একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, আরবিভাষী এক ব্যক্তি ইহুদিদের বিশেষ টুপি ‘কিপা' পরা এক তরুণকে বেদম পেটাচ্ছে৷ বার্লিনে দিবালোকে ঘটেছে এ ঘটনা৷ বিষয়টিতে বড় রকমের উদ্বেগের কারণ দেখছেন ডয়চে ভেলের এডিটর-ইন-চিফ ইনেস পোল৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানিতে ইহুদিবিদ্বেষ প্রকাশের ভিডিও তৈরি করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়া যেন সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ একটি ভিডিওতে ইসরায়েলের পতাকা পোড়াতে দেখা গিয়েছিল৷ আরেকটিতে দেখা গিয়েছিল এক ইহুদি রেস্তোরাঁ মালিককে অকথ্য গালাগাল করছেন একজন৷ গ্যাস চেম্বারের প্রসঙ্গও উঠে এসেছিল ইহুদিবিদ্বেষী ব্যক্তির বিষোদগারে৷ প্রত্যেকটি ঘটনার পর প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ ইহুদিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাধ্যমতো চেষ্টা করার অঙ্গীকার শোনা যায় রাজনীতিবিদদের মুখে৷ ইতিহাসের নজীর, দায়িত্ব ইত্যাদি প্রসঙ্গ তুলে আনেন তাঁরা৷ গঠন করেন নতুন নতুন কমিশন৷ শিক্ষা সংক্রান্ত উদ্যোগ গ্রহণের কথাও বলেন৷ আলোচনায় এ দেশ যে বহু আগে থেকেই নিজেকে ‘অভিবাসীদের দেশ' হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছে এবং এ দেশকে যে অনেক জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়, সে ব্যাপারেও অনেক কথা বলেন তাঁরা৷
ঘৃণা প্রকাশ যেন অধিকার
শুধু বাস্তবসম্মত কিছু কথাই যে এ ধরনের ঘৃণা থামানোর জন্য যথেষ্ট নয় সাম্প্রতিকতম ভিডিওটি তারই প্রমাণ৷ বার্লিনের বুকে দিনের আলোয় এক আরব যুবক কী অনায়াসে কিপা পরা একজনকে পেটালো! নিজের বেল্ট খুলে পেটাতে শুরু করার সময় দেখা গেছে তরুণটির চেহারা শীতল ঘৃণায় পরিপূর্ণ৷ মুখ ঢাকেনি সে৷ সে জানতো, ভিডিও করা হচ্ছে৷ যাকে পেটানো হলো সে কিন্তু মুখের সামনে সেলফোন ধরে বারবার বলেছে, ‘‘আমি ভিডিও করছি, আমি ভিডিও করছি৷''
জার্মানি আসলে কোন পথে যাচ্ছে? এই ভিডিওই প্রমাণ করে যে, খুব শিগগিরই জার্মান সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার নতুন পথ খুঁজে নেয়া দরকার৷ মনে হয়, রেওয়াজমাফিক যে সাজা দেয়া হচ্ছে, তা কাজে আসছে না৷
আমরা এখন কী অবস্থায় দাঁড়িয়ে তা বোঝার জন্য বরং জার্মানির স্কুলগুলোর দিকে নজর দেয়া যেতে পারে৷ অনেক বাচ্চা যে সবসময় একে-অন্যকে ‘ইহুদি' বলে গালাগাল দেয়, শিক্ষকরা সে বিষয়ে সচেতন করার চেষ্টা বছরের পর বছর ধরে চালিয়ে আসছেন৷ ব়্যাপ সংগীতের কথাতেও আমরা ইহুদিবিদ্বেষ দেখেছি৷ এ সব কি মেনে নেয়ার মতো?
জার্মানি কি সত্যিই তার মূল্যবোধ, তার স্বাধীনতার জন্য লড়তে চায়? এটা ভাবা ঠিক নয় যে, ধর্ম পরিচয় প্রকাশ পেলেই জার্মানির রাস্তাঘাটে আক্রমণের শিকার হতে হবে আর ইহুদিরা তা মেনে নেবে৷ জার্মানি এমন এক বিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে যেখান থেকে তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সে তার মূল্যবোধ এবং স্বাধীনতার জন্য দ্ব্যর্থহীনভাবে লড়তে চায় কিনা৷
ইসরায়েলের স্বাধীনতার ৭০ বছর: প্রতিশ্রুত ভূমি, নাকি শত্রুভূমি?
হিব্রু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সত্তর বছর আগে ঠিক এ সময়েই ইসরায়েল রাষ্ট্র হিসেবে তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল৷ ইউরোপে গণহত্যার শিকারের পর ইহুদিদের জন্য সেই রাষ্ট্র গঠন ঘুরে দাঁড়ানোর একটি পদক্ষেপ৷ দেখা যাক ইসরায়েলের ৭০ বছর...
ছবি: picture-alliance/dpa/akg-images
বহুল প্রতীক্ষিত জয়
১৯৪৮ সালের মে মাসের এই ছবিতে ডেভিড বেন-গুরিয়ানকে ইসরায়েলের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে দেখা যাচ্ছে৷ এসময় তিনি বলছেন, এ পুণ্যভূমির প্রতি মানুষের সবসময় আকুতি ছিল এবং কখনোই তাঁরা রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে এই ভূমিতে ফিরে আসার আশা ছাড়েননি৷ এটিই বিশ্বের প্রথম আন্তর্জাতিক ইহুদি রাষ্ট্রের সূচনালগ্ন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অন্ধকারতম সময়
বাইবেল অনুযায়ী, ইহুদিদের বিতর্কিত দাবি হচ্ছে, ‘ঈশ্বর তাদের একটি পবিত্রভূমি’ বরাদ্দ করেছেন৷ ইউরোপজুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ৬০ লাখ ইহুদি গণহত্যার শিকার হলে নিজস্ব ভূমির যৌক্তিকতা শক্ত হয় ইহুদিদের৷ যাঁরা বেঁচে ছিলেন তাঁদেরকে নিয়ে যাওয়া হয় কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে৷ চালানো হয় নিপীড়ণ আর জোর করে কাজ করানো হয়৷ উপরের ছবিটি আউসভিৎস ক্যাম্পে থাকা জীবিতদের৷
ছবি: picture-alliance/dpa/akg-images
‘নাকবা’ বা আকস্মিক বিপর্যয়
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকামীরা ইহুদিদের ইউরোপ থেকে আগমনকে নাকবা বা বিপর্যয় বলে চিহ্নিত করে৷ ইহুদিরা যখন প্যালেস্টাইনে বসতির জন্য আসে, তখন সেখানকার জনসংখ্যা ছিল ৭ লাখ৷ বিপুল সংখ্যক ইহুদির আগমনে এক ধরনের বিপর্যয় তৈরি হয়৷
ছবি: picture-alliance/CPA Media
কিব্বুজ
শুরুতে বসতি স্থাপনের পর ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনে যৌথ খামার বা কমিউনিটি গড়ে বসবাস শুরু করে৷ এসব কমিউনিটিকে তাঁরা কিব্বুজ বলতেন৷ কিব্বুজগুলোর অনেকগুলোই সেকুল্যার বা সোশ্যালিস্ট মনোভাবাপন্ন ইহুদিদের দ্বারা পরিচালিত হতো, যাতে সমাজ সম্পর্কে ইহুদি জনগোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বচ্ছতা গড়ে ওঠে৷
ছবি: G. Pickow/Three Lions/Hulton Archive/Getty Images
যুদ্ধ
১৯৬৭ সালের জুনে প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর সাথে ছয় দিনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ইসরায়েল৷ যুদ্ধে আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে তারা মিশর, জর্ডান এবং সিরিয়ার বাহিনীকে পরাজিত করে সিনাই উপত্যকা, গাজা উপত্যকা, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুসালেম এবং গোলান হাইটস নিজেদের কব্জায় নিয়ে নেয়৷ এই জয় ইহুদি বসতি গড়ায় সহায়তা করে, আর মধ্যপ্রাচ্যে ছড়ায় উৎকণ্ঠা৷
ছবি: Keystone/ZUMA/IMAGO
বিতর্কিত বসতি
ভূমি মালিকানা নিয়ে ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের বিরোধপূর্ণ এলাকাগুলোতে আন্তর্জাতিক সব চাপ অগ্রাহ্য করে ইহুদি বসতি স্থাপন করা হতে থাকে৷ বসতি স্থাপনের সময় জায়গাটিকে হয় তারা নিজেদের বলে দাবি করেছে, নতুবা বলেছে নিরাপত্তার খাতিরে বসতি স্থাপন করা হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/newscom/D. Hill
ইন্তিফাদা
নিজভূমিতে ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে ১৯৮৭ সালে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু করে ফিলিস্তিনিরা৷ এটি প্রথম ইন্তিফাদা হিসেবে পরিচিত৷ ১৯৮৭ সালে থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ওই ইন্তিফাদা চলে৷ এরপর ইসরায়েল সরকার এবং ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-র মধ্যে অসলো চুক্তি স্বাক্ষর হয়৷
ছবি: picture-alliance/AFP/E. Baitel
অবশেষে শান্তি!
সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটনের সময় আরব ও ইসরায়েল শান্তি চুক্তি হয়৷ তাতে দুই দেশ একই অপরকে স্বীকৃতি দেয়৷ ইসরায়েলের পক্ষে আইজাক রবিন এবং পিএলও-র পক্ষে ইয়াসির আরাফাত এতে স্বাক্ষর করেন৷ এই চুক্তির কারণে দুই বছর পর রবিন নিহত হন৷
ছবি: picture-alliance/CPA Media
ইসরায়েলে অন্তর্দ্বন্দ্ব
উগ্রপন্থিরা প্রধানমন্ত্রী রবিনকে হত্যা করে ১৯৯৫ সালে ৪ নভেম্বরে৷ সেসময় তিনি রাজধানী তেল আবিবের একটি শান্তি র্যালি থেকে বের হচ্ছিলেন৷ রবিনের হত্যার মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের ভেতরে উদারপন্থি, মধ্যপন্থি, চরমপন্থি ও ধার্মিক গোষ্ঠীর বিরোধ সামনে চলে আসে৷ রবিনের স্থলাভিষিক্ত হন সিমন পেরেস৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Delay
যা বলা হয়নি
২০০০ সালে জার্মান প্রেসিডেন্ট ইয়োহানেস রাউ ইসরায়েলি আইনসভার কাছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইহুদি গণহত্যার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন৷ যা দুই দেশের শিথিল সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দেয়
ছবি: picture-alliance/dpa
ইসরায়েলের দেয়াল
২০০২ সালে ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় গণবিক্ষোভ বা ইন্তিফাদার সময়ই ইসরায়েল পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি ও ফিলিস্তিনি বসতির মধ্যে ১০৭ কিলোমিটার লম্বা কাঁটাতার ও কংক্রিটের দেয়াল নির্মাণ করে৷ নিরাপত্তা ফাঁড়িও বসায় তারা৷ এটি সাময়িকভাবে সংঘাত থামালেও ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সম্পর্কে আরো দীর্ঘমেয়াদী ক্ষত তৈরি করে৷ বর্তমানে ইসরালের নিরাপত্তা বেষ্টনির দৈর্ঘ্য ৭০০ কিলোমিটারে ঠেকেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb/S. Nackstrand
মৃতদের প্রতি শ্রদ্ধা
জার্মানির বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাস এ বছরের মার্চে ইসরায়েল সফর করেন৷ জেরুসালেমে তিনি একটি গণহত্যা জাদুঘর পরিদর্শন করেন এবং গণহত্যার শিকার ইহুদিদের প্রতি সম্মান জানান৷ জার্মান-ইহুদি সম্পর্ক এর মধ্য দিয়ে অতীতের যে-কোনো সময়ের চেয়ে বেশি হৃদ্যতাপূর্ণ হয়৷