ইয়াংকিদের দেশে টি-টোয়েন্টির মহাযজ্ঞ
১ জুন ২০২৪কিন্তু সেই অভাবিত কাণ্ডটাই হয়ে যাচ্ছে এবার, ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততম সংস্করণ টি-টোয়েন্টির এবারের বিশ্বকাপ শুরু হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র-ক্যানাডার ম্যাচ দিয়ে। এবং সেটা যুক্তরাষ্ট্রেই।
বিস্ময়ের আরো উপাদান অবশ্য মজুত আছে। এক অর্থে যুক্তরাষ্ট্র-ক্যানাডার ম্যাচটা ক্রিকেটের আঁতুড়ঘরে ফিরে যাওয়ার। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রথম ম্যাচে যে মুখোমুখি হয়েছিল এই দুই দল! এই তথ্যে যদি অবাক হন, তাহলে আরো অবাক হবেন জেনে- এই দুই দলের মুখোমুখি ক্রিকেট ম্যাচটা সম্ভবত খেলাধূলায় যে কোনো দুই দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক দ্বৈরথও। সেই ১৮৪৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে যুক্তরাষ্ট্র ও ক্যানাডা খেলেছিল ক্রিকেট ম্যাচ। দুই দিন ধরে সেই ম্যাচ হওয়ার কথা থাকলেও বৃষ্টির কারণে গড়ায় তিন দিনে। পাঁচ হাজার দর্শক দেখেছিল প্রথম দিনের খেলা, শেষ পর্যন্ত সেই ম্যাচে জেতে ক্যানাডা। পরের বছর আবার দুই দল মুখোমুখি হয়। কিন্তু ব্রিটিশদের নিয়ে আসা এই ক্রিকেট পরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে হারিয়ে যায়৷ হারিয়ে গেল কীভাবে সেটা আরেক গল্প৷ অ্যামেরিকার গৃহযুদ্ধসহ আরো নানা কারণে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা হারিয়ে যায়, ক্রমশ সাধারণ অ্যামেরিকানদের কাছে ক্রিকেট হয়ে ওঠে ভিনগ্রহবাসীদের মতো অচেনা এক খেলা।
যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্য অনেক খেলায় সুপারপাওয়ার হলেও ক্রিকেটে একেবারে পুঁচকে, ক্যানাডার অবস্থাও তাই। এবারের বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে সহ-আয়োজক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের থাকাটা তাই নানান দিক দিয়ে অনেক বার্তা বহন করে। ক্রিকেটের বর্তমান বাস্তবতায় বিশ্বায়ন যখন সময়ের দাবি, যুক্তরাষ্ট্র হতে পারে খেলাটাকে ছড়িয়ে দেওয়ার বড় একটা চারণক্ষেত্র। নিউ ইয়র্ক, ডালাস আর ফ্লোরিডায় যে ক্রিকেটের হাওয়া লাগলো, ভারত-পাকিস্তানের মহাকাঙ্খিত দ্বৈরথ যে এবার নিউ ইয়র্কে হচ্ছে- সেটা তো বছর বিশেক আগেও অভাবিতই ছিল। অবশ্যই সেটার পেছনে বড় অবদান যুতরাষ্ট্রের প্রায় ৫০ লাখের কাছাকাছি দক্ষিণ এশিয়ার, বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের অভিবাসীদের। তাদের দুরন্ত আগ্রহেই ২০২৩ সালে আইপিএলের আদলে গঠিত হয় মেজর লিগ ক্রিকেট, সেখানে নাম লেখান বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় অনেক ক্রিকেটার। মাইক্রোসফট, অ্যাডোবের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভারতীয় বংশোদ্ভুত প্রধান নির্বাহীরাও বিনিয়োগ করেছেন এই মেজর লিগ ক্রিকেটে। যুক্তরাষ্ট্রে যে ক্রিকেটের সৌরভ একদিন ছড়াতে পারে, সেটা আসলে এই ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টেই বোঝা গেছে ভালোমতো।
যুক্তরাষ্ট্রের এই দলেও কিন্তু আছে দক্ষিণ এশিয়ার দাক্ষিণ্য। বাংলাদেশকে মাত্রই কাঁপিয়ে দেওয়া দলটির অধিনায়ক মোনাংক প্যাটেলের জন্ম ভারতের গুজরাটে। এই দলের পেস বোলিংয়ের পোস্টার বয় আলী খানের জন্ম আর বেড়ে ওঠা পাকিস্তানে৷ একটা সময় সেলসম্যান হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি শখে ক্রিকেট খেললেও এখন সিপিএলের নিয়মিত মুখ আলী খান। এর বাইরে শায়ান জাহাঙ্গীর, মিলিন্দ কুমার, হারমিত সিং বেড়ে উঠেছেন উপমহাদেশের আলো- বাতাসে। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলা বাঁহাতি স্পিনার হারমিতকে দেখে প্রয়াত ভারত স্পিনার বিষেন সিং বেদীর কথা মনে পড়ে গিয়েছিল সাবেক অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক ইয়ান চ্যাপেলের। তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই যুক্তরাষ্ট্রের একজনকে সবাই চেনেন, তিনি নিউজিল্যান্ডের সাবেক অলরাউন্ডার কোরি অ্যান্ডারসন। গত মাসেই নতুন দেশের হয়ে অভিষেক হয়েছে তার, একটা সময় ওয়ানডেতে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ডটা ছিল অ্যান্ডারসনেরই।
অ্যান্ডারসনরা বাংলাদেশকে হারিয়ে দেখিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র এই ফর্ম্যাটে চমকে দিতে পারে। ক্যানাডার ম্যাচে তারাই হয়ত ফেবারিট, তবে ভারত-পাকিস্তান তো বটেই, এই গ্রুপের অন্য দল আয়ারল্যান্ডকে হারিয়ে দিলেও সেটা হবে বড় আপসেট। এবারের টুর্নামেন্টে অবশ্য টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসেই সবচেয়ে বেশি ২০টি দল খেলছে। নেপাল, ওমান, নামিবিয়া, উগান্ডা, পাপুয়া নিউ গিনির মতো দলও আছে এবারের বিশ্বকাপে, যাদের অনেকের জন্যই এটাই প্রথমবারের মতো ক্রিকেটের কোনো বড় মঞ্চে নাম লেখানো। চারটি গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলবে এই ২০ দল, প্রতিটি গ্রুপের শীর্ষ দুই দল যাবে সুপার এইটে। সেখান থেকে শীর্ষ চার দলকে নিয়ে সেমিফাইনাল, এরপর ফাইনাল। নকআউটের ম্যাচগুলো সবই অবশ্য হবে ওয়েস্ট ইন্ডিজে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নিজেদের মাঠে খেলার এই সুবিধা পাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজও। টি-টোয়েন্টিটা ক্যারিবিয়ানরা উপভোগ করেন দারুণ। এই সংস্করণে যৌথ সর্বোচ্চ দুইটি বিশ্বকাপ তাদের, টি-টোয়েন্টির মারমার কাটকাট ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনও সম্ভবত তারা। রাসেল, হেটমেয়ার, পুরানদের নিয়ে এবারের দলটাও বেশ শক্তিশালী। বাংলাদেশের প্রথম টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক শাহরিয়ার নাফীস অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের সাথে তাদেরকেও ধরছেন ফেবারিট, ‘‘অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ আমার ফেবারিট। অস্ট্রেলিয়া খুবই ধারাবাহিক একটা দল, ইংল্যান্ড ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ নিজেদের মাঠে খেলবে। আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ যে নিজেদের মাঠে খেলার সুবিধা পাবে সেটা সর্বশেষ প্রস্তুতি ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েও বুঝিয়ে দিয়েছে।''
নাফীস অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের নাম বলেছেন, এবং এই দুই দলের পক্ষে বাজির ঘোড়াও ধরার অনেকেই থাকবেন। টি-টোয়েন্টির সর্বশেষ দুই চ্যাম্পিয়ন এই দুই দল। অস্ট্রেলিয়া আবার ৫০ ওভারের আর টেস্টেরও চ্যাম্পিয়ন এখন৷ তাদের অধিনায়ক প্যাট কামিন্স যেখানেই হাত দিচ্ছেন, সেখানেই যেন সোনা ফলছে। ম্যাক্সওয়েল, ওয়ার্নারদের সাথে কামিন্স, স্টার্কদের দারুণ বোলিং অ্যাটাক অস্ট্রেলিয়ার বড় শক্তি। আর বড় টুর্নামেন্টের অপ্রতিরোধ্য ‘অজি মানসিকতা' তো তাদের সবচেয়ে বড় ‘এক্স ফ্যাক্টর'।
ইংল্যান্ড ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন বলেই শুধু নয়, এবারের আসরের সবচেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ দলগুলোরও একটি। আইপিএল ফেরত একাধিক ইনফর্ম ক্রিকেটার আছেন জস বাটলারদের দলে, মাত্রই পাকিস্তানকে হারিয়ে বিশ্বকাপের আগে নিজেদের শক্তির মহড়া দিয়ে রেখেছে তারা।
ফেবারিটদের কাতারে ভারতের নাম এই দলগুলোর সাথেই আসা উচিত।কাগজে-কলমে রোহিত-কোহলিদের ভারত টুর্নামেন্টের অন্যতম সেরা, কিন্তু দীর্ঘ দশ বছরে কোনো আইসিসি টুর্নামেন্ট জিততে না পারার ভূত তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ইনফর্ম কোহলি-বুমরাহরা এবার সেটা দূর করতে চাইবেন যে কোনোভাবেই। পাকিস্তানকে অবশ্য চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের মতো কাগজে-কলমে নিরঙ্কুশ ফেবারিট ধরা যাচ্ছে না, টুর্নামেন্টের আগে খুব ছন্দেও নেই তারা। কিন্তু কোণঠাসা পাকিস্তান কতটা ভয়ংকর, সেটা টি-টোয়েন্টির সর্বশেষ বিশ্বকাপেও দেখা গিয়েছিল। জিম্বাবুয়ে ও ভারতের কাছে প্রথম দুই ম্যাচ হেরে খাদের কিনারায় গিয়েও শেষ পর্যন্ত ফাইনালে চলে গিয়েছিল পাকিস্তান।
এর বাইরে নিউজিল্যান্ড ও সাউথ আফ্রিকার নামটাও আসা উচিত। আইসিসির সাম্প্রতিক টুর্নামেন্টগুলোতে সবচেয়ে ধারাবাহিক দলগুলোর মধ্যে অন্যতম নিউজিল্যান্ড, যদিও শিরোপাটা কোনোভাবেই পাওয়া হচ্ছে না তাদের। কেন উইলিয়ামসনদের দলটা এবারও বেশ ভারসাম্যপূর্ণ, টি-টোয়েন্টির একাধিক ‘ম্যাচ উইনার' আছে তাদের। তবে শুধু ‘ম্যাচ উইনারদের' তালিকা করলে সাউথ আফ্রিকাকেও এগিয়ে রাখতে হবে অনেকের চেয়ে। ডেভিড মিলার, হেইনরিখ ক্লাসেন, কুইন্টন ডি কক- ব্যাটিংয়ে এঁদের যে কেউ নিজেদের দিনে ম্যাচ ঘুরিয়ে নিতে জানেন। সাথে কাগিসো রাবাদা, আইনরিখ নরকিয়াদের বোলিং তো আছেই। তবে ওই যে, নকআউটে আফ্রিকার চিরকালীন হোঁচটই সম্ভবত তাদের সবচেয়ে বড় জুজু।
বাংলাদেশের এমন কোনো জুজু নেই, তবে এই আসরের আগের নড়বড়ে প্রস্তুতির পর বোধ হয় বাড়তি কোনো জুজু দরকারও নেই তাদের। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে টানা দুই হারের পর সাউথ আফ্রিকা-শ্রীলঙ্কা তো বটেই, নেদারল্যান্ডস-নেপালের কাছেও বাংলাদেশের হারে বোধ হয় অনেকেই বিস্মিত হবেন না। তবে এমন হতশ্রী প্রস্তুতি, দিশেহারা টপ অর্ডারসহ আরও নানা সংকটেও বাংলাদেশের জন্য ভালো একটা দিক দেখছেন দৈনিক প্রথম আলোর ক্রীড়া সম্পাদক তারেক মাহমুদ, ‘‘বিশ্বকাপে আগে বাংলাদেশের এমন পারফরম্যান্স ক্রিকেটারদের নিজেদের সামর্থ্য নিয়ে একটা বাস্তব চিত্র তুলে ধরছে। এখন মিডিয়া, সমর্থক থেকে শুরু করে সবাই বুঝতে পেরেছে আমাদের সম্ভাবনা কম। আমার মনে হয় এই বাস্তবতা ক্রিকেটারদের ওপর থেকে চাপ অনেকটা কমিয়ে দেবে। এর আগে ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে আমরা ভ্রান্ত একটা প্রত্যাশা তৈরি করেছিলাম। কিন্তু পরে বিশ্বকাপে দেখা গেছে বাস্তবতা কী। এবার অন্তত সেই ভ্রান্ত প্রত্যাশাটা নেই। টি-টোয়েন্টির বাস্তবতায় আমরা অনেকটা পিছিয়ে আছি। এখনো আমাদের ওপেনিং দল নিয়ে সম্ভবত পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে, টপ অর্ডার থেকে শুরুতে রান হচ্ছে না যেটার চাপ পড়ছে মিডল ওভারে। এই সংকটগুলো একপাশে রেখে অলীক প্রত্যাশা তৈরি করা ঠিক না। এই বাস্তবতা আগেই বুঝে যাওয়ায় এখন ক্রিকেটাররা ‘হারানোর কিছু নেই' এই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে খেলতে পারবে। ''
আগের বাস্তবতা ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ধারাবাহিক ব্যর্থতার অতীত ইতিহাস বাংলাদেশ দলকে হয়তো খুব আশা দেবে না।তবে এক মাসের এই টি-টোয়েন্টির মহাযজ্ঞে বাংলাদেশ দল ছাড়াও থাকবে আরও নানান গল্পের রসদ।
ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য তাই সামনের এই মাস এই ক্রিকেটপাত্র থেকে সুধা গ্রহণের সময়, সেখানে বাংলাদেশ দল থাকুক আর নাই থাকুক।