সম্পর্কে যাদের কোনো ধারণা নেই, তারা অঙ্গদানের ব্যাপারেও দ্বিধায় পড়েন৷ এ কারণে মানুষকে সঠিক তথ্য দিতে হবে৷ প্রফেসর ইয়েপ্রেমের ভাষায়, ‘‘সমাজ যদি মানুষকে সচেতন করে তুলতে পারে, বুদ্ধিদীপ্ত ধর্মবিদ ও শিক্ষাবিদরা মানুষের চোখ খুলতে পারেন, তাহলে অঙ্গদানের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে৷''
কেননা বহু ইসলামি দেশেই অঙ্গদান অনুমোদিত ও বাস্তবায়িতও হচ্ছে৷ এক্ষেত্রে আইনগত ও পারিপার্শ্বিক কিছু বিষয় বিবেচনা করতে হবে বলে মনে করেন প্রফেসর ইয়েপ্রেম৷ তিনি বলেন, ‘‘অঙ্গদানকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা চলবেনা৷ নৈতিক বিধি বিধান ও ইসলামের মৌলনীতির বিরুদ্ধে যাওয়া যাবেনা৷’’
অঙ্গদানের ব্যাপারে আলেমদের ঐক্যমত
২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত ইসলামবিশারদদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা অঙ্গদানের ব্যাপারে মতৈক্যে পৌঁছন৷ তাঁরা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া ও মস্তিষ্কের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া এই দুই অবস্থাকেই মৃত্যু বলে মনে করেন৷ এ ছাড়া তাঁরা অঙ্গদানকে মৃতের প্রতি অসম্মান বলে মনে করেননা৷ বরং অঙ্গদান অন্যের প্রতি সহানুভূতিরই পরিচায়ক৷ স্বাস্থ্যের ক্ষতি না হলে জীবিত মানুষও অঙ্গদান করতে পারে৷
সেই ৫০-এর দশকেই ইসলামি দেশগুলিতে অঙ্গদানের ব্যাপারে আলোচনা শুরু হয়েছিল৷ বলেন মোহাম্মদ ঘালি৷ এ বিষয়ে দেশভেদে তারতম্যও রয়েছে৷ ইসলামবিদ ঘালির ভষায়, ‘‘আমার ধারণা দক্ষিণ এশীয় দেশগুলি অঙ্গদানকে কিছুটা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে, যেমনটি লক্ষ্য করা যায় পাকিস্তান ও ভারতে৷ এ সব দেশে কিছু কিছু ফতোয়ায় অঙ্গদান নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ এ ব্যাপারে আলোচনার ভিতটাও খুব শক্ত নয়৷ সৌদি আরবে কিন্তু অঙ্গদান বেশ প্রচলিত৷'' ঘালি জানান, ‘‘এদিক দিয়ে দেখলে সৌদি আরবকে ইসলামি দেশগুলির মধ্যে সবচেয়ে আধুনিক বলা যায়৷ দেশটি অঙ্গদানকে বৈধতা দিয়েছে৷ ৭০ ও ৮০ -এর দশকে ফতোয়ার মাধ্যমে অনুমোদন দেয়া হয় বিষয়টিকে৷ পরে এটির বাস্তবায়নও করা হয়৷''
এর ফলাফল আজ চোখে পড়ে৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডাব্লিউএইচও-র তথ্য অনুযায়ী গত কয়েক বছরে দেশটিতে অঙ্গদান ও অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে৷ বহু মানুষের জীবনও রক্ষা পাচ্ছে এতে৷
বাংলাদেশে অঙ্গদান
‘মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন, ১৯৯৯' নামে বাংলাদেশের আইনটিতে বলা হয়েছে, অসুস্থ ব্যক্তিকে তাঁর নিকট আত্মীয়রা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান করতে পারবেন৷ তবে বাংলাদেশে মৃত ব্যক্তিদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার৷ কেননা, মৃত্যুর আগে কেউ তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানের অঙ্গীকার করলেও মারা যাওয়ার পর তাঁর স্বজনরা এ ব্যাপারে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আগ্রহী হননা৷ এ ছাড়া এই ব্যাপারটি নিয়ে তেমন মাথাও ঘামানো হয়না৷ তাই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের সুস্থ লিভার বা কিডনি সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না৷ বাংলাদেশে ১৯৮২ সালে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয়৷ তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জীবিত ব্যক্তিদের দান করা কিডনিই ব্যবহৃত হচ্ছে৷
প্রতিবেদন: রায়হানা বেগম
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক