চলতি মাসেই চিলি মরুভূমির একটি পাহাড় চূড়ায় শুরু হচ্ছে অতিকায় এক টেলিস্কোপ বসানোর কাজ, যা মহাকাশের দিকে বিজ্ঞানীদের নজর রাখার কাজটি আরো সহজ করে দেবে৷ দেখা যাবে ‘মিল্কিওয়ে’-র বাইরের বিশ্বটাও৷
বিজ্ঞাপন
এই অবজারভেটরি বা মানমন্দিরের নাম দেয়া হয়েছে ইউরোপিয়ান এক্সট্রিমলি লার্জ টেলিস্কোপ (ই-ইএলটি)৷ এর সাহায্যে পৃথিবীতে বসেই আমাদের সৌরজগতের বাইরের জগৎ দেখার এবং পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পাবেন জ্যোতির্বিদরা৷
অতিকায় এই টেলিস্কোপটি নির্মাণ করছে ১৫টি দেশের মিলিত সংস্থা ‘ইউরোপিয়ান সাউদার্ন অবজারভেটরি'৷ চিলিতে তাদের বেশ কয়েকটি মানমন্দির থাকলেও এ সংস্থার ৫০ বছরের ইতিহাসে ই-ইএলটি হবে সবচেয়ে বড় ও উচ্চাভিলাষী উদ্যোগ৷
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সপেরিমেন্টাল ফিলসফির অধ্যাপক গ্যারি গিলমোর এই প্রকল্পের সঙ্গে আছেন একেবারে শুরু থেকে৷ তাঁর ভাষায়, ই-ইএলটি-র পুরো নামের প্রতিটি শব্দই গুরুত্বপূর্ণ৷ প্রথমত এটি পুরোপুরি ইউরোপীয় এবং দ্বিতীয়ত এটি সত্যিই অতিকায়৷
মহাশূন্যে হাত বাড়াচ্ছে ইউরোপ
চালকযুক্ত স্পেস ক্যাপসুলটির নাম ওরিয়ন৷ এসা এবং নাসা ২০১৭ সালে যৌথভাবে এই ক্যাপসুলটিকে মহাশূন্য প্রেরণ করবে৷ এসা দেবে মুখ্য মডিউলটি৷
ছবি: ESA/Foster + Partners
তারা থেকে তারায়
চালকযুক্ত স্পেস ক্যাপসুলটির নাম ওরিয়ন৷ এসা এবং নাসা ২০১৭ সালে যৌথভাবে এই ক্যাপসুলটিকে মহাশূন্য প্রেরণ করবে৷ এসা দেবে মুখ্য মডিউলটি৷ ক্যাপসুলটি প্রথমে চন্দ্র প্রদক্ষিণ করবে৷ তারপর মহাশূন্যে অবস্থান নেবে একটি নির্দিষ্ট বিন্দু হিসেবে৷ হয়তো মঙ্গলগ্রহ যাত্রার পথে তা কাজে লাগবে৷
ছবি: ESA-D. Ducros, 2012
মাধ্যাকর্ষণ না থাকায় অভ্যস্ত হওয়া
প্রথমে ইউরোপের নভচারীদের পৃথিবী প্রদক্ষিণ করার, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্র আইএসএস’এ যাত্রা করার পালা৷ এসা’র অ্যাস্ট্রোনট ইটালির লুকা পার্মিতানো একটি জলের চৌবাচ্চায় স্পেস ওয়াক অভ্যেস করছেন৷ স্থান: কোলোনের কাছে ইউরোপীয় নভচারী কেন্দ্র (ইএসি)৷
ছবি: ESA/H. Rueb, 2010
আইএসএস’র জন্য তিন ইউরোপীয় নভশ্চর
লুকা পার্মিতানো আইএসএস’এ থাকবেন এ’বছরের মে মাস থেকে নভেম্বর মাস অবধি৷ ২০১৪ সালে এ’ভাবেই যাবেন জার্মানির আলেক্সান্ডার গের্স্ট৷ তারপরে যাবেন একজন মহিলা, ইটালির সামান্থা ক্রিস্টোফোরেত্তি৷
ছবি: dapd/NASA
মানুষের বদলে মাল পরিবহণ
তিন ইউরোপীয় নভশ্চর আইএসএস’এ যাবেন রুশ সোয়ুজ রকেটে চড়ে৷ এসা ইতিমধ্যে তথাকথিত অটোম্যাটিক ট্রান্সফার ভেহিকেল বা এটিভি’র মাধ্যমে আইএসএস’এ মালপত্র পাঠায়৷ পরের যাত্রা আগামী ১৮ই এপ্রিল৷ এটিভি’তে সাত টন খাদ্য ও সরঞ্জাম পাঠানো যায়৷
ছবি: ESA/S.Corvaja/dapd
চন্দ্রবাসের স্বপ্ন
চন্দ্রপীষ্ঠে এ’ধরনের একটি গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন থেকে এসা এখনও অনেক দূর৷ সেখানে জন পাওয়া গেলে, তা’তে চাঁদের ধুলো মিশিয়ে বাড়িঘর তৈরি করা যেতে পারে৷ এবং চাঁদে জল আছে কিনা, চীনের চাঙ-ই ৩ রোভার চন্দ্রযান তা এ’বছরেই জানতে পারবে৷ চন্দ্রে অবতরণের পর এসা ঐ রোভারে তথ্য পাঠানোর ভার নেবে এবং তার গতিবিধি পরিচালনা করবে৷
ছবি: ESA/Foster + Partners
ডার্মস্টাট থেকে স্যাটেলাইট পরিচালনা
এসা’র ইউরোপীয় মহাকাশ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বা এসক থেকে চাঙ-ই ৩’এর আগের চীনা মহাকাশযানগুলিতে তথ্য পাঠানোয় সাহায্য করা হয়েছিল৷ চীনের আগের মহাকাশযানগুলি চন্দ্র প্রদক্ষিণ করেছে কিন্তু চন্দ্রপীষ্ঠে অবতরণ করেনি৷ এসক থেকে অপরাপর বহু গবেষণা ও যোগাযোগ সংক্রান্ত স্যাটেলাইটের যাত্রার উপর নজর রাখা হয়৷
ছবি: ESA - J. Mai
থ্রি-ডি’তে আমাদের ছায়াপথ
এ’বছরের অক্টোবর মাসে স্পেস প্রোব বা মহাশূন্য অভিযাত্রী যান ‘গাইয়া’ তার যাত্রা শুরু করবে৷ ইন্টারোফেরোমিটারের সাহায্যে আলোকতরঙ্গ থেকে আমাদের নক্ষত্রপুঞ্জের একটি থ্রি-ডি ছবি তৈরি করবে এবং ‘মিল্কি ওয়ে’ ছায়াপথের অনেক রহস্য উদঘাটন করবে৷ এসা’র গবেষকরা অন্তত এক বিলিয়ন নতুন তারা আবিষ্কার করার আশা করছেন৷ এমনকি তিন বিলিয়নও হতে পারে৷
ছবি: ESA/Medialab
গ্রহাণুর সন্ধানে
রোজেট্টা স্পেস প্রোব’টি ২০০৪ সাল যাবৎ ৬৭/পি চুরজুমভ-গেরাসিমেঙ্কো ধূমকেতু অভিমুখে যাত্রা করছে৷ ২০১৪ সালের সূচনায় মহাকাশযানটি ধূমকেতুটির কক্ষপথে যোগদান করবে৷ তবে ধূমকেতু অবধি পৌঁছতে পৌঁছতে রোজেট্টা অনেক কিছু দেখবে: নাসা’র ডিপ ইমপ্যাক্ট প্রোজেক্টাইলটি কিভাবে টেম্পল ওয়ান ধূমকেতুতে আঘাত করবে৷ এচাড়া রোজেট্টা দেখবে মঙ্গলগ্রহ এবং স্টাইনস ও লুটেশিয়া নামের দ’টি অ্যাস্টেরয়েড বা গ্রহাণু৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ধূমকেতুর উপর অবতরণ
২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে রোজেট্টা ফিলি নামের এই রোবোটটিকে ধূমকেতুর উপরে নামাবে৷ কোলোনে অবস্থিত জার্মান বিমান ও মহাকাশযাত্রা কেন্দ্র ডিএলআর থেকে সেই অবতরণ নিয়ন্ত্রণ করা হবে৷ কাজটা শক্ত হবে, কেনান ধূমকেতুটির মাধ্যাকর্ষণ খুব বেশি নয়৷ রোজ্ট্টা ধূমকেতুটির রাসায়নিক উপাদান বিশ্লেষণ করবে৷
ছবি: ESA/AOES Medialab
স্যাটেলাইটের রিসাইক্লিং সম্ভব নয়
অর্ধশতাব্দী ধরে মহাকাশে রকেট ও স্যাটেলাইট পাঠানো হচ্ছে৷ এক সেন্টিমিটারের চেয়ে বড় প্রায় ছ’লাখ নানা ধরনের ও আকারের স্ক্র্যাপ এ’ভাবে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করছে৷ এসা চাপ দিচ্ছে মহাশূন্যে আবর্জনা কমানোর জন্য: অকেজো স্যাটেলাইটগুলোকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রিতভাবে ভূপাতিত করতে হবে৷
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
‘‘আয়না পর্যন্ত মাপ ধরলে এটি প্রায় ৪০ মিটার দীর্ঘ৷ এ পর্যন্ত যত টেলিস্কোপ বানানো হয়েছে, সেগুলোর যে কোনোটির চেয়ে এটি কয়েকগুন বড়৷ আকৃতিতে প্রায় একটি টেনিস কোর্টের মতো৷ এমনভাবে এর নকশা করা হয়েছে, যাতে রাতের আকাশে উঁচু মানের ছবি পাওয়া সম্ভব হবে৷''
বাইরে থেকে দেখলে ই-ইএলটি-কে আন্দেজ পর্বতমালায় ইউরোপিয়ান সাউদার্ন অবজারভেটরির বর্তমান মানমন্দিরের মতোই মনে হবে৷ নতুন এই টেলিস্কোপ বসাতে চিলির সেরো আমাজোনা পাহাড়ের চূড়া বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দিতে হবে প্রকৌশলীদের৷ চিলির উত্তরে উপকূলীয় পার্বত্য অঞ্চলের মাঝামাঝি এলাকা হওয়ায় মানমন্দিরের আবহাওয়া হবে শুষ্ক ও ঝকঝকে৷ জ্যোতির্বিদদের কাছে এ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷
গিলমোর বলেন, ‘‘পানি আর বাতাস – দুটোই টেলিস্কোপের বড় শত্রু৷ রাতের আকাশ দেখার সময় এ দুটোই সবচেয় বড় সমস্যা সৃষ্টি করে৷ বাতাসের হাত থেকে রেহাই পেতে আপনাকে যতটা সম্ভব পাহাড়ের উপরে উঠে যেতে হবে৷ আর ওই এলাকাকে হতে হবে যতটা সম্ভব শুষ্ক৷ বাতাসে জলীয়বাষ্প বেশি হলে টেলিস্কোপের দৃষ্টি ঘোলা হয়ে যাবে৷''
কিন্তু এ টেলিস্কোপের সবচেয় বড় সমস্যা ওই আকৃতি নিয়েই৷ বিরাট আকৃতির প্রতিটি যন্ত্রপাতি অতি সাবধানতার সঙ্গে পর্বতের চূড়ায় তুলতে হবে৷ গুঁতো লেগে কোথাও টোল পড়লে চলবে না, বেঁকে গেলেও হবে না৷ কাজেই সবচেয়ে সহজ সমাধান হলো পর্বতের মাথা ছেঁটে ফেলা৷ আর এ জন্য ওই পাহাড় চূড়া থেকে কয়েক লাখ টন পাথর স্রেফ উড়িয়ে দিতে হবে৷ প্রকৌশলীরা এ কাজটি শুরু করবেন ১৯শে জুন৷
ই-ইএলটি-র জন্য এই মানমন্দির গড়ে তুলতে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হবে৷ তৈরি হয়ে গেলে ই-ইএলটি-র কাছে বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি থাকবে – ‘এই মহাবিশ্বে আমরা কি একা?'
প্রতি বছর ১৪ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয়ের স্বপ্ন
মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠাতে আগ্রহী বাংলাদেশ৷ ‘বঙ্গবন্ধু-১’ নামে দেশের প্রথম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের দায়িত্বে আছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বিটিআরসি৷
ছবি: ESA/Mixed-Reality Communication GmbH
নাম ‘বঙ্গবন্ধু-১’
মহাকাশে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট হবে ‘বঙ্গবন্ধু-১’৷ সেটা উৎক্ষেপণের দায়িত্বে আছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বিটিআরসি৷
ছবি: NASA/dpa
১৪ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয়
স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ফলে বাংলাদেশ প্রতি বছরে ১৪ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করতে পারবে বলে মনে করে বিটিআরসি৷ বাংলাদেশের ২৪টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ভাড়া বাবদ বিদেশি স্যাটেলাইট কোম্পানিকে প্রতি বছর এই অর্থ দিয়ে থাকে৷
ছবি: ESA/NASA via Getty Images
প্রতিবেশী দেশ থেকে আয়
বিটিআরসি বলছে, স্যাটেলাইট প্রকল্প থেকে যে অর্থ আয় হবে তার ৭০ ভাগ আসবে প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছ থেকে পাওয়া স্যাটেলাইট ভাড়া হিসেবে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
প্রকল্পের ব্যয়
পুরো প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩,২৪৩ কোটি টাকা৷ এর মধ্যে বিটিআরসি দেবে ১,৫৫৫ কোটি টাকা৷ আর বাকিটা আসবে বিদেশি উৎস থেকে৷ ছয়টি আন্তর্জাতিক ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠান প্রকল্পটিতে অর্থায়নে আগ্রহ দেখিয়েছে বলে জানা গেছে৷
ছবি: EADS ASTRIUM
অর্বিটাল স্লট কেনা
স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণের জন্য রুশ কোম্পানি ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে ১১৯ ডিগ্রি ইস্ট’এ একটি অর্বিটাল স্লট কিনবে বিটিআরসি৷ এক্ষেত্রে ১৫ বছরের জন্য খরচ হবে ২২ কোটি টাকা৷
ছবি: ESA–J. Huart, 2013
প্রথম উদ্যোগ
১৯৯৭-৯৮ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানোর পরিকল্পনা করেছিল৷ কিন্তু পরে সেটা আর বাস্তবে রূপ নেয়নি৷
ছবি: ESA/Mixed-Reality Communication GmbH
6 ছবি1 | 6
গিলমোর বলেন, ‘‘এই টেলিস্কোপ দিয়ে আমরা আমাদের প্রতিবেশী সৌরজগতের গ্রহগুলোর ওপর চোখ রাখতে পারব৷ এ রকম কয়েক হাজার গ্রহ-নক্ষত্র রয়েছে আশেপাশের সৌরজগৎগুলোতে৷ আমরা খুঁজতে পারব – এর মধ্যে কোনোটি গ্রীষ্মে আমাদের পৃথিবীর মতো সবুজ হয়ে ওঠে কিনা৷ আমরা এ সব গ্রহের বদলে যাওয়া বুঝতে পারব, আবহাওয়া সম্পর্কে জানতে পারব৷ দূর গ্রহ থেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে কেউ হয়ত হাত নাড়বে না৷ কিন্তু কোথাও ঘাস গজালো কিনা, আমরা তা ঠিকই বুঝতে পারব৷''
কেবল এলিয়েন খোঁজা নয়, বিলিয়ন ইউরোর এই প্রকল্পের আরো অনেক কাজ থাকবে, আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর জ্যোতির্বিদরা ই-ইএলটি-র কাছে চাইবেন৷ তবে সেজন্য তাঁদের অপেক্ষা করতে হবে আরো অনেক দিন৷ চলতি মাসে কাজ শুরু হলেও নির্মাণ শেষ হতে সময় লাগবে ১০ বছরেরও বেশি৷ আর সেই টেলিস্কোপে চোখ রাখার সুযোগ অধ্যাপক গিলমোর হয়ত পাবেন না৷
‘‘এত বড় একটি প্রকল্পের আইডিয়া পরিপক্ক হতে, সে অনুযায়ী উন্নত প্রযুক্তি তৈরি করতে, রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করতে, টাকা জোগাড় করতে, যুৎসই নির্মাণ কৌশল নির্ধারণ করতে এবং শেষ পর্যন্ত কাজ শুরু করতে ৩০-৪০ বছরও লেগে যায়৷ কাজেই যথেষ্ট তরুণ এবং সৌভাগ্যবান না হলে চূড়ান্ত সাফল্য দেখে যাওয়া সম্ভব হয় না৷ আমি নিজের জন্য এটা করছি না৷ এটা অনেকটা ওক গাছের চারা লাগানোর মতো, যার ছায়া হয়ত আপনার নাতি-নাতনিরা পাবে৷''