বড়দিন শেষ৷ আর তার অর্থ, পুবের ড্রেসডেন শহরে প্রতি সোমবার আবার ‘পেগিডা' গোষ্ঠীর ইসলাম ও অভিবাসন বিরোধী ব়্যালি শুরু হতে চলেছে৷ বার্লিন, কোলোন কিংবা স্টুটগার্টে কিন্তু পেগিডা-বিরোধীদের সংখ্যা অনেক বেশি৷
বিজ্ঞাপন
‘পেগিডা' নামটি যে জার্মান শব্দগুলির আদ্যক্ষর মিলিয়ে, তাদের অর্থ দাঁড়ায়: প্রতীচ্যের ইসলামীকরণের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমী ইউরোপীয়বৃন্দ৷ গতবছরের অক্টোবর মাসে মাত্র শ'খানেক সমর্থক নিয়ে এই তৃণমূল আন্দোলনটি শুরু হয়৷ সে'যাবৎ তা শুধু ড্রেসডেনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, জার্মানির অন্যান্য বড় শহরেও দানা বাঁধার চেষ্টা করছে৷
বড়দিনের আগে ড্রেসডেনে পেগিডা সমর্থকরা যে ব়্যালি করেন, তাতে যোগ দিয়েছিলেন সাড়ে ১৭ হাজার মানুষ৷ এই সোমবার পেগিডার হয়ে ড্রেসডেনে পথে নামেন ১৮ হাজার৷ কিন্তু জার্মানির বাদবাকি শহরে যে পেগিডা বিরোধী স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়, তা অনেক বেশি নজর কেড়েছে৷
রাজধানী বার্লিনে শ'তিনেক পেগিডা সমর্থক পৌর ভবন থেকে ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণ অবধি মিছিল করতে গিয়ে ব্যর্থ হন, কেননা হাজার পাঁচেক পেগিডা বিরোধী তাদের পথ অবরোধ করেন৷ পশ্চিমের কোলোন শহরে আড়াই'শ পেগিডা সমর্থক রেলওয়ে স্টেশন থেকে শহরের প্রখ্যাত ক্যাথিড্রাল অবধি মিছিল করতে চেয়েছিল, কিন্তু আড়াই হাজার পেগিডা বিরোধী আন্দোলনকারীদের সম্মুখীন হয়ে তাদের সে পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়৷ ওদিকে দক্ষিণের স্টুটগার্ট, মধ্য জার্মানির ম্যুনস্টার এবং উত্তরের হামবুর্গ শহর মিলিয়ে মোট ২২ হাজার পেগিডা বিরোধী পথে নামেন৷ এই সোমবার ড্রেসডেনে পেগিডা বিরোধী আন্দোলনকারীদের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়ায়নি৷ কাজেই সব মিলিয়ে ড্রেসডেনে পেগিডার সাফল্যের পাশাপাশি বাকি জার্মানিতে পেগিডা বিরোধীদের লক্ষণীয় উপস্থিতিকে রাখতে হবে৷
জার্মানিতে জঙ্গিবাদ
তারা তরুণ, ধর্মান্ধ এবং জান্নাতে যেতে চায়৷ জার্মানিতে এমন প্রায় ৫০০ ইসলামি জঙ্গি আছে যারা যে-কোনো ধরনের সহিংস কর্মকাণ্ডের জন্য প্রস্তুত বলে জানিয়েছে নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ৷ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ বিষয়টি বেশ ভাবিয়ে তুলেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Boris Roessler
ব়্যাপার থেকে জিহাদি
ডেনিশ কুসপার্ট এর বাবা জার্মান এবং মা ঘানার৷ তাঁর জন্ম ১৯৭৫ সালে বার্লিনে৷ ইসলামিক স্টেটের অন্যতম জিহাদিস্ট এই ব়্যাপার ডেসো নামেও পরিচিত৷ ২০১২ সালের শেষ থেকে সিরিয়ায় আছেন কুসপার্ট৷ তার লক্ষ্য হলো জার্মানির সালাফিস্টদের জিহাদি হওয়ার পথে নিয়ে যাওয়া৷ চলতি মাসের প্রথম দিকে শিরশ্ছেদের নতুন ভিডিওতে দেখা গেছে তাকে৷ জার্মান সরকার জাতিসংঘের সন্ত্রাসী তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত করার ইচ্ছের কথা জানিয়েছে৷
ছবি: twitter.com
শরিয়া পুলিশ
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ভুপার্টাল শহরের রাস্তায় রাস্তায় এদের দেখা যায়৷ মুসলিম তরুণরা যাতে জুয়া না খেলে, মদ না খায় এবং গান না শোনে তার নির্দেশ দেয় তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/O. Berg
অভিবাসী জঙ্গি
জার্মানিতে অন্তত কয়েক হাজার ইসলামপন্থি রয়েছে, যাদের মধ্যে কয়েকশ জনকে জঙ্গি হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ অনেকেই অভিবাসীদের সন্তান, যারা জার্মানিতে এসে একই সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে একতাবদ্ধ হতে গিয়ে এমন জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে৷ আর কিছু আছে যারা ধর্মান্তরিত হয়ে এ পথে এগিয়ে যান৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নাইন ইলেভেন হামলা
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে যে সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়েছিল, তার একটা অংশের পরিকল্পনা হয়েছিল জার্মানির হামবুর্গে৷ নাইন ইলেভেন হামলার সঙ্গে জড়িত চার পাইলটের তিনজন সহ আরও ছয় ব্যক্তি হামবুর্গের একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন৷ ছবিতে উপরে মাঝখানে যিনি আছেন তিনি আত্মঘাতী বিমান চালক মো. আত্তা৷ নীচে বামদিকে যাকে দেখা যাচ্ছে তিনি মুনীর এল-মোতাস্সাদেক, যাকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/lno
সুটকেস বোমা
২০০৬ সালে লেবাননের শিক্ষার্থী জিহাদ হামাদ এবং ইউসুফ আল হাজদিব কোলন শহর থেকে হাম ও কোবলেনৎস শহরে যাওয়ার দুটি ট্রেনে সুটকেস বোমা হামলার পরিকল্পনা করেছিল৷ তবে সেটা ব্যর্থ হয়েছিল৷ হামাদকে এখন বৈরুতে ১২ বছর জেল খাটতে হচ্ছে৷ আর আল হাজদিব জার্মানিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছে৷
ছবি: AP
সারল্যান্ড সেল
২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে নর্থ রাইন ভেস্টফালিয়া রাজ্য থেকে তিন ব্যক্তিকে আটক করা হয়৷ তারা আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে জার্মান ও মার্কিন সামরিক স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা করছিল৷ এদের ১২ বছর ধরে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে৷
২০১১ সালের মার্চে আরিদ উকা নামে এক জঙ্গি ফ্রাংকফুর্ট বিমানবন্দরে গুলি চালিয়ে দুই মার্কিন সেনাকে হত্যা করে এবং হামলায় আরো দুই জন গুরুতর আহত হয়৷ উকার জন্ম কসোভোতে, সে বেড়ে উঠেছে জার্মানিতে৷ ফেসবুকে সে নিজেকে একজন ‘জিহাদিস্ট’ বলে উল্লেখ করেছে৷
ছবি: picture alliance / dpa
ড্যুসেলডর্ফের আল কায়েদা সেল
হালিল এ (মাঝে) কে আদালতে হাজির করা হয়েছিল ২০১১ সালের ডিসেম্বরে৷ অভিযোগ ড্যুসেলডর্ফের সন্ত্রাসী সেলের সঙ্গে যুক্ত তিনি৷ এই সেলের এক সদস্যের দাবি তিনি কোনো এক সময় আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের দেহরক্ষী ছিলেন৷ এই সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কটি জার্মানির বেশ কয়েক জায়গায় বড় আকারের সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা করছিল৷ তবে ঐ সেলের চার সদস্যই এখন কারাগারে বন্দি৷
ছবি: dapd
সালাফিস্ট
জার্মানিতে সালাফিস্টদের সংখ্যা বাড়ছে৷ বর্তমানে এদের সংখ্যা অন্তত ৭,০০০ বলে ধারণা করা হয়৷ ২০১১ সালের অক্টোবর থেকে তারা ইসলাম প্রচারের অংশ হিসেবে জার্মান ভাষায় অনুদিত কোরআন শরীফ বিনামূল্যে বিতরণ করে আসছে৷ তাদের লক্ষ্য আড়াই কোটি কোরআন বিতরণ৷ তবে সালাফিস্টদের মধ্যে আগ্রাসী মনোভাব কম৷ প্রায় ৫০০ সালাফিস্ট সিরিয়া এবং ইরাকের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ঘুরে এসেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Britta Pedersen
বন শহরে হামলা
২০১২ সালের ডিসেম্বরে বন এর কেন্দ্রীয় রেলস্টেশনে একটি নীল রং এর ব্যাগে বোমা পাওয়া গিয়েছিল৷ এই হামলার পেছনে মার্কো জি এর হাত ছিল বলে জানা গেছে৷ ওলডেনব্যুর্গ এ বেড়ে ওঠা মার্কো ধর্ম পরিবর্তন করে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আইএস
২০১৩ সালের জুলাইতে সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটে যোগ দিতে সিরিয়া গিয়েছিলেন ক্রেসনিক বি৷ জার্মানিতে ফেরার সময় বিমানবন্দরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ দোষ প্রমাণিত হলে তার অন্তত চার বছরের কারাদণ্ড হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Boris Roessler
11 ছবি1 | 11
জার্মানির রাজনৈতিক মহল, গির্জার কর্মকর্তা, সাংস্কৃতিক জীবনের প্রতিনিধি, সকলেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, তাঁরা এই দেশকে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখতে চান, বিদেশি-বহিরাগতদের স্বাগত জানাতে চান৷ চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল স্বয়ং তাঁর নববর্ষের ভাষণে জাতিবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছেন৷ ম্যার্কেল মন্ত্রীসভার সামজিক গণতন্ত্রী আইনমন্ত্রী হাইকো মাস স্বয়ং বার্লিনে পেগিডা বিরোধী মিছিলে অংশ নিয়েছেন৷ এমনকি জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে টুইট করা হয়েছে ‘‘(জার্মানিতে) বহিরাগত-বিদ্বেষি প্ররোচনার কোনো স্থান নেই''৷
ড্রেসডেন যে স্যাক্সনি রাজ্যের রাজধানী, সেখানে মুসলিমদের সংখ্যা চার শতাংশের বেশি নয়; স্যাক্সনি কিংবা পুবের কোনো রাজ্যেই অভিবাসী, বহিরাগত নিয়ে বড় কোনো সমস্যা নেই৷ অথচ ঠিক সেখানেই এই পেগিডা আন্দোলন জন্ম নিয়েছে৷ এর অনেক কারণ থাকতে পারে, কিন্তু ‘‘স্টের্ন'' সাপ্তাহিকের একটি সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী জার্মানির ৩০ শতাংশ মানুষ মনে করেন যে, জার্মান জনজীবনে ইসলামের প্রভাব এতোই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, পেগিডার প্রতিবাদ মিছিল এক হিসেবে যৌক্তিক বলা যেতে পারে৷
এই বিচারে পেগিডা আন্দোলন ও পেগিডা বিরোধী আন্দোলন এখন জার্মানদের আত্মানুসন্ধান ও আত্মদর্শনের বহির্প্রকাশ বলে গণ্য হতে পারে, এমন একটি প্রক্রিয়া, যার অভিব্যক্তি অনেক ক্ষেত্রেই প্রতীকী: সোমবার কোলোনের গথিক ক্যাথিড্রাল, পৌর ভবন ইত্যাদি ঐতিহাসিক স্থাপত্যের বাইরের আলোকসজ্জা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল৷ বার্লিনের ব্রান্ডেনবুর্গ তোরণের আলোকসজ্জাও বন্ধ করে দেওয়া হয়৷ এ সবই খোদ ড্রেসডেনের প্রখ্যাত সেম্পার অপেরা হাউসের অনুকরণে৷ অতীতে অপেরা হাউসের সামনে পেগিডা সমাবেশ চলাকালীন অপেরা ভবনের আলোকসজ্জা বন্ধ করে তার পরিবর্তে অভিবাসন তথা বহিরাগতদের প্রতি সহানুভূতিশীল আলোকলিখন দেখানো হয়েছিল৷