শিশুমৃত্যুর ভয়াবহ এক মিছিল চলছে ইয়েমেনে৷ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সেভ দ্য চিলড্রেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি৷ হিসেব বলছে, এ বছরের শেষ নাগাদ আরব দেশটিতে শিশুমৃত্যু ৫০ হাজার ছাড়াবে৷
বিজ্ঞাপন
২০১৫ সাল থেকে ইয়েমেনে চলছে রাজনৈতিক অচলাবস্থা৷ চলছে যুদ্ধ৷ হুতি বিদ্রোহীরা রাজধানী সানার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পরই দেশটির ওপর সামরিক হস্তক্ষেপ শুরু করে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন আরব জোট৷ তারপর থেকে ধীরে ধীরে সংকট ঘণীভূত হতে হতে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সম্প্রতি জাতিসংঘ এবং ২০টিরও বেশি মানবাধিকার সংগঠন সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের প্রতি ইয়েমেনের বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর ও ভূমি থেকে অবরোধ প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়ে বলেছে, অবরোধ চলতে থাকলে কয়েক দশকের মধ্যে ভয়াবহতম দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হবে ইয়েমেন৷ দুর্ভিক্ষের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কাও প্রকাশ করা হয় ওই বিবৃতিতে৷
মৃত্যুর মিছিল অবশ্য আগে থেকেই চলছে৷ গত মাসে জাতিসংঘ জানায়, ২০১৬ সালে যুদ্ধের কারণে ইয়েমেনে নিহত হয়েছে ১,৩৪০ জন শিশু৷ এ জন্য সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটকে কালো তালিকাভুক্তও করা হয়৷
অন্তত হাসতে পারছে মেয়েটি
বয়স তার ১৮৷ কিন্তু ওজন মাত্র ১৬ কেজি৷ তাও গত দেড় মাসের চিকিৎসায় ওজন পাঁচ কেজি বেড়েছে বলে৷ ছবিঘরে থাকছে সাঈদা আহমেদ বাঘিলির কথা৷
ছবি: Reuters/K. Abdullah
অবশেষে মুখে হাসি
গত অক্টোবরে সাঈদা আহমেদ বাঘিলিকে যখন ইয়েমেনের হোডাইডা শহরের আল থাওরা হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তখন ১৮ বছরের মেয়েটির ওজন ছিল মাত্র ১১ কেজি৷ সহজে চোখ খোলা রাখতে পারত না সে৷ দাঁড়াতেও পারত না৷ বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে এখন অন্তত সে হাসতে পারছে৷
ছবি: Reuters/A. Zeyad
তবে ঐটুকুই
হ্যাঁ৷ সে যে হাসতে পারছে সেটুকুই উন্নতি বলা হয়৷ কারণ এখনও তার শরীর বেশ খারাপ৷ হাড়গোড়ের অবস্থাও ভঙ্গুর৷ অবস্থা যে কোনোদিন স্বাভাবিক হতে পারে, সে আশা করছেন না ডাক্তাররা৷
ছবি: Reuters/A. Zeyad
আগে যেমন ছিল
প্রথম দু’টি ছবি আর ‘ক্যাপশন’ পড়ার পর যাঁরা বাঘিলি আগে দেখতে কেমন ছিল জানতে চান তাদের জন্য এই ছবি৷ অক্টোবরে তাকে যখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তখনকার ছবি এটি৷
ছবি: Reuters/A. Zeyad
শুরু পাঁচ বছর আগে
পাঁচ বছর আগে প্রথম বাঘিলির মধ্যে পুষ্টিহীনতার লক্ষণ দেখা দেয়৷ গলায় ব্যথার কারণে সে শক্তি কিছু খেতে পারে না৷ ফলে শুধু তরল জাতীয় খাবার খেতে হচ্ছে তাকে৷
ছবি: Reuters/A. Zeyad
গৃহযুদ্ধ সমস্যা বাড়িয়েছে
ইয়েমেনে গত প্রায় ১৯ মাস ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে৷ সৌদি নেতৃত্বাধীন আরব জোট ও ইরানের সমর্থনপুষ্ট হুতি মুভমেন্টের সদস্যদের মধ্যে এই যুদ্ধ চলছে৷ এমন পরিস্থিতিতে বাঘিলির অভিভাবকরা পর্যাপ্ত অর্থ আয় করতে পারেননি বলে এই সময়টায় তাঁর চিকিৎসা করা সম্ভব হয়নি৷ ছবিতে বাঘিলির বাবাকে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/K. Abdullah
অবশেষে
বাঘিলির খালা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানান, কয়েকজন দানশীল ব্যক্তি অর্থ সহায়তা দেয়ায় বাঘিলিকে ২২ অক্টোবর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ ছবিটি সেই সময় তোলা৷
ছবি: Reuters/A. Zeyad
আগের কথা
অসুস্থ হওয়ার আগে ভেড়া পালতো বাঘিলি৷ হোডাইডা থেকে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি গ্রামে তারা বাস করে৷
ছবি: Reuters/K. Abdullah
খাদ্য সংকট
জাতিসংঘ বলছে, গৃহযুদ্ধের কারণে ইয়েমেনে দুর্ভিক্ষ শুরু হতে পারে৷ বর্তমানে দেশটির অর্ধেকেরও (১৪ মিলিয়ন) বেশি নাগরিক খাদ্য সংকটে রয়েছেন বলে জানিয়েছে সংস্থাটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/EPA/Yahya Arhab
অপুষ্টি
ইউনিসেফ-এর হিসেবে সে দেশের প্রায় ১৫ লক্ষ শিশু এখন অপুষ্টিতে ভুগছে৷ এর মধ্যে তিন লক্ষ ৭০ হাজার শিশুর মধ্যে অপুষ্টির মাত্রা এত বেশি, যা তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দূর্বল করে দিচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/B. Stirton
প্রাণহানি
গৃহযুদ্ধের কারণে ইয়েমেনে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে৷ অবশ্য জাতিসংঘের হিসেবে সংখ্যাটি সাত হাজারের কাছাকাছি৷
ছবি: REUTERS
10 ছবি1 | 10
চলতি বছর, অর্থাৎ ২০১৭ সালের পরিস্থিতি তার চেয়েও ভয়ংকর৷ বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক শিশু সংগঠন সেভ দ্য চিলড্রেন এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, খাদ্য সংকটের কারণে দেখা দেয়া নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে ইয়েমেনে প্রতি দিন গড়ে ১৩০ জন শিশু মারা যাচ্ছে৷ মৃত্যুর এ হার বজায় থাকলে বছর শেষে এক বছরে মৃত শিশুর সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়াবে বলেও বিবৃতিতে বলা হয়৷ ইয়েমেনে এ বছর ইতিমধ্যেই ৪০ হাজারেরও বেশি শিশু মারা গেছে৷ ফলে অবরোধ প্রত্যাহার না করা হলে বাকি প্রায় দেড় মাসে আরো ১০ হাজার শিশুর মৃত্যু অনিবার্য বলেই মনে করছে সেভ দ্য চিলড্রেন৷
সেভ দ্য চিলড্রেন-এর ইয়েমেন কার্যালয়ের পরিচালক তামের কিরোলোস বলেছেন, ‘‘এই মৃত্যুগুলো খুব বেশি দুঃখজনক, কেননা, চাইলেই এগুলো এড়ানো যায়৷ প্রতিদিন নিজের সন্তানের মৃত্যুর কারণে অন্তত একশ' জন মায়ের আহাজারি শুনছি আমরা৷ এটা ভীষণ হতাশার৷''
ইয়েমেনে সংকট আরো ঘনাচ্ছে
এক মারাত্মক গৃহযুদ্ধের কবলে পড়ে ইয়েমেন একটির পর একটি সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে৷ কখনো অনশন ও দুর্ভিক্ষ, কখনো কলেরা মহামারী৷ সংঘাতের দাম দিচ্ছেন দেশের বেসামরিক জনগণ৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/H. Mohammed
বিপর্যয়ের মূল কারণ
জাতিসংঘের মতে, যুদ্ধই হলো ইয়েমেনে একটির পর একটি সংকটের মূল কারণ৷ ২০১৪ সালে হুতি বিদ্রোহীরা রাজধানী সানা দখল করার অভিযান শুরু করার পর থেকে দশ হাজারের বেশি মানুষ এই সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন৷ ২০১৫ সালের মার্চ মাসে একটি সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে একটি নির্মম অভিযান শুরু করে, যা বেসামরিক জনগণের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এ অভিযান আন্তর্জাতিক ভাবে সমালোচিতও হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/H. Mohammed
যারা অনাহারে মরছে
যুদ্ধের কারণে বেসামরিক নাগরিকদের একটি বড় অংশের কাছে মানবিক ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না৷ দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ ‘খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার’ মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন৷ অন্তত ২২ লাখ শিশু গুরুতর অপুষ্টিতে ভুগছে বলে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানিয়েছে৷ যুদ্ধে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীরা যাতে ত্রাণসাহায্য প্রেরণের সুযোগ দেয়, সেজন্য জাতিসংঘের প্রধান আন্তোনিও গুতেরেস নিরাপত্তা পরিষদকে চাপ সৃষ্টি করতে বলেছেন৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/H. Mohammed
বাস্তুহারা
যুদ্ধে ২২ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুহারা হয়েছেন, তাদের মধ্যে মুহাম্মাশীনের মতো প্রান্তিক গোষ্ঠীরা রয়েছে৷ এই সংখ্যালঘু উপজাতি গোষ্ঠী আদতে আফ্রিকা থেকে ইয়েমেনে আসে৷ ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ সত্ত্বেও সোমালিয়া থেকে বহু মানুষ ইয়েমেনে পলায়ন করছেন, যার ফলে ইয়েমেনে ২৫৫,০০০-এর বেশি সোমালি উদ্বাস্তু অবস্থান করছেন বলে ইউএনএইচসিআর-এর বিবৃতিতে প্রকাশ৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/H. Mohammed
কলেরা
চলতি অক্টোবর মাসে ইয়েমেনে সম্ভাব্য কলেরা রোগের ঘটনা ৭৫০,০০০ ছাড়িয়ে যায় বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংগঠন জানিয়েছে৷ এ বছর ইয়েমেনে অন্তত ২,১৩৫ জন মানুষ কলেরায় প্রাণ হারিয়েছেন৷ রেড ক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটি সাবধান করে দিয়েছে যে, বছর শেষ হবার আগে ইয়েমেনে কলেরার ঘটনা দশ লাখে পৌঁছাতে পারে৷
ছবি: Reuters/K. Abdullah
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মূল্য দিচ্ছে যারা
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ইয়েমেনকে একটি গুরুত্বপূর্ণ রণাঙ্গণ বলে গণ্য করা হয়৷আরব উপদ্বীপে ইয়েমেনই আল-কায়েদার গতিবিধির মূল ঘাঁটি৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিতভাবে আল-কায়েদা নেতাদের বিরুদ্ধে ড্রোন ব্যবহার করে থাকে৷ এ ধরণের আক্রমণে অনেক বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Y. Arhab
অঙ্গহীন শিশু
সংঘাতে জর্জর দেশে শিশুরাই সবচেয়ে বেশি বিপন্ন৷ ইয়েমেনে এক কোটি দশ লাখের বেশি শিশুর মানবিক সাহায্য প্রয়োজন বলে জাতিসংঘের অনুমান৷ চলতি অক্টোবর মাসে সংস্থাটি বলেছে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ‘‘প্রায় ভেঙে পড়তে চলেছে,’’ অপরদিকে শিশুরা ‘‘অপুষ্টি, পেট খারাপ বা শ্বাসনলীর সংক্রমণের মতো প্রতিরোধ্য কারণে’’ প্রাণ হারাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/H. Mohammed
শান্তির কোনো লক্ষণ নেই
জাতিসংঘের সমর্থিত শান্তি আলাপ-আলোচনার একাধিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, সংঘাত অব্যাহত রয়েছে৷ সৌদি আরব ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদি-র আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত সরকারকে মদত দিয়ে যাওয়ার সংকল্প ঘোষণা করেছে৷ অপরদিকে হুথি বিদ্রোহীরা একটি জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন দাবি করেছে৷ কিন্তু কোনো পক্ষই দৃশ্যত আপোশ করতে সম্মত নয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/H. Mohammed
7 ছবি1 | 7
সাম্প্রতিক সময়ে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন অবরোধ প্রত্যাহারের আহ্বান জানালেও সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোট তাতে কর্ণপাত করেনি৷ বরং গত ৬ নভেম্বর হুতি বিদ্রোহীরা রিয়াদের কাছে মিসাইল নিক্ষেপ করার পর অবরোধ আরো কঠোর করা হয়৷
বৃহস্পতিবার যৌথ বিবৃতিতে সৌদি আরবের প্রতি অবরোধ প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও), ইউনিসেফ এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডাব্লিউএফপি) বলেছে, ‘‘(সামরিক) জোটের প্রতি আমরা আবার জীবনরক্ষাকারী সামগ্রী প্রবেশের সুযোগ দেয়ার জন্য জরুরি আহ্বান জানাচ্ছি৷ এসব পৌঁছাতে না পারলে হাজার হাজার নিরীহ মানুষ মারা যাবে, যাদের অধিকাংশই শিশু৷''
সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোট অবরোধ প্রত্যাহারের আহ্বানে সাড়া না দেয়ায় জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতেরেস হতাশ৷ তাঁকে উদ্ধৃত করে মুখপাত্র স্টেফান ডুজারিচ বলেছেন, ‘‘এই সংকট মানবসৃষ্ট৷ এটা বড় বোকা বোকা যুদ্ধ৷ ''