ইসলাম বিদ্বেষ
২২ আগস্ট ২০১৩‘‘আমাকে বেশ কয়েকবার আক্রমণ করা হয়, মারা হয় ঘুসি৷ এমনকি মুখে থুথু ছিটিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলেও দেয়া হয়৷'' এভাবেই বলছিলেন একজন মহিলা, যিনি নিজের পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক৷ ‘‘শুধু তাই নয়, আমাকে নৃশংসভাবে মাথায় আঘাত করা হয় এবং আমার স্বামী ও আমার ছোট ছেলের চোখের সামনে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়া হয়৷ তখন আমি ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম৷''
ব্রিটিশ সাহায্যসংস্থা ‘টেল মামা'-র ইন্টারনেট পাতার ভিডিও ফিল্মে এভাবেই বর্ণনা করেছেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা মাথায় হিজাব পরা একজন নারী৷ ‘টেল মামা', মানে ‘মাকে বলুন' মনে রাখার মতো একটা নাম৷ এই সংস্থাকে মায়ের মতো বিশ্বাস করে ইসলাম বিদ্বেষী সব ঘটনার কথা খুলে বলা যায়৷ সহজ করে বলতে গেলে, মুসলিম হওয়ার কারণে যাঁরা রাস্তাঘাটে বা ইন্টারনেটে আক্রমণের শিকার হন, তাঁদের অভিজ্ঞতা নথিভুক্ত করার জন্যই এই সংস্থাটি তৈরি করা হয়েছে৷ তবে যাঁরা ইন্টারনেটে ইসলাম বিদ্বেষী আক্রমণের শিকার হন, তাঁরা অবশ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজেরাই এসএমএস-এর মাধ্যমে সেসব ঘটনার কথা জানিয়ে থাকেন৷
‘টেল মামা' সংস্থাটি সেচ্ছাসেবীদের নিয়ে কাজ করছে ২০১২ সাল থেকে৷ এটি গড়ে তোলা হয়েছে আন্তর্ধর্মীয় ফাউন্ডেশনের সহায়তায়৷ এই সংস্থার পরিচালক ফিয়াজ মুঘল জানান, গত ১৮ মাসে ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে সংঘটিত ইসলাম বিরোধী ১২০০টি ঘটনার কথা তারা রেজিস্ট্রি করেছে৷ ফিয়াজ মুঘল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের সমীক্ষায় একটি ব্যাপার খুবই স্পষ্ট যে এ ধরণের ঘটনা দিনদিনই বাড়ছে৷ উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, এ বছরের ২২শে মে একজন ব্রিটিশ সৈন্যকে দু'জন ইসলামপন্থি নৃশংসভাবে হত্যা করার পর, সেখানার মসজিদে এ ধরনের আক্রমণের ঘটনা ৮গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল৷
ফেসবুক এবং টুইটারে ইসলাম বিরোধী মন্তব্য
ফিয়াজ মুঘল বলেন, ইসলাম বিদ্বেষী ঘটনা রাস্তায় তেমন ঘটে না৷ তাই শুধু তা দিয়ে বিচার করলে হবে না৷ ইন্টারনেটের হিসেব দেখতে হবে৷ তিনি বলেন, মুসলমান মহিলারা যাঁরা হিজাব পরেন বা মাথায় ঘোমটা দিয়ে চলেন, তাঁদের ফেসবুক, টুইটার বা অন্যান্য সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আক্রমণ বা অপমান করা হয়৷ মুঘল বলেন, এমনকি তাঁদের হত্যা করার হুমকি দেওয়ার ঘটনাও আছে৷ ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নানা রকম ভয়াবহ কাজ হচ্ছে৷ ইসলাম বিদ্বেষীরা অনলাইনে খুবই সংঘবদ্ধভাবে গুছিয়ে কাজ করেন যাতে সাধারণ মানুষ সরাসরি তা বুঝতে না পারে৷ এঁদের বেশিরভাগই হলেন চরম দক্ষিণপন্থি, মুসলমান বিদ্বেষী এবং ইসলামকে যাঁরা ঘৃণা করেন বা একেবারেই পছন্দ করেন না৷ এই যএমন, ব্রিটেনের মতো দেশেও চরম দক্ষিণপন্থি নেটওয়ার্ক ‘ইংলিশ ডিফেন্স লিগ' ইন্টারনেটে ইসলাম বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত৷
তবে শুধু ইংল্যান্ডেই নয়, ফ্রান্সেও মুসলিমদের ওপর আক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে, জানালেন ‘প্যান-ইউরোপিয়ান প্রোগ্রাম ফর ইসলামোফোবি ইন ইউরোপ' বা ইসলাম বিদ্বেষ বিষয়ক আন্তঃইউরোপীয় সংগঠনের কর্মকর্তা এলসা রে৷ তিনি বলেন, ‘‘গত জুন মাসে একজন অন্তঃসত্ত্বা মুসলমান নারীর ওপর দু'জন পুরুষ যৌন নিগ্রহ করে৷ এরপর অবশ্য সেখানে বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত মুসলিম তরুণরা বিক্ষোভ করেছিল৷
এলসা রে এবং তাঁর সংগঠন ফ্রান্স এবং ইউরোপের রাজনীতিকদেরই এর জন্য দায়ী করে৷ এলসার সাফ কথা: তাঁরা এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না এবং ইসলাম বিরোধী তৎপরতার ঘটনাকে মেনে নিচ্ছেন বলেই মনে হয়৷ স্বাভাবিকভাবেই, ফ্রান্সে হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা নিয়ে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল, তা জনগণের উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে৷
ইউরোপে এহেন তৎপরতার সঠিক সংখ্যা নেই
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সেই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি ইসলাম বিদ্বেষের ঘটনা ঘটছে৷ তবে এ বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায়নি৷ বলেন মৌলিক অধিকার বিষয়ক একটি ইউরোপীয় এজেন্সির কাটিয়া অ্যান্ড্রুস৷ তিনি ডয়চে ভেলকে বলেন, তাঁর সংস্থা বহুদিন থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশের সরকারের প্রতি আবেদন জানিয়েছে ইসলাম বিদ্বেষী ঘটনার তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশের জন্য৷
জার্মানিতেও ইসলাম বিরোধী তৎপরতার কোনো হিসেব রাখা হয় না এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো সংস্থাকেও আলাদাভাবে জানানো হয় না৷ সম্প্রতি জার্মনিতে অপরাধ তৎপরতা বিষয়ক এক কর্মকর্তা ভিলভ্রিড আলবিসহাউসেন মুসলিম বিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য একটি বিশেষ নিবন্ধন খোলার আহ্বান জানান৷
ইন্টারনেটে সংঘটিত ঘটনা সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন
যাঁরা ইন্টারনেটে বিভিন্ন আক্রমণাত্বক ঘটনার শিকার হন, তাঁদের সবাই সেসব ঘটনা অন্যদের জানান না৷ আনুমানিক ৬০ শতাংশ মানুষ কোনো সাহায্য সংস্থা বা পুলিশকে জানায় না তাঁদের এ ধরণের অভিজ্ঞতার কথা, এ অনুমান ‘টেল মামা' সংস্থার৷ অস্ট্রিয়ায় মুসলিমদের মধ্যে ইউরোপীয় সংস্থার পরিচালিত একটি সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে যে, বেশিরভাগ মুসলমানই তাঁদের ওপর আক্রমণের ঘটনা সম্পর্কে নিরব থাকেন৷ আর সেজন্যই এর সঠিক হিসেব রাখা সম্ভন হয় না৷ ইউরোপীয় ইউনিয়েনের মৌলিক অধিকার বিষয়ক সংস্থার কাটিয়া অ্যান্ড্রুস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘টেল মামা'-র এক ভিডিও ফিল্মে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মুসলিম নারী আবেদন করেছেন, ‘‘পরাজয় কোনোভাবেই মেনে নিও না৷ আমি বাচ্চা বয়সে এই পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলাম, তাই আমি চাই না যে, আমার সন্তানদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক৷''
ইসলাম বিদ্বেষের ঘটনা রাস্তায় বা ইন্টারনেটে, যেখানেই ঘটুক না কেন ‘টেল মামা' সংস্থাটি পুলিশকে তা জানিয়ে দেয়৷ ব্রিটেনের পুলিশ বিভাগ এ ব্যাপারে জানে, বলেন সংস্থার পরিচালক ফিয়াজ মুঘল৷ তবে ইন্টারনেটে করা অপরাধের বিচার বা তদন্ত কোনোটাই সেভাবে করা হয় না৷ বেশিরভাগই শুধু প্রতীকী বা দেখানোর জন্য৷ সেটাও আবার শুধুমাত্র যদি কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি আগ্রহ দেখায় – যা পুরোপুরি ভুল, বলেন ফিয়াজ৷ কারণ যাঁরা টুইটারে অপমানিত হন, তাঁরা সাধারণ ইউজার, তাঁরা কিন্তু কোনো ফুটবল তারকা নন!