1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ইয়োর অনার

নূর সিদ্দিকী, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
নূর সিদ্দিকী
১৩ জানুয়ারি ২০২৩

নাটক বা সিনেমায় দেখা আদালতের দৃশ্যটিকেই বাস্তবতা বলে মনে করেন অনেকে৷ ‘অনেকে’ বলতে আমি যারা কখনো আদালতে যাননি তাদেরকে বুঝিয়েছি৷

বাংলাদেশের একটি আদালত কক্ষছবি: DW/M. Mostafigur Rahman

নাটক সিনেমার আদালতের দৃশ্যে একজন জজ বা বিচারককে দেখা যায় খুব গম্ভীরমুখে বসে থাকতে৷ অপটু নির্মাতারা একজন বিচারককে বসিয়েই দায় সাড়েন৷ কোর্টের অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাখেন না৷ তবে আসামির জন্য একটা কাঠগড়া থাকবেই থাকবে৷ দৃশ্যায়ন খুব পরিচ্ছন্ন হয় সব নাটুকে আদালতের দৃশ্যগুলোর৷ যেমন একজন আসামী থাকবেন কাঠগড়ায়৷ তাকে একজন আইনজীবী জেরা করা শেষ হলে আরেকজন উঠবেন- মাইলর্ড বা ইয়োর অনার বলে৷ আর আদালতে হট্টগোল হলে বিচারক তার কাঠের হাতুড়ি পিটিয়ে গলায় সামান্য রাগ ঢেলে বলেন- অর্ডার অর্ডার অর্ডার৷

ঢালিউড-টালিউড-বলিউডের সিনেমার দৃশ্য প্রায় একইরকম৷ ফলে যারা কোনো মামলার বিচারকাজ বিচারিক আদালত বা নিম্ন আদালতে দেখার সুযোগ পাননি, তাদের কাছে আদালত বা আদালতের এজলাস কক্ষ সিনেমার দৃশ্য ভিন্ন আর কিছু নয়৷

ক. ২০০৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত আমার কাছেও তাই মনে হয়েছে৷ টেলিভিশনে সাংবাদিকতায় যুক্ত হওয়ার পরই আমি প্রথম আদালতে প্রাঙ্গণে যাই, আদালতের এজলাসে যাই৷ আমার মাথায় গেঁথে থাকা এজলাসের সেই নাটুকে দৃশ্য মুছে যেতে অনেকটা সময় লেগেছে৷

নাটুকে আদালত আর বাস্তবের আদালত বা এজলাসের দৃশ্যের যে আকাশ-পাতাল তফাৎ তা কিন্তু নয়৷তবে তফাৎটুকু চোখে পড়ার মতো৷ প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা এখনও মনে পড়ে৷ মহানগর দায়রা জজ আদালতের একটি এজলাসে গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য৷ মাঝারি মাপের একটি কক্ষে দুইশতাধিক মানুষ৷ গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার৷ বিচারকের মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে ঘটর ঘটর শব্দে৷ বিচারকের টেবিল পর্যন্ত চলে গিয়েছেন আইনজীবীরা৷ একটি মামলার জন্যই জনাপঞ্চাশেক আইনজীবী৷ কারা কোনপক্ষের বোঝা মুশকিল৷ দুইপক্ষই কথা বলছেন৷ আবার আছেন রাষ্ট্রপক্ষ৷ তিনপক্ষই একসঙ্গে বিচারককে কনভিন্স করার চেষ্টা করছেন৷ কিন্তু বিচারককে দেখলাম মন দিয়ে একটি ফাইল পড়ছেন (ওই মামলা সংক্রান্ত তো বটেই)৷ ওদিকে আইনজীবীদের ত্রিপক্ষীয় হট্টগোল কিন্তু চলছেই৷ অনেকক্ষণ পর বিচারক কথা বলতে শুরু করলেন৷ নাটুকে আদালত হলে এতক্ষণে নয়বার ‘অর্ডার, অর্ডার, অর্ডার’ বলতেন৷ কিন্তু এই বিচারক যেহেতু নাটুকে নন, তাই হাতুড়ি খুঁজলেন না৷ ফলে আমার কিছুটা খটকা লাগলো৷

হাতুড়ির পরিবর্তে বিচারক মহোদয়কে টেবিলে কাঠ পেন্সিল দিয়ে আঘাত করতেও দেখেছি সেদিন৷ তখন মনে মনে ভেবেছিলাম হাতুড়ির ছোট ভার্সনই হয়তএই পেন্সিল৷ আমার ঘনিষ্ঠ একজন বিচারক জানালেন- তিনি বছর পাঁচেক আগে জজিয়তি পেশায় যোগদান করে প্রশিক্ষণ শেষে আদালতে বসতে গিয়ে হাতুড়ি না পেয়ে নিজেও বিস্মিত হয়েছিলেন৷ প্রথম দিনের কার্যক্রম শেষে তিনি জেলা জজ সাহেবের কাছে গিয়ে হাতুড়ির জন্য আবেদনও করেছিলেন, তার ধারণা ছিলে হাতুড়ি আদালতেরই একটি উপকরণ৷ জেলা জজ সাহেব যদিও তাকে হতাশ করে বলে দিয়েছেন, ‘‘বাস্তবের বিচারক আপনি, হাতুড়ি লাগে সিনেমার বিচারকের৷’’

এই হাতুড়ি যে কোনোকালেই ছিলে না তা কিন্তু নয়৷ হাতুড়ির ব্যবহার প্রথম হয়েছিল অ্যামেরিকায়৷ আর আমাদের দেশে বৃটিশ আমলে৷ দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে হাতুড়ি বদলে পেন্সিলে রুপান্তরিত হবে তাতে আর বিস্মিত না হলেও চলবে৷

খ. ‘ইয়োর অনার’ ‘মাই লর্ডমি লর্ড’, বিচারককে সম্বোধনের ক্ষেত্রে শব্দ দুটো বহুল ব্যবহৃত৷ হোক সিনেমায় বা বাস্তবের আদালতে৷ কিন্তু এই শব্দের বাইরে অনেক আইনজীবীই বিচারককে স্যার সম্বোধন করতে দেখেছি নিম্ন আদালতে৷ উচ্চ আদালতে ‘ইয়োর অনার’ ‘মাই লর্ড/মি লর্ড’ই ভরসা এখনও৷

২০০৮সাল থেকে এ পর্যন্ত অসংখ্যবার আদালতে গিয়েছি সাংবাদিক হিসেবে৷ নিম্ন বা বিচারিক আদালতের পরিবেশ এমন যে, এই কয়েক বছর আগেও গণমাধ্যম কর্মীরা আদালতে আইনজীবীদের বসার বেঞ্চে গিয়ে বসতেন মাইক্রোফোন-ক্যামেরাসহ৷ যদিও কেউ আদালতের ভেতরে কখনো চিত্রধারণ করেননি৷

এজলাসে খোলা কাঠগড়া দিনদিন নাই হয়ে যাচ্ছে৷ কাঠগড়া পরিণত হয়েছে লোহার খাঁচায়৷আদালতে বিচার চলাকালে অনেবারই অনেক আসামি আইনজীবী ও বিচারকদের ওপর চড়াও হওয়ার চেষ্টা করেছেন৷ বিশেষত জঙ্গিরা আদালতে যে আচরণ করেন তাতে খোলা কাঠগড়ায় আর নিরাপদ বোধ করা মুশকিল বলেই হয়ত লোহার খাঁচা বানানো হয়েছে৷ তবে এই খাঁচার উচ্চতা কিন্তু ছাদ সমান নয়, লম্বাটে অনেক আসামিকেই কুঁজো হয়ে বহুকষ্টে আদালতে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে দেখেছি৷

গ. নিম্ন বা বিচারিক আদালত থেকে আরেকটি চর্চা নাই হয়ে যাচ্ছে৷ সেটি হচ্ছে আদালতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন৷ উচ্চ আদালতে সেই চর্চা অব্যাহত আছে৷ সম্মান প্রদর্শনে আদালতের নির্দিষ্ট রীতি আছে৷ যেমন- কোনো আইনজীবী আদালতে প্রবেশ করেই মাথা নীচু করে বিচারককে সম্মান জানাবেন৷ অনেকটা জাপানি ‘বাউ’র মতো৷ এরপর তিনি বসবেন৷ আদালতে শুনানীতে অংশ নেয়ার পরও তিনি একইভাবে সম্মান জানিয়ে আসনগ্রহণ করবেন৷ প্রয়োজন শেষে আদালতকক্ষ ত্যাগের সময় আইনজীবীরা কয়েক কদম পেছন দিকে হাঁটেন ( ব্যাক গিয়ারে যাবার মতো)৷ এরপর বাউ করে আদালতকক্ষ ত্যাগ করেন৷ সুপ্রিমকোর্টের দুই বিভাগেই আইনজীবীরা এটা মেনে চলেন৷

এমন নয় যে, আপনি আদালতে প্রবেশ করলেন, বাউ করলেন, পেছন দিকে হাঁটলেন সবই বিচারক চেয়ে চেয়ে দেখছে, তা কিন্তু নয়৷ বিচারক নিজের কাজে ব্যস্ত, কে এলো গেল তা নিয়ে ভাবারই অবকাশ নেই৷ কিন্তু একজন আইনজীবী আদালতকে সম্মান জানায়, জানাবে এটাই রীতি৷

তবে নিম্ন আদালতে এই চর্চা যে আইনজীবীরা চালিয়ে যাবেন সেই পরিস্থিতিই বা কোথায়? আদালতকক্ষ বা এজলাসে তো তিল ধারণের জায়গাই থাকে না৷ বাউ করতে গেলে মাথায় মাথা ঠুকে হাউকাউ লেগে যাবে৷

সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ থেকে অবসর নিয়েছেন এমন অনেক বিচারপতির বিচারকাজ পরিচালনা দেখাকে সৌভাগ্য মনে হয়৷ যারা আদালতের পবিত্র বা নিয়মনিষ্ঠা, শৃঙ্খলা ইত্যাদি নিখুঁতভাবে বজায় রাখতেন৷ যেমন- একাধিকবার আইনজীবীর পোশাক ঠিকঠাক না হওয়ায় আদালত থেকে বের হয়ে, ঠিক করে ফিরে আসার নির্দেশ দিতে দেখেছি৷ কোট-গাউন-কলারব্যান্ডের কোথাও সামান্য ত্রুটিও তাঁরা মানতেন না৷

শুধু পোশাক নয়, মামলার আবেদন বা নথিপত্রে বাক্য ও বানান ভুল থাকলেও ফিরিয়ে দিয়েছেন অনেক বিচারপতিই৷ আইনজীবীরা তা মেনেও নিয়েছেন বিনা তর্কে৷ তারা শিখতে চাইতেন কেবল বিচারকই নয় সিনিয়রদের কাছ থেকেও৷

আইনজীবীরা আদালতে কিভাবে বসবেন তা-ও নজরে রাখতেন এমন বিচারপতিও ছিলেন, এখনো আছেন নিশ্চয়ই৷ স্কুলের শিক্ষার্থীদের মতো দুই হাত হাইবেঞ্চে রেখে বসলে, অথবা সামনের বেঞ্চে কুঁজো হয়ে থাকলেও ইশরায় সতর্ক করে দিতেন৷ আদালতকে সম্মান জানানোর এই চর্চা নিম্ন আদালতে অনেকাংশে অনুপস্থিত, অন্তত আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে৷

ঘ. উচ্চ আদালতের বেশ ক'জন সাবেক বিচারপতির নজির উল্লেখ করতে পারবো যারা শুনানি চলাকালে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের মামলাকে অগ্রাধিকার দিতেন৷ উচ্চ আদালতে মামলা চলে কজলিস্ট বা কার্যতালিকা অনুসারে৷ তারপরও একাধিক বিচারপতিকে দেখেছি এজলাসে উপস্থিত জ্যেষ্ঠ বা প্রবীণ কোন আইনজীবী উপস্থিত থাকলে সম্মানের সঙ্গে তাঁকে ডেকে মামলা শুরুর অনুরোধ করতেন৷ বেশিরভাগ জ্যেষ্ঠ আইনজীবীই যে তাতে সাড়া দিতেন তা কিন্তু নয়৷ তাঁরা বিচারপতিকে ধন্যবাদ জানাতেন বিশেষ সুবিধার প্রস্তাবের জন্য৷

আদালতের(হোক তা নিম্ন কিংবা উচ্চ) সৌন্দর্য মূলত নির্ভর করে বার (আইনজীবী) ও বেঞ্চের (বিচারক/বিচারপতি) পরস্পরের শ্রদ্ধার ওপর৷ বারের অসহযোগিতায় চরম দক্ষ বিচারকও বিড়ম্বনায় পড়েন৷ একইকথা খাটে বিচারকদের বেলায়ও৷ যে আদালতে দুইপক্ষ যতটা পেশাদারী আচরণ করবে সেই আদালত তত সফল৷

ঙ. হঠাৎ করে আদালত নিয়ে এতো আলাপের কারণ সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি আদালতে বিচারকের সঙ্গে আইনজীবীদের আচরণের কারণে সারাদেশের বিচারক-আইনজীবী প্রায় মুখোমুখি অবস্থান চলে গিয়েছে৷

আইনজীবী ও কর্মচারীদের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে স্থবির হয়ে পড়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা জজ আদালত৷ বিচারকের সঙ্গে আইনজীবীদের অসৌজন্যমূলক আচরণ, বিচারিক কাজে হস্তক্ষেপ, কর্মচারীদের মারধর, মুঠোফোন ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগে আদালতের কর্মচারীরা কর্মবিরতি পালন করছেন৷

ঘটনার শুরু হয়েছিল-  গেলো ১লা ডিসেম্বর৷ সেদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা জজ আদালতের শেষ কার্যদিবস ছিল৷ ওই দিন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুকের আদালতে কয়েকজন আইনজীবী বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কয়েকটি মামলা দাখিল করেন৷ কিন্তু দাখিলে বিলম্ব হওয়ার কারণে ওই আদালতের বিচারক মামলাগুলো গ্রহণ করেননি৷ আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মামলাগুলো নেওয়ার অনুরোধ করলেও বিচারক তা শোনেননি৷ পরে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সশরীর ওই বিচারকের এজলাসে গিয়ে মামলাটি নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন৷ তখন বিচারক তাঁদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ ও আইনজীবীদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন বলে অভিযোগ ওঠে৷

অভিযোগের বিষয়ে মোহাম্মদ ফারুক ঢাকার গণমাধ্যমকে বলেছেন- ১ ডিসেম্বর আমার আদালতে পাঁচটি সিআর মামলার শুনানি শেষে বাদীর জবানবন্দি নিয়ে মামলাগুলো অনুসন্ধানের জন্য পাঠাই৷ নামাজ ও দুপুরের খাবার শেষে আবার আদালতে উঠি৷ নিয়মানুযায়ী সব শেষ করি৷ বিকেলে এজলাসে দুই থেকে তিন আইনজীবী নতুন করে মামলা নিতে চাপ সৃষ্টি করেন৷ তবে তাঁদের নিয়ম অনুসরণ করে মামলা জমা দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে এজলাস থেকে নেমে যাই৷ কারণ, আইনানুযায়ী সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে বিচারকের এজলাসে ওঠার আগেই আদালতে মামলা দাখিল করতে হয়৷ কিন্তু বিকেল চারটার দিকে আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক খাস কামরায় এসে আমার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন৷

ওই ঘটনার জের হিসেবে গত রোববার থেকে আইনজীবীদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যের অভিযোগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের-১ বিচারক (জেলা জজ) মোহাম্মদ ফারুকের আদালত বর্জন করেন আইনজীবীরা৷ আইনজীবী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া বার অ্যাসোসিয়েশন নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যের অভিযোগ তুলে এই বিচারকের প্রত্যাহার দাবি করে জেলা আইনজীবী সমিতি৷

আর জেলা জজ মোহাম্মদ ফারুকের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের বিচার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে আদালতের কর্মচারীরা৷ তাদের আন্দোলনের জন্য জজ শারমিন নিগারকে দায়ী করছেন আইনজীবী সমিতির নেতারা৷ সমিতির সভাপতি তানভীর ভূঁইয়া গণমাধ্যমকে বলেছেন, আইনজীবী সমিতি ও আইনজীবীদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর আদালত বর্জন করেছেন আইনজীবীরা৷ এক মাস হলেও বিষয়টির কোনো সুরাহা হয়নি৷ জেলা জজের খাস কামরায় বসে কর্মচারীরা কর্মবিরতি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ এর পেছনের মূল নায়ক জেলা জজ শারমিন নিগার৷ আইনজীবীরা জেলা জজ শারমিন নিগার, বিচারক মোহাম্মদ ফারুক ও নাজির মমিনুল হকের অপসারণ দাবি করেন৷  সমিতির সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমানও একই দাবি জানিয়েছেন৷

এদিকে এজলাস চলাকালীন জেলা জজের নামে অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ শ্লোগান প্রদান করে বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করাসহ মানহানির অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা আইনজীবী সমিতির ২১ আইনজীবীকে আগামী ২৩ জানুয়ারি তলব করেছেন হাইকোর্ট৷

চ. ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদালতের ঘটনার প্রভাব সারাদেশেই কিছুটা পড়েছে বা পড়বে এই আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না৷ প্রভাব পড়বে এই আশঙ্কার পেছনে যুক্তি খুঁজে পেতে কষ্ট হবে হয় তো কিন্তু পড়বে না তার পক্ষে যুক্তি দিচ্ছি৷  ২০১৯ এর ৬  ডিসেম্বর৷  নজিরবিহীন হট্টগোল হয়েছিল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতে৷ বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা প্রায় তিনঘন্টা আদালতের কার্যক্রমই বন্ধ রাখতে বাধ্য করেছিলেন৷ তখনকার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বেঞ্চের অন্য বিচারপতিদের নিয়ে তুমুল চিৎকার-শ্লোগান-হট্টগোলের মধ্যে এজলাস ত্যাগ করেন মামলার আদেশ না দিয়েই৷ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানিকে কেন্দ্র করে সর্বোচ্চ আদালতে তুমুল হৈচৈ, হট্টগোল ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে৷

বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের অনেকেই মানবিক কারণে খালেদা জিয়ার জামিন চেয়ে সমস্বরে স্লোগান দিতে থাকেন৷  এ সময় আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরাও চিৎকার করতে থাকেন৷

বারবার চেষ্টা করেও বিচার কার্যক্রম শুরু করতে না পেরে একপর্যায়ে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, 'বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে৷  আমরা আপিল বিভাগে এমন অবস্থা আগে কখনও দেখিনি৷ মামলার আদেশ দেওয়া হয়ে গেছে৷ এজলাসে বসে আদালতের পরিবেশ নষ্ট করবেন না৷ আপনারা যে আচরণ করেছেন, তা নজিরবিহীন'৷

নূর সিদ্দিকী, সাংবাদিক ও সাহিত্যিকছবি: Privat

সেদিন এই হট্টগোলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কারা জানেন? বিএনপিপন্থি হলেও তারা দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী৷ সেদিন খালেদা জিয়ার পক্ষে উপস্থিত ছিলেন ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, মওদুদ আহমদ, জয়নুল আবেদীন, খন্দকার মাহবুব হোসেন, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, নিতাই রায় চৌধুরী, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল প্রমুখ৷  আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা বা অ্যাটর্নি জেনারেল নিজে৷  তাদের সবার উপস্থিতিতে সেই হট্টগোলকে শুধু নজিরবিহীন বলাও কম হয়ে যায়৷

পরে কিন্ত ওই ঘটনার কোন প্রতিফলন আমরা সারাদেশের আদালতে দেখিনি৷ ক'দিন পর সব মিটমাট হয়ে গিয়েছে৷ ফলে সব কিছুতেই মন্দ কিছুর আশঙ্কা করা ঠিক হবে না৷

ছ. তবে আদালতের ওপর মানুষের ‘আস্থা-অনাস্থা' বলে একটা কথা আছে৷  আইনজীবীরা তো বটেই বিচারপতিরাও অনেক সময় বলেছেন আদালতের ওপর মানুষের আস্থা বাড়ানোর কথা৷ আস্থার সংকট যাতে না হয় সেজন্য আইনজীবী ও বিচারকদের দায়িত্বশীলতার পরামর্শও তারা দিয়েছেন বহুবার৷

জ. আশাবাদী না হয়ে উপায় নেই৷ তারপরও কিছু তবে কিন্তু থাকে৷  বারবার ‘তবে কিন্তু'ই আমাদের আদালত প্রাঙ্গণকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে এমনটা আশা করতে চাই না৷ সিনেমায় দেখা সেই নাটুকে আদালত বাস্তবে ফিরলে দোষ কী? বাস্তবতা থেকেই সিনেমা-সাহিত্য তৈরি হয়, সিনেমা-সাহিত্যের অনুকরণে আবার বাস্তবতায় বদলে যায় অনেক সময়৷  শুধুমাত্র আইনজীবী-বিচারক-বিচারপ্রার্থী নয় আমাদের আদালত আমাদের সবার গর্বের হোক৷  আইনের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ুক৷ শ্রদ্ধা বাড়ুক উকিল-মক্কেল-বিচারক সবার, সবার প্রতি৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ