‘ঈদে এখন আর সাম্য দেখি না'
২১ এপ্রিল ২০২৩ডয়চে ভেলে : ঈদ কী আসলে সবার জন্য সমান খুশির?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : না, মোটেই না। শুধু নামাজের সময় ধনী, দরিদ্র সবাই একসঙ্গে নামাজ আদায় করে। কিন্তু নামাজের সময়ও দেখা যাবে মসজিদের বাইরে বহু মানুষ অপেক্ষা করে কিছু পাবে বলে বা ভিক্ষার জন্য। আমরা এখন আর সাম্যটা দেখি না। এটা আগেও ছিল। এখন বৈষম্য অনেক বেড়েছে।
কেন এই বৈষম্য?
এই বৈষম্যটা হল উন্নতির কারণে। আমাদের দেশে যে উন্নতিটা হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে পাকিস্তান আমল থেকে এখনও সেটা হচ্ছে পুজিবাদী ধরনের উন্নতি। এটা অল্প মানুষের উন্নতি হবে, মুনাফা পাবে। আর বেশিরভাগ মানুষ যারা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত তারা বঞ্চিত হবে ৷ ওই বৈষম্যটাই সর্বত্র দেখা যায়। ঈদের সময়ও তা ভালোভাবে দেখা যায়। আমি তো শুধু ভিক্ষার কথা বললাম।জামা কাপড়ের ব্যাপারেও দেখা যাবে, চলাফেরার ক্ষেত্রেও দেখা যাবে, ঈদের সময় আরও প্রকট হয়ে দেখা দেয়।
কেউ লাখ টাকার কাপড় কিনছে, কেউ কিনতেই পারছে না? এমনটি কী হওয়ার কথা ছিল?
মোটেও না। আমরা বাংলাদেশে যেটা চেয়েছিলাম মানুষে মানুষে অধিকার ও সুযোগের সাম্য। সেইটা আসেনি। এখানে ক্রমাগত বৈষম্য বাড়ছে। উন্নতি যত বাড়ছে, বৈষম্যও তত বাড়ছে। যে কোনো পরিসংখ্যান ও জরিপে এটা বেরিয়ে আসছে।
ঈদের আনন্দেও কী পরিবর্তন এসেছে?
ঈদের আনন্দ তো মোটামুটি ছিল খাবার-দাবারে। নতুন নতুন খাবার বা পুরনো খাবারই নতুনভাবে পাওয়া। আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে যাওয়া বা সামাজিকতা। খাওয়া দাওয়াটা আগের মতো ঘরে ঘরে হয়। কিন্তু তারা নিজেরা রান্না করার চাইতে রেস্টুরেন্ট থেকে কেনাই বেশি পছন্দ করে। দ্বিতীয়ত, সামাজিকতা কমে গেছে। আগে যেমন মানুষ ঈদ উপলক্ষে মানুষের বাড়িতে যেত বা অপেক্ষা করত যে মানুষ বাড়িতে আসবে। সেইটা এখন কমে গেছে। পারিবারিক বা খুবই ঘনিষ্ঠজন ছাড়া এখন আর সামাজিকতা দেখি না।
ঈদের নামাজ পড়ার পর কোলাকুলি করছে ধনী-দরিদ্র। কিন্তু এখন তো ধনীরা বিদেশে ঘুরতে যাচ্ছে, রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। পারিবারিক সামাজিকতা কী উঠে যাচ্ছে?
অবশ্যই। এখন তো রেস্টুরেন্টের সংস্কৃতি চলে এসেছে। ঘরে রান্নার চেয়ে রেস্টুরেন্টে যাওয়াই পছন্দ। আরও যারা ধনী তারা বিদেশে যাচ্ছে। এটা গেল একটা দিক। আরেকটা দিক হল, পরিবারের মধ্যেও যারা বিত্তবান আর যারা বিত্ত পাইনি তাদের মধ্যে আত্মীয়তাটা নেই। যারা ধনী হতে পেরেছে তাদের নতুন আত্মীয় স্বজন হয়েছে। আপন যে ভাই বোন তাদের সঙ্গেও আগের সম্পর্কটা নেই। আবার যারা সুযোগ বঞ্চিত ভাই বোন তারাও পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে গেছে। অসম ধনবন্টন পারিবারিক সম্পর্কটাকেও নষ্ট করছে।
ধনীদের জন্য কী ঈদ এক ধরনের বিলাসিতা?
যে কোন উৎসবই ধনীদের জন্য বিলাসিতা। তারা এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করে। ভালো কাপড়ের জন্য, ভালো খাবারের জন্য, বিদেশে ঘুরতে যাওয়ার জন্য তারা পরিকল্পনা করে। এটা উৎসব, কিন্তু সকলের জন্য একরকম উৎসব নয়। কারও জন্য বিলাসিতা, কারও জন্য কিছু প্রাপ্তির সুযোগ। গরীর মানুষ আশা করে তারা দান খয়রাত কিছু পাবে।
আমাদের দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য এত প্রকট হল কেন?
একই উত্তর। যে উন্নতি আমাদের হচ্ছে সেটা পুঁজিবাদী উন্নয়নের ধারা। এই উন্নয়ন সবসময়ই বৈষম্য সৃষ্টি করে। এই উন্নয়ন মুনাফা কেন্দ্রিক, এটা বিচ্ছিন্নতাবাদ বাড়ায়। যারা মুনাফা করে তারা আরও মুনাফা করতে চাই এবং করতে পারে। আর যারা শ্রম দেয়, উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত তারা বঞ্চিত হয়। তারা ঈদের সময় বোনাসের দাবি করবে, পাবে না। শ্রমিক আশা করবে গ্রামের বাড়িতে যাবে, কিন্তু যেতে পারবে না। কিছু উপহার কিনে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাববে কিন্তু কিনতে পারবে না। কারণ দাম বেড়ে গেছে। এটা আসলে উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত।
ঈদ আগে যেমন দেখেছেন, আর এখন যেমন দেখছেন, কীভাবে তুলনা করবেন?
ঈদে আগে এত বৈষম্য দেখা যেত না। কারণ তখন আমরা এত উন্নত ছিলাম না। এখন উন্নত হয়েছি, এজন্য বৈষম্য বেড়েছে। আগে ঈদের মধ্যে সামাজিকতা এখনের চেয়ে অধিক ছিল। আত্মীয় স্বজনের মধ্যে অতটা বৈষম্য ছিল না। দেখাশোনা হতো। আগে আরেকটা জিনিস হতো। আমরা তো পুরান ঢাকায় থাকতাম। দেখতাম ছেলে মেয়েরা সিনেমা দেখতে যেতো। ঈদ উপলক্ষে নতুন সিনেমা আসত। সেটা দেখার জন্য কিশোর কিশোরীরা অপেক্ষা করত। এখন তো আর সিনেমা হল নেই। সিনেমার ওই বিনোদনটাও চলে গেছে।
ঈদের আনন্দ আগে বেশি হতো, না এখন বেশি হয়?
এটা নির্ভর করবে কার কথা ভাবছি। যারা ধনী তাদের আনন্দ আগের চেয়ে বেশি হয়। আর যারা গরীব তাদের আনন্দ আগের চেয়ে কম হয়। ধনী দরিদ্র যদি একসঙ্গে মেলানো হয় তাহলে বলব আগের চেয়ে কম হয়। এখন অনেকটা প্রদর্শনের ব্যাপার এর মধ্যে থাকে। ঈদের আনন্দটা সামাজিক হওয়া উচিৎ। সেই সামাজিকতাটা কমে গেছে এটা ঠিক।
কীভাবে সবার জন্য সমান হতে পারে ঈদের আনন্দ?
সমাজ যদি বদলায়, সমাজে যদি সাম্য আসে, ধন বৈষম্য যদি কমে, মানুষের আয় যদি বাড়ে, কারও বেশি কারও কম না থাকে অর্থাৎ সমতার উপর নির্ভর করবে। সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে কিনা তার উপরই নির্ভর করতে এর চরিত্র।